ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর বিলেত সফর

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১২ মে ২০১৯

 বঙ্গবন্ধুর বিলেত সফর

আমার জানামতে বঙ্গবন্ধু মোট আটবার বিলেত সফর করেন। এর মধ্যে প্রথম সফর করেন ১৯৫৬ সালে। শেষ সফর ১৯৭৫ সালে। এ ছাড়া তিনি সফর করেন ১৯৫৮, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৯, এবং ১৯৭২ সালে। তাঁর সকল সফরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন সফর ছিল অনন্য। এই সফর নিয়ে পরে আলাদাভাবে বিস্তারিত লেখা হবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দী ১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এ মাসেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে যোগদানের জন্য সুইডেনে যান। সেবার দেশে ফেরার পথে লন্ডনে তিনি কিছুদিন অবস্থান করেন। এটাই ছিল তাঁর প্রথম বিলেত সফর। তিনি প্রবাসী বাঙালী আব্দুল মান্নানের দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের ২৯ সেন্ট মেরি এ্যাবোটস ট্যারাস এ আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এর আগে ১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানীও লন্ডনে প্রায় আট মাস নির্বাসনে থাকাকালে এখানেই অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি প্রবাসী বাঙালীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলেন। এ বাড়িতে বসেই তাঁর বিখ্যাত বই ‘ভাসানী যখন ইয়োরোপে’ রচনা করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসে মার্কিন লিডারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকার বিভিন্ন শহর সফর করেন। তিনি সেখানে প্রায় দুই মাস ছিলেন। শিক্ষানুরাগী বঙ্গবন্ধু তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও ভ্রমণ করেন এবং সেখানে অধ্যয়নরত মুনীর চৌধুরীকে (১৯৭১ সালে শহীদ) দেখতে যান। দেশে ফেরার পথে আবারও লন্ডনে কিছুদিন অবস্থান করেন। সেবারও তিনি আব্দুল মান্নানের দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের সে একই বাসায় অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আব্দুল মান্নানকে সিলেট থেকে এমপি বানিয়ে ছিলেন। ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে জেনেভা থেকে হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লন্ডন এসে পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ারর্দীর উত্তর লন্ডনের হ্যামস্টিডের ভাড়া করা বাসায় অবস্থান করেন। তিনি সেখানে প্রায় ছয় মাস ছিলেন। রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু সে বছরই অর্থাৎ ১৯৬৩ সালের ৮ আগস্ট ঢাকা থেকে করাচী হয়ে লন্ডন আসেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য ১৯৬২ সালে নুরুল আমিনকে নিয়ে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) নামে যে ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল এর বদলে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সভাপতি শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রস্তাব করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাতে রাজি হননি এবং এনডিএফের কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। এতে বঙ্গবন্ধু মনোক্ষুণ্ণ হন এবং তিনি ২৮ আগস্ট পর্যন্ত লন্ডন অবস্থান করে দেশে ফিরে যান। সেবার তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথাও বলেন এবং জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারলে অস্ত্র ছাড়াই শুধু বাঁশের লাঠি দিয়ে দেশ স্বাধীন করতে পারবে বলে শহীদ সাহেব কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে বলেন ‘তুমি তৈরি করবে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা! আছে কি তোমার যে দেশ স্বাধীন করবে? কোরিয়ায় তোমার পাটের চাহিদা আর নাই’। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডন থেকে বৈরুত যান এবং ৫ ডিসেম্বর সেখানেই শাহাদাতবরণ করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শাহাদাতের পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করেন এবং এর পরের মাসেই অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও লন্ডন সফর করেন। এবার তিনি বিলেতে বাঙালীদের সংগঠিত করার প্রয়াস নেন। ততদিনে প্রবাসী বাঙালীদের দ্বারা লন্ডনের ইজলিইংটনে ‘ইস্ট পাকিস্তান ভবন’ তৈরি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বায়ত্তশাসনসহ অন্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি এ ভবন পরিদর্শন করেন এবং খুবই খুশি হন। এ ভবনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত অনেকেই পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্পীকার, মন্ত্রী, বিচারপতি, মেয়রসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে বিলেতে এক শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে উঠে। এ মামলায় লড়ার জন্য বিলেত প্রবাসী বাঙালীরা ‘শেখ মুজিব ডিফেন্স ফান্ড’ গঠন করে এবং চাঁদা তুলে লন্ডনের বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার থমাস ওয়েলিয়ামকে পূর্বপাকিস্তান পাঠায়। এতে তখন সালাম খানসহ দেশের বিখ্যাত আইনজীবীরা এই মামলায় সম্পৃক্ত হতে আগ্রহ দেখান। এতে মামলা গতি পায় এবং দেশে-বিদেশে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু খালাস পান ও আইয়ুব খানের পতন ঘটে। সংগ্রামী জনতা তখন তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। বিলেত প্রবাসী বাঙালীরা এ উদ্যোগ না নিলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ত বা অন্যভাবে লেখা হতো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভের পর বিলেতপ্রবাসী বাঙালীদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর লন্ডন সফর করেন। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে হাজারো বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায় এবং মাল্য ভূষিত করে। এর আগে কখনও বিদেশী কোন নেতাকে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ এই ব্রিটিশ বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে দেখেনি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ, মশিউর রহমান জাদু মিয়া (পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী) এবং তার ছেলে শফিকুল গণি স্বপন, বিচারপতি আবু সাইয়িদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, তসাদ্দুক আহমেদ, গউস খান, মিনহাযুদ্দিন, সুলতান শরীফসহ অনেকে। সেবার তিনি লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মাউন্ট রয়াল হোটেলে অবস্থান করেন। ১ নবেম্বর ১৯৬৯ পূর্ব লন্ডনের ‘গ্র্যান্ড প্যালাস’ হলে প্রায় হাজার বাঙালীর উপস্থিতিতে তাঁর সংবর্ধনায় তাকে মুক্তিতে সাহায্য করার জন্য তিনি বিলেত প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়ার কারসাজিতে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে দাঙ্গা মোকাবেলার জন্য স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার টেলিফোন নির্দেশে সফর সংক্ষিপ্ত করে ৭ নবেম্বর কন্যা শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ঢাকা ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার আগে তিনি নেতৃস্থানীয় বাঙালীদের যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের শাখা গঠনের জন্য অনুরোধ করে যান এবং এরই সঙ্গে ১৯৭০ সালের অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে সাহায্য সহযোগিতা কামনা করেন। এর কিছুদিন পর যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের শাখা গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু নিজেই এর অনুমোদন দেন। বিলেতে বঙ্গবন্ধুর পরের সফর হলো ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। সদ্য স্বাধীন দেশে সংগ্রামী জনতা যখন বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অত্যন্ত আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তখন হঠাৎ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ভোর বেলা পিআইএ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এর আগেই ভোর রাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা কর্মকর্তা পিঁটার লেংলী টেলিফোনে মুক্তিযুদ্ধের স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শেখ মান্নানকে জানান, তোমাদের বঙ্গবন্ধু লন্ডন আসছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অনুপস্থিতে মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান রেজাউল করিম এবং কূটনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ব্রিটিশ সরকারের ফরেন এ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সাউথ এশিয়া বিভাগের মন্ত্রী ইয়ার সাদারল্যান্ড ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। রেজাউল করিম এবং কূটনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ গাড়ি চালিয়ে বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনের বিখ্যাত ক্লারিজেস হোটেলে নিয়ে আসেন। তখন ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানগণ লন্ডন এলে সাধারণত এ হোটেলেই অবস্থান করতেন। মুহূর্তের মধ্যেই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। হাজার হাজার বাঙালী হোটেলের চার পাশে অবস্থান নেন এবং মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। হোটেলের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু হাত নেড়ে জনগণকে অভিবাদন জানান। ইতোমধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর কথা হয়। একটু পরেই বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর রুমে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমাকে আমি চিনি। তোমার জন্য আমি কি করতে পারি। ডেভিড ফ্রস্ট বলেন কিছুই না। শুধু একটি ইনটারভিউ দিতে হবে। টেলিভিশান ক্যামেরা এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি সব আপনার রুমেই নিয়ে আসা হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার প্রথম ইন্টারভিউ হবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। ইন্টারভিউয়ের জন্য তোমাকে বাংলাদেশে আসতে হবে। কথা দিচ্ছি বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে তোমাকেই আমি প্রথম ইনটারভিউ দেব। তবে তার আগে আমার প্রথম সাক্ষাতকার হবে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন এবং ডেভিড ফ্রস্টকে পরে সেই ইনটারভিউ দিয়েছিলেন। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতকারের জন্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। সেখানে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। এর উত্তরে মি. হীথ বঙ্গবন্ধুকে বলেন, প্রটোকল অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারকে প্রথম দেখতে হবে নতুন সরকার পূর্ণ কৃতিত্বের অধিকারী কিনা অর্থাৎ তিনি তখনও পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু প্রথম সাক্ষাতেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতীয় সৈন্যদের কবে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হবে বলে জানতে চান এবং এর উপর ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি নির্ভর করবে বলে জানান। ব্রিটেনের স্বীকৃতি পেলে অন্যা কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর স্বীকৃতিও সহজ হবে বলে বিবেচিত হয়। এদিকে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি দানের জন্য কমনা করছিলেন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের দেয়া বিশেষ বিমান ‘কমোটে’ করে স্বদেশের পথে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে সাইপ্রাসের ব্রিটিশ বিমান ঘাঁটি থেকে জ্বালানি নিয়ে দিল্লীতে অবতরণ করেন। দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরিসহ বিপুল জনতা তাঁকে স্বাগত জানায়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় ‘কমোটে’ করেই বঙ্গবন্ধু স্বদেশের পথে ঢাকায় যাত্রা করেন যদিও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে দেশে পাঠাতে চাচ্ছিল। ঢাকায় সদ্য স্বাধীন দেশে লাখো কোটি জনতা বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানায়। চিকিৎসার জন্য ১৯৭২ সালের জুলাই মাসের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু আবারও লন্ডন আসেন। ৩০ জুলাই বিখ্যাত হারলি স্ট্রিটের লন্ডন ক্লিনিকে বঙ্গবন্ধুর দেহে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার করেন বিখ্যাত ডাঃ স্যার ফিডেরিক মাইয়ারস। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার ডগলাস হিউম ও প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ আলাদাভবে ক্লারিজেস হোটেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ও তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন। তখন তিনি অসুস্থ শরীরেই ব্রিটেনের সাহায্য সহযোগিতা কামনা করেন বিশেষ করে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে সহায়তার জন্য। ক্লারিজে সে সময় ভুট্টো ফোন করে আবারও কনফিডারেশনের প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করে এসব ভুলে অবিলম্বে আটকে পরা বাঙালীদের ফেরত দিতে ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বলেন। লন্ডন থেকে ২১ আগস্ট সুইস সরকারের আমন্ত্রণে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি জেনেভায় যান। সঙ্গে ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ রাসেলসহ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা ও কিছু বেসরকারী লোকজন। যাবার সময় বঙ্গবন্ধু লন্ডনপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল মতিনকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে জামাইকার কিংস্টনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে কিছুক্ষণ লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। বিবিসিসহ বেশ কিছু সাংবাসিক তখন ভিআইপি লাউঞ্জে তার সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন। বিবিসির সিরাজুর রহমানও ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাকে সাক্ষাতকার দিতে রাজি না হয়ে বলেন, তুমি আমার বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণা চালাও। তোমাকে আমি সাক্ষাতকার দেব না। পরে অবশ্য সাক্ষাতকার দেন। এটাই ছিল তার সর্বশেষ বিলেত সফর। সে বছরই তিনি আগস্ট এর ১৫ তারিখ সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। জাতি হারায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীকে। লেখক : লন্ডনের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির এ্যাকাউন্টিং, ফাইন্যান্স ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান
×