ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উকশার মরণফাঁদ ॥ ২৮ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৮ জুলাই ২০১৯

উকশার মরণফাঁদ ॥ ২৮ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৮ জুলাই দিনটি ছিল বুধবার। এই দিন কুমিল্লায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বিজনা ব্রিজ পরিদর্শনে এলে মুক্তিবাহিনীর কামান গর্জে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা অবস্থান পরিত্যাগ করে কায়েম গ্রামের দিকে পলায়ন করে। এই অভিযানে পাকবাহিনীর ৩ জন সৈন্য নিহত ও ৭ জন আহত হয়। হোমনা থানার ঘাঘুটিয়া লঞ্চঘাটে সুবেদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের একটি টহলদার লঞ্চকে এ্যামবুশ করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে এক ঘণ্টাব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। পরে পাকসেনারা লঞ্চ নিয়ে পলায়ন করে। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনী বেশ ক্ষতির শিকার হয়। এদিন ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ থানার উকশা সীমান্তে ইছামতির তীরে পাকবাহিনীর উকশা ঘাঁটির কাছে একটি খুঁটিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে চারপাশে এন্টি পারসনাল মাইন পুঁতে নিকটবর্তী ধানক্ষেতে ওঁত পাতে। পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য পাশ দিয়ে যাবার সময় পতাকাটি দেখতে পেয়ে তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠে এবং পতাকাটি নামানোর জন্য অগ্রসর হয়। এতে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটে এবং পাকসেনাদের সবাই নিহত হয়। পরে ক্যাপ্টেন হুদা পাকসেনাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র উদ্ধার করে দলের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। ৬ নং সেক্টরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সুবেদার হাফিজের কোম্পানির প্রধানপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া ও নুনিয়াপাড়া অবস্থানের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। আক্রমণ শেষে পাকসেনারা চাওই নদীর তীরে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়। পাকহানাদারদের এ আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বেশ ক্ষতি হয়। এদিন সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুরে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের পর পাককমান্ডার গুল মোহাম্মদের শিরচ্ছেদ করা হয়। বায়রার দক্ষিণ অংশে বিজনা ব্রিজে শত্রুদের অবস্থানে মর্টার দিয়ে গোলা বিনিময় করা হয়েছে। শত্রুদের ১০ জন সেনা আহত হয়েছে এবং ৩ জন নিহত হয়েছে। বিধ্বংস্ত ব্রিজের কাছে সালদানন্দী পুলিশ স্টেশনে শত্রুর অবস্থানে হামলা, ২ জন নিহত হয়। হরিমঙ্গলে ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২০ ফুট প্রস্থের একটি ব্রিজের দুই পাশ উড়িয়ে দেয়া হয়। আনন্দপুরের কাছে শত্রুদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আক্রমণ করা হয়। এ আক্রমণে ৩ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। সিনেটর জে. ডব্লিউ ফুলব্রাইট মার্কিন সিনেটে বলেন, যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমঝোতা হচ্ছে এবং ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গৃহীত না হবে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখা উচিত। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এ্যালেক ডগলাস হিউম লন্ডনে বলেন, পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনসাধারণ যে ধরনের রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে উদগ্রীব তা একমাত্র পাকিস্তান সরকারই করতে পারেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সাহায্য পাঠানোর আগে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠা অবশ্যই প্রয়োজন। সামরিক প্রশাসন দিনাজপুর জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমে ঘোষণা করে : যারা বাড়িঘর ত্যাগ করেছে, তারা যদি আর একদিনের মধ্যে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে না আসে তবে মালিকানা বাজেয়াপ্ত করা হবে। দিনাজপুরে সামরিক শাসক পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করে। এই সময়ের মধ্যে কাউকে ঘরের বাইরে কিংবা রাস্তায় পাওয়া গেলে গুলি করার হুমকি দেয়া হয়। সিনেটর ফুলব্রাইট বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সিনেটে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের ভয়ানক পুনরাবৃত্তি শুধু গুরুতর অপব্যবহারই চিহ্নিত করে না যার সঙ্গে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা সম্পৃক্ত। মার্কিন সামরিক সহায়তা ছিল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় পাকিস্তানকে সজ্জিত করা। যা পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং পরবর্তীকালে গণতন্ত্রের দিকে ধাবমান পাকিস্তান নিজের দুর্বল পদক্ষেপকে দমন করতে। মার্কিন সহায়তার এই স্বেচ্ছাচারিতা সত্ত্বেও আমরা বিস্মিত যে- সামরিক পণ্যের চালান এখনও চলমান, দৃশ্যত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর ভ্রান্ত প্রভাব বা ‘লিভারেজের’ কারণে। এই বেদনা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ প্রশাসন ফরেন রিলেশনস কমিটিকে আশ্বস্ত করেছে যে, ২৫ মার্চ থেকে কোন সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে চালান হয়নি এবং তা সরবরাহের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। উদীয়মান প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারকে ধ্বংস এবং নির্মম সামরিক অভিযানের মুখে- যা প্রধানত হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও বাঙালী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, শত হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তথাপিও আমরা পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সমর্থন করি। আরও সাহায্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ও বিশ্বের অন্যান্য দাতা দেশগুলোর বিপরীতমুখী মনোভাবের মুখে এই সমর্থন চলমান রয়েছে। তবে, গৃহযুদ্ধে জড়িত একটি সরকারকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করা অপর পক্ষকে হস্তক্ষেপের শামিল। ভারত কোনক্রমেই শরণার্থীদের পণ্যদ্রব্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যাপক চাহিদার এই বোঝা বহন করতে পারবে না। এই পরিস্থিতি সহজেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্রুততর বিপ্লবী কার্যকলাপকে পুনরায় ত্বরান্বিত করতে পারে যা ভারতের নিজেদের ভবিষ্যতের প্রতি বা আরেকটি ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটনের হুমকি বহন করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীরা উভয়েই একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানে একমত না হওয়া পর্যন্ত এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করা উচিত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের চালানো গণহত্যার ব্যাপারে অনেকটাই জানা গেছে। তাদের কার্যক্রম এতোই নিখুঁত ছিল যে, হিটলার বেঁচে থাকলে তাঁর আধুনিক শিষ্যদের পদ্ধতিতে কোন কিছুর কমতি খুঁজে পেতেন না। সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা পৌনে এক লাখের মতো। জীবন-সম্ভ্রম বাঁচাতে সত্তর লাখ পূর্ব বাঙালীকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। সারা বিশ্বের সামনে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা এক কলঙ্কের নাম। এর পরেও, জনগণকে ধোঁকা দিতে, পূর্ব বাংলায় সবকিছু স্বাভাবিক আছে, এমন দাবি করছে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা, তারা উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি, ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য অভ্যর্থনাকেন্দ্রও খোলা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র সানডে টাইমস এর একজন প্রতিনিধি সম্প্রতি এ রকম একটি কেন্দ্র থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন, পাঁচটি বেওয়ারিশ কুকুর ছাড়া কেন্দ্রটিতে আর কেউ নেই। গত কয়েক সপ্তাহে, ব্রিটেন, কানাডা, আয়ারল্যান্ড থেকে সংসদীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলা সফর করেন। সেখানে আতঙ্কের পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলেই তাঁদের সবার মনে হয়েছে। নাৎসীদের কাছ থেকে ইসলামাবাদের শাসকরা গণহত্যার পদ্ধতি ছাড়া আরও অনেক কিছুই শিখেছে বলে দেখা যাচ্ছে। সেন্সরশিপ থাকা সত্ত্বেও যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, পূর্ব বাংলায় পুলিশি রাজ কায়েম হয়েছে। পূর্ব বাংলা এখন এক আতঙ্কের উপত্যাকা, যেখানে জার্মান গেস্টাপো কায়দায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সরকারী অফিসে এখনও যেসব কর্মকর্তা আসছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রশ্নমালা জারি করা হয়েছে। যেসব প্রশ্নের উত্তর বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে একটি : আপনি কি আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন? আরেকটি : আপনি কি বাঙালী? এ কী ধরনের অন্যায়! লস এ্যাঞ্জেলস টাইমসের প্রতিনিধি জ্যাক ফয়সির (ঔধপশ ঋড়রংরব) কাছ থেকে পূর্ব বাংলায় পরিস্থিতির একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। তিনি জানাচ্ছেন, ঢাকা এখন এক ভয়ের নগরী। রাতের বেলায় রাস্তায় রাস্তায় ভুতুড়ে শূন্যতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যা নামলেই লোকজন বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে; যদি আত্মীয়-স্বজনের বাড়ির দরজা-জানালা-দেয়াল শক্তপোক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। ফয়সি জানাচ্ছেন, ‘কোনমতে শাকসবজি, অথবা একটু মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েই তাড়াতাড়ি তেলের বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়, দরজা আটকে দেয়া হয়। এ রকম একটা ধারণা বিরাজ করছে যে, অন্ধকার বাড়িঘরে কর্তৃপক্ষ আসার সম্ভাবনা কম।’ গোপন আলোচনায় এ আতঙ্কের কারণ হিসেবে বেশ কয়েকজনই তল্লাশিকে চিহ্নিত করেছেন। প্রতিনিধি আরও বলেন, ‘রাতের বেলায় ঘরে ঘরে দরজায় কড়া নেড়ে একই কাজ করা হয়। কোথায় বিদ্রোহীরা রয়েছে সে তথ্য জানা, পিঠ বাঁচাতে ইচ্ছুক লোকদের চর হিসেবে দলে নেয়া, অথবা বাড়ির নারীদের শ্লীলতাহানি করা; অথবা ভয় দেখানোর জন্যই আসা; অথবা মুচলেকা আদায় করা।’ তিনি একজন বাঙালী ব্যাংকার ঘটনা বলেন, যাঁকে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সামরিক কর্মকর্তাদের থেকে নিজের ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ফয়সি লিখেছেন, ‘কখনও কখনও পুরুষদের অস্ত্রের মুখে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, আর নারীরা আহাজারি করতে থাকে। কেউ কেউ আহত অবস্থায় ফেরে, কেউ কেউ ফেরে না।’ সেনা কর্তৃপক্ষ ও তাদের পোষ্য স্থানীয় মিলিশিয়াদের সহায়তায় গঠিত তথাকথিত শান্তি কমিটিও জনগণকে আতঙ্কিত করার আরেকটি উপায়। বিবিসি লন্ডন টাইমসের মার্ক টালি বলেন, স্থানীয় মিলিশিয়ারা মূলত মাস্তান, যারা এ সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে বেড়াচ্ছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×