ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একজন স্বপ্ন বিক্রেতা

প্রকাশিত: ১২:১৯, ১ আগস্ট ২০১৯

একজন স্বপ্ন বিক্রেতা

ছোটবেলায় তার সহপাঠীরা যখন ডাক্তার, প্রকৌশলী আর বৈমানিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর তখন শিক্ষককে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কিছু হব না, কিচ্ছু হব না তিনি’। ‘কিছু হতে না চাওয়ার’ সাধনাতেই নিজের মধ্যে শিল্পীসত্তা অনুভব করেন এই গুণীজন। বলছি পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতির কথা। গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের আয়োজনে ‘বাংলা গানের পরম্পরায় গান গল্পে’ শীর্ষক আয়োজনে দুই ঘণ্টা গান-গল্পে মুগ্ধতা ছড়ালেন বাংলা সংস্কৃতির শেকড় খুঁজে ফেরা এ শিল্পী। লুপ্তপ্রায় লোকগানের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, চর্চা, গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। ’৯০-এর দশকের শুরুতে সুমন, নচিকেতা, লোপা, অঞ্জন, রাঘব, তপনদের হাত ধরে বাংলা গানের যে নতুন নাগরিক প্রবাহ আসে, তার ভগীরথ শুভেন্দু মাইতি। তিনিই এঁদের খুঁজে বের করেন ও এইচএমভি-র সহায়তায় পরিচিতির জগতে আনেন। অনেক জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের স্রষ্টা শুভেন্দু মাইতি। পুরনো কাঠামো ভেঙ্গে গণসঙ্গীতকে কালোপযোগী নতুন রূপ দেয়ার পথ খুঁজেছেন সারাজীবন। গণসঙ্গীতের মাধ্যমে গ্রাম ও নগরের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন করতে চেয়েছেন তিনি। তিনি একাধারে নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। ‘গান গেয়ে নয়, গান জড়িয়ে’ বেঁচে থাকার গল্প শোনালেন এই গুণীজন গত শনিবারের অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন আমাদের দেশ থেকে ধানের বীজ হারিয়ে যাচ্ছে। হাইব্রিড ধানের চাষ হচ্ছে। শুধু ধান না, আমাদের দেশ থেকে গানের বীজও হারিয়ে যাচ্ছে। লোকসঙ্গীত আমাদের কাছে আটপৌরে মায়ের মতো। হলুদের দাগ লাগা, ঘরে কাঁচাশাড়ি পরা মা। ঘরে দামী তোয়ালে থাকলেও খাওযার পর মুখ মোছার জন্য?মায়ের আঁচলের পেছনে আমরা দৌড়াতাম। তার এই আটপৌরে রূপটাকেই রক্ষা করতে হবে। মাকে জিনস পরিয়ে, টপ পরিয়ে, গায়ে বিদেশী সুগন্ধি লাগিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় বেঁচার জন্য, ওটা করা যাবে না। বীজ রক্ষা করতে হবে। আজ থেকে ৪০ বছর পর কেউ যদি কাজ করতে চায় লোকসঙ্গীত নিয়ে, তার হাতে যদি আমরা হাইব্রিড বীজটা ধরিয়ে দিই, চারা বের হবে না। তাই গানের মূল বীজটাকে রক্ষা করতে হবে। এটা একটা নাগরিক দায়। এটা শিল্পীরা করতে পারবে না। এটার জন্য প্রযুক্তি লাগে, প্রতিষ্ঠান লাগে। আমি এ কারণেই লালন একাডেমি তৈরি করেছি। সেখানে ১৫ হাজান গান আমরা ডিজিটালাইজড করেছি। একেবারে মাঠে ময়দানে, মেলা থেকে সংগ্রহ করেছি। সারা পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে চাইলে আমরা তা পাঠিয়ে দিতে পারি। ‘লোক সংস্কৃতির মূলভিত্তি লালনের গান, হাছনের গান, রাধারমনের গান; এগুলোকে এখন বাজারে পণ্য হিসেবে মোড়কে বন্দী করে হাজির করানো হচ্ছে। লোক সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে না পারলে নাগরিক সংস্কৃতিটাও থাকবে না। শেকড়টা নষ্ট হয়ে গেলে শরীরটাও নষ্ট হয়ে যাবে।’ গান বদলের পক্ষে থাকলেও বিকৃতির ঘোর বিরোধী তিনি। ‘মাকে শাড়ির বদলে জিন্স আর টপস পরিয়ে’ বাজারে তোলাকে ‘অনাচার’ বলেন তিনি। বাংলাদেশকে লোক সংস্কৃতির ‘হেড অফিস’ অভিহিত করে শুভেন্দু বলেন, ‘এটি বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি, যা লড়াই করে অর্জন করেছে, কেউ দয়া করে দেয়নি। ভাষাকে সামনে রেখে, সংস্কৃতিকে সামনে রেখে লড়াই করেছে। লোক সংস্কৃতির মূল শেকড়টা বাংলাদেশেই থাকবে। মননে, বুদ্ধি, সৃজনশীলতায়, দেশপ্রেমে বাঙালী সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠী।’ শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখি ৩২ কোটি বাঙালীর সঙ্গে কুটুম্বিতা করতে। বাংলার সংস্কৃতি সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত। সেটা সমগ্র জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে। এখন আমাদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য একটা ভূমি প্রয়োজন। তবে সেটা রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে। আকাশ আছে, সেটিও রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভেতর। তবে মহাকাশ আলাদা। সেখানে কারও মালিকানা নেই। বাঙালীকে সেই মহাকাশে জায়গা নিতে হবে। জায়গা নিয়ে বিশ্বের সব বাঙালীকে ওয়েব দুনিয়ার মধ্যে একত্রিত করতে হবে। একটা গানের টিভি চ্যানেল করতে হবে। এরজন্য সব বাঙালী যদি ১০ টাকা করেও দেয়, তবু ৩২০ কোটি টাকা। এটা হয়ত অসম্ভব, তবে আমি স্বপ্ন দেখি। এটা আমার উজ্জীবনী মন্ত্র, যা আমার শক্তিকে জাগিয়ে দেয়, আমার শক্তি সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেয়।
×