ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জাস্টিস ডিলেইড নট ডিনাইড

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ৬ জুলাই ২০১৯

জাস্টিস ডিলেইড নট ডিনাইড

জাস্টিস ‘ডিলেইড’ হলেও সবসময় সবক্ষেত্রে ‘ডিনাইড’ হয় না- Victory, at the end of the day comes down in favour of truth. এরই নাম সেই মহাজনী প্রবাদ- You can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time’ একদিন না একদিন তা ঐশী বাণীর মতো সামনে আসবেই। এমনিভাবে ২৫ বছর অপেক্ষার পর ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে বহনকারী ট্রেনে সশস্ত্র হামলা গুলি-বোমা বিস্ফোরণ মামলার বিচার হলো। অর্থাৎ বিচারের রায় হলো গত ৩ জুলাই। পাবনার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ৩-এর মাননীয় বিচারক রুস্তম আলী তার রায়ে শেখ হাসিনাকে ‘এটেম্পট টু মার্ডার’ ও সশস্ত্র হামলার দায়ে ৯ অভিযুক্তকে মৃত্যুদন্ড, ২৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং আরও কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদন্ড দেন। সেই সঙ্গে অর্থদন্ড, অনাদায়ে আরও সাজা ভোগ করতে হবে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৯ জন হলেন এ কে এম আখতারুজ্জামান ( ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাবেক প্রেসিডেন্ট), জাকারিয়া পিন্টু (স্থানীয় বিএনপির সাধারণ সম্পাদক), মুখলেসুর রহমান বাবলু (সাবেক সাধারণ সম্পাদক), রেজাউল করিম শাহিন (ছাত্রদলের সাবেক নেতা), আজিজুর রহমান শাহিন (ঈশ্বরদী উপজেলা যুবদল আহ্বায়ক), স্থানীয় বিএনপি কর্মী শহীদুল ইসলাম শ্যামল, মাহবুবুর রহমান পলাশ এবং শামসুল আলম। সবাই বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মী। তাদের মধ্যে জাকারিয়া পিন্টু আত্মগোপনে রয়েছেন। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরাও বিএনপির নেতা-কর্মী। এ ঘটনা বিএনপির জঘন্য কুৎসিত চেহারাটা উন্মোচিত করে দিল। অবশ্য বিএনপি রায়ের পর তাদের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সবকিছু অস্বীকার করা এবং উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর তত্ত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন- ‘মামলাটিই মিথ্যে। আওয়ামী লীগের লোকেরাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর লক্ষ্যে।’ মীর্জা ফখরুলের বিবৃতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় যেভাবে এসেছে (৪ জুলাই ২০১৯)- “Condemning the verdict, he (Mirya Fukhrul) Said the 1994 incident of attack on shaikh Hasina in iswardi was fake and fabricated! The attack was staged by AL men to Create a political issue. The verdict proves that the government is trying to put dedicated BNP leaders on gallows. এই ধরনের মিথ্যে বলা বিএনপির নতুন কিছু নয়। তারা এই ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাবে আর সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে ভিকটিমরাই সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ঘটিয়েছে। (অবশ্য এটাও ঠিক তাদের কৌশল কিছু অবাঞ্ছিত আওয়ামী লীগ নেতাও অবলম্বন করে। যখন দেখে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছে না তখন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের আশ্রয় নেয়। নিজেরা হামলা চালায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভিকটিমদের আসামি করে থানায় মামলা দেয়। তাদের এই কর্মকান্ডের কারণে বিএনপির ডাহা মিথ্যাও মানুষ বিশ্বাস করে। অবশ্য কিছু ২য়-৩য় শ্রেণীর নাগরিকও আছে তারা বিশ্বাস করে খালেদা ভাল মানুষ, এতিমের টাকা চুরি করেননি, কালো টাকা সাদা করেননি, দুর্নীতি করেননি। একইভাবে ওই ২য়-৩য় শ্রেণী মনে করে তারেক বিরাট নেতা, হাওয়া ভবন-খোয়াব ভবন লুটপাট এবং অপকর্মের আখড়া ছিল না, সে কোন দুর্নীতি করেনি, লুটপাট করেনি। ২য়-৩য় শ্রেণী কেন, লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার হয়ে আসা এমপিও বিশ্বাস করে না। তারেক যে হাওয়া ভবন-খোয়াবভবন বানিয়েছে এটাও কিছু বেকুব বিশ্বাস করে না।) অবশ্য তাদের দোষ দেব না। তারা একাত্তরের শান্তি কমিটি, রাজাকার-আল-বদর-আলশামস প্রজন্ম। এরা এতদিনেও যখন তাদের মনোজগত থেকে পাকিস্তান-পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তা ধুয়ে-মুছে ফেলতে পারেনি, আর কোনদিন পারবেও না। বিএনপির মিথ্যের কিছু নমুনা তুলে ধরতে চাই : ক. ঈশ্বরদীর ঘটনাটি ঘটেছে ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। তখন ক্ষমতায় খালেদা জিয়া। এ সম্পর্কে বিএনপি কি বলেছে তা মীর্জা ফখরুলের বিবৃতিতে তুলে ধরেছি। এখানে পুনরাবৃত্তি করলাম না। খ. ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন সিরিজ অব গ্রেনেড হামলা ও গুলিতে কেন্দ্রীয় নেতা আইভি রহমান, সবার পরিচিত মুখ আদা চাচাসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন তিন শতাধিক। দু’টি ঘটনাই এক- আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। তারপর দুই অশিক্ষিত-অযোগ্য-দুর্র্নীতিপরায়ণ মা-বেটা সন্ত্রাস চালিয়ে বাংলাদেশ শাসন করবে। জিয়া মিলিটারি এ্যাকশন করে জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিল। আর খালেদা-তারেক শেখ হাসিনাকে হত্যা করে রাজত্ব করতে চেয়েছে। তবে দুটি ঘটনার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে- ‘ঈশ্বরদীতে হামলা চালানো হয় দলীয় নেতা-কর্মীদের (সশস্ত্র) সরাসরি এ্যাকশনে নামিয়ে আর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে নামিয়ে। এ ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খুনীদের নামানো হয় পাকিস্তানী আর্জেস গ্রেনেড হাতে দিয়ে।’ কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে?- Man posseses God disposes. শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজকের যে বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বের বিস্ময় এবং শেখ হাসিনা অল্প ক’জন সৎ, সফল, সাহসী, দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তাবৎ দুনিয়ায় অনুসরণীয় অনুকরণীয়-হয়তো এ জন্যও আল্লাহ পাক তাকে রক্ষা করে চলেছেন। ইনটারেস্টিং ব্যাপার হলো ঈশ্বরদীর ঘটনা নিয়ে মীর্জা ফখরুল যেভাবে বিবৃতি দিয়ে বললেন, সেটি আওয়ামী লীগই ঘটিয়েছে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করার জন্য। তখনও বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, ২০০৪-এর ২১ আগস্টের ঘটনার সময়ও বিএনপি ক্ষমতায় ছিল এবং তারেক রহমান সন্ত্রাসী রহমান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বললেন- ‘শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছিলেন এবং তা বিস্ফোরিত হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা বললেও বিষয়টি না-বুঝেই বলে দিলেন (অবশ্য তার বোঝার কথাও নয়। বুঝতে হলে কিছু বিদ্যে ঘটে থাকতে হয়) যে, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাতে হলে এক্সপার্ট লাগে-এমনি এমনি ফোটে না, তাও একটা নয়, দুইটা নয়, এক ডজনেরও অধিক। কিন্তু তিনি বলে দিলেন এবং একজন হোক দু’জন হোক কিছু বেকুব বিশ্বাসও করল। ঈশ্বরদীর ঘটনার পর বিচারকার্য বন্ধ করে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছিল! কিন্তু মাননীয় আদালত সে রিপোর্ট গ্রহণ না করে সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। একইভাবে গ্রেনেড হামলা মামলা নিয়েও যথেষ্ট বাইচলামি করেছিল। একবার জয়নুল আবেদীন নামে এক বিচারপতিকে দিয়ে ওয়ানম্যান তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল এবং বসংবদ সেই বিচারপতি রিপোর্ট দিলেন ‘ভারত থেকে এসে গ্রেনেড হামলা চালানো’ হয়। তাতেও যখন কাজ হলো না তখন জজ মিয়া নাটক সাজানো হলো। কিন্তু বিএনপিপন্থী কিছু বেকুব ছাড়া ১৭ কোটির আর সবাই যে সচেতন নাগরিক তা খালেদা-তারেক বুঝতেই পারেনি। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, জনগণ এর কোনটাই বিশ্বাস করেনি, বরং বিএনপি নেত্রীর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে। তবে ঈশ্বরদীর মামলার রায়ের পরদিন ৪ জুলাই ২০১৯ দেশের একাধিক পত্রিকায় যেভাবে খবরটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে তাতে মনে হবে বিএনপি বলেই তাদের ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়েছে, গুলিবর্ষণকারী ক্রিমিনাল হিসেবে নয়। যেমন শিরোনাম : ১. দৈনিক প্রথম আলো, শিরোনাম-‘বিএনপির ৯ জনের ফাঁসি, ২৫ জনের যাবজ্জীবন’ ছোট করে নিচে ‘শেখ হাসিনার ট্রেনে হামলা’। এবং পত্রিকাটি খবরটি ছেপেছে ৪-এর পাতায়। ২. দৈনিক সমকাল, শিরোনাম-‘বিএনপির ৯ নেতা-কর্মীর মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন ২৫’ শোল্ডারে ছোট করে ‘ঈশ্বরদীতে শেখ হাসিনার ট্রেনে হামলা’। তবে এই পত্রিকায় প্রথম পাতায় খবরটি ছেপেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৬ বছর শেখ হাসিনা দেশে আসতে পারেননি। মিলিটারি জিয়া আসতে দিচ্ছিলেন না। অবশেষে ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সেই বছরের ১৭ মে সকল বাধাকে তোয়াক্কা না করে দেশে ফিরে আসেন। সেদিন তৎকালীন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পথে পথে এবং সমাবেশে অর্ধকোটিরও অধিক লোক সারাদেশ থেকে ঢাকায় আসে প্রিয় নেত্রীকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু জিয়ার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারী, অর্থাৎ সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ১৯ বার তাকে হত্যার চক্রান্ত করা হয়, হামলা হয়। দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টার হিসেবে অন্তত ৯ বার হামলার সময় তার সঙ্গে ছিলাম। দেখেছি হামলার ধরন কী ভয়াবহ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, ঈশ্বরদী, রাসেল স্কোয়ার, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জামালপুর, সিলেট, কোটালিপাড়া, এমনকি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনেও তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। একটি চক্রান্তের চিত্র তুলে ধরে এ লেখার সমাপ্তি টানতে চাই। সেদিনও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারিখটি ২০০০ সালের ২০ জুলাই। শেখ হাসিনা কোটালিপাড়া শেখ লুৎফর রহমান কলেজের (কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাড়ির পাশে) অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টারে করে কলেজের অদূরে নতুন করে বানানো হেলিপ্যাডে নামেন। আমরা সাংবাদিকরা ছিলাম অপর একটি হেলিকপ্টারে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি যেখানে নামে তার পাশেই ২/৩ ফুট অদূরে একটি বোমা পোঁতা হয়। সেখান থেকে গাড়ি করে শেখ হাসিনার পাশে যেখানে গাড়ি থামলে পা রাখেন ঠিক সেখানেই মাটির নিচে আরেকটি বোমা পোঁতা ছিল। বোমা দুটি ৮৬ কেজি ওজনের। এগুলো বিস্ফোরিত হলে বিরাট অংশ জুড়ে বড় বড় পুকুর তৈরি হতো এবং আশপাশে মানুষ, বিভিন্ন স্থাপনা কিছুই থাকত না। এই আমি আজ বর্ণনা দিচ্ছি, আমিও এই বর্ণনা দেবার সময় পেতাম না। আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামীনের অশেষ শুকরিয়া যে, শেখ হাসিনা অবতরণের আগেই সকালে বোমা দুটি চিহ্নিত হয় এবং বিশেষজ্ঞরা তা অপসারণ করে ফেলেন (আল্লাহ্্র কৃপা না হলে এগুলো ডিকেক্টই হতো না। শেখ লুৎফর রহমান কলেজের পাশে যেখানে শেখ হাসিনার গাড়ি থামে তার পাশে একটি খাল এবং খালের ওপারে একটি চা-স্টল। চা-স্টলের এক কিশোর কর্মচারী কাপ-পিরিচ ধোয়ার জন্য খালে অস্থায়ী ঘাটে নামলে একটি তার পানির নিচ দিয়ে এসে মাটির নিচ দিয়ে চলে গেছে দেখতে পায়। সে তার মালিককে বললে তিনি তারটির পানির নিচের অংশ তুলে দেখেন দুই পাড়েই তার মাটির নিচ দিয়ে চলে গেছে। তিনি পুলিশে খবর দেন এবং বোমাটি উদ্ধার করেন। হেলিপ্যাডেরটিও। এভাবে আল্লাহ্্ পাক সেদিন শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। আল্লাহ পাকের অশেষ শুকরিয়া। ঢাকা- ৫ জুলাই ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় সংসদ সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য, সাবেক সভাপতি ও সাঃ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব। [email protected]
×