ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ টুটুল চৌধুরী

যক্ষ্মা ॥ একটি সামাজিক স্বাস্থ্য সমস্যা

প্রকাশিত: ১২:৫০, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

যক্ষ্মা ॥ একটি সামাজিক স্বাস্থ্য সমস্যা

আগামী ২৪ মার্চ ২০১৯ আন্তর্জাতিক যক্ষ্মা দিবস হিসাবে পৃথিবীর সকল দেশে পালিত হয়। আমাদের দেশেও এই দিবসটি ব্যাপকভাবে পালিত হয়। বিশ্বে ২২টি অধিকতর যক্ষ্মা আক্রান্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি। যা প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যক্ষ্মা বলতে সাধারণভাবে আমরা ফুসফুসের যক্ষ্মাকেই বুঝি। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষ্মা হতে পারে। যেমন- লসিকাগ্রন্থি, হার ও অস্থি, অন্ত্র, হৃদপি-ের আবরণ ও মস্তিষ্কের আবরণ ইত্যাদি। অতীতে মানুষের যক্ষ্মা ধরা পড়লে হতাশ হয়ে জীবনযাপন করত। কারণ তখন যক্ষ্মার কোন ওষুধ ছিল না। ফলে মানুষ খুবই ভয় পেত। আজ আর সেই দিন নেই, যক্ষ্মার ওষুধ নিয়মিত খাওয়ার পর তা সম্পূর্ণরূপে ভাল হয়। যক্ষ্মা (ঞঁনবৎপঁষড়ংরং বা টিবি) একটি সংক্রামক রোগ। মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস (গুপড়নধপঃবৎরঁস ঃঁনবৎপঁষড়ংরং) নামক একটি জীবাণু এই রোগের জন্য দায়ী। যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীরা খুব রোগা হয়ে পড়েন। যক্ষ্মা রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ফুসফুস, যদিও হৃৎপি , অগ্ন্যাশয়, ঐচ্ছিক পেশি ও থাইরয়েড গ্রন্থি ছাড়া শরীরের প্রায় যে কোন অঙ্গেই যক্ষ্মা রোগ হতে পারে এমনকি কিডনি, মেরুদ- অথবা মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে। জীবাণু শরীরে ঢুকলেই কিন্তু যক্ষ্মা হয় না। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে যক্ষ্মা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাধারণত সন্ধ্যা বেলায় জ্বর আসে, খাবার খাবে কিন্তু তারপরও শুকিয়ে যাবে। কফ হবে সেই কফ আর সারবে না। সাধারণ এন্টিবায়োটিক খেলেও সারবে না। একটা সময় দেখা যাবে যে কফের সঙ্গে রক্ত আসছে। অনেক ক্ষেত্রে রক্ত নাও আসতে পারে। ওজন কমে যায়। ক্ষুধামন্দা হবে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাবে। সাধারণত এটা ফুসফুসের যক্ষ্মা। কিন্তু এছাড়া অন্য কোন যক্ষ্মার ক্ষেত্রে লক্ষণ নাও থাকতে পারে। যখন একজন রোগীর যক্ষ্মা হয় তখন তিনি বিপুল পরিমাণে টিবির জীবাণুতে আক্রান্ত হন। আমরা চিকিৎসকরা ওই সময় রোগীর দেহের সব যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংসের চেষ্টা চালাই। রক্তের পরীক্ষা, কফ পরীক্ষা, ত্বকের পরীক্ষা, বুকের এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, কালচার টেস্ট, এগুলোর মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু ক্রমান্বয়ে শনাক্ত করা হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম তাদের যক্ষ্মা হতে পারে সবচেয়ে বেশি। যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী একই প্লেটে খাওয়া-দাওয়া করলে রোগীর কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। ঘন ঘন কাশি, ৩ সপ্তাহব্যাপী অবিরাম কাশি, সন্ধ্যার সময় জ্বরজ্বর ভাব, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, কাশির সঙ্গে রক্ত আসা যদি এই সকল লক্ষণের মধ্যে দুইটি লক্ষণ দেখা দেয় তখন এই রোগীর যক্ষ্মা হতে পারে বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। কিন্তু পরীক্ষাগারে কাশি ও রক্ত পরীক্ষা না করে নিশ্চিত করে বলা যাবে না তার যক্ষ্মা হয়েছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বা এনটিপির হিসাবে ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে প্রায় ত্রিশ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে শিশু রয়েছে প্রায় বিশ হাজার। ঢাকায় আইসিডিডিআরবি সূত্রে যানা যায়, বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। কিন্তু আক্রান্ত অনেক রোগী ওষুধের ফুল কোর্স সেবন না করায় পরিণত হচ্ছেন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীতে। অর্থাৎ তখন তাদের জন্যে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত চিকিৎসার। যক্ষ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী মানুষ যক্ষ্মায় বেশি আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুনভাবে প্রতি লাখে প্রায় ২২৫ জন লোক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয় এবং ৪৫ জন লোক মারা যায়। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যক্ষ্মা রোগের ভয়াবহতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতায় জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী শুরু করেছে এবং সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বিত করা হয়েছে। বর্তমান সরকারী ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। কেন্দ্র্রীয় ঔষধাগার থেকে উপজেলা হাসপাতাল পর্যন্ত যাবতীয় ওষুধ সঠিক সময়ে জরুরীভাবে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই ব্যাপারে কোন অবহেলা বা অনিয়ম অথবা সময়ক্ষেপণ করাই যাবে না। সারাদেশে যতগুলো বেসরকারী সংস্থা যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচীর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের চিকিৎসাকেন্দ্র্র এবং কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তারের নাম এবং তাদের শিডিউল সকল ইউনিয়ন পরিষদের নোটিস বোর্ডে টাঙ্গানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যৌথ চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে অনেক সময় চিকিৎসক পাওয়া যায় না বিধায় রোগীরা আস্থা হারিয়ে বিব্রতবোধ করেন যার ফলে ব্যাঘাত হয় চিকিৎসার ওষুধ অকার্যকারী যক্ষ্মা শনাক্তের বাইরে থাকা যক্ষ্মা রোগীরা কিংবা যারা চিকিৎসা পুরোপুরি শেষ করেন না তাদের কারণে বাংলাদেশে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি। অর্থাৎ সাধারণ চিকিৎসা তাদের জন্য আর কার্যকর থাকছে না, শনাক্ত করার পর তাদের জন্য প্রয়োজন হয় আরও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার- এমনটাই মনে করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। যদি যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ফলোআপ না করা হয় তাহলে জ্যামিতিক হারে এমডিআর টিবির রোগীর পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা অদূর ভবিষ্যতেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ডটস পদ্ধতি টিবি রোগের কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছেÑ ডট পদ্ধতি, এই পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর রোগ নির্ণয় করা হয় এবং চিকিৎসা দেয়া হয়। যদি কোন রোগী ট্যাবলেট খেতে ভুলে যায় তা মাঠকর্মীরা রোগীর বাড়িতে গিয়ে ট্যাবলেট খাইয়ে দেন। ৬ থেকে ৮ মাস চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ইহা একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি চালু করা হয়েছে ডট পদ্ধতিই হচ্ছেÑ সবচেয়ে কম খরচে চিকিৎসা যা উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব উপযুক্ত। শত ভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে যা থাকতে হবে তা হলো সরকারের রাজনৈতিক আন্তরিকতা যা বর্তমান সরকারের আছে। উন্নতমানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ বা রোগ নির্ণয়, মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা নিয়মিত রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে তার ওষুধ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিরোধ : জন্মের পরপর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দিতে হবে। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাসস্থানের পরিবেশ খোলামেলা, আলো-বাতাস সম্পন্ন হতে হবে। জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাস যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে সবসময় নাক মুখ ঢেকে চলাচল করতে হবে। রোগী জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে অন্য সবার থেকে একটু আলাদা রাখতে হবে জীবাণুযুক্ত রোগীকে যেখানে সেখানে কফ ফেলা পরিহার করতে হবে। নিয়মিত তিন মাস চিকিৎসা করলে এই রোগীর কাছ ত্থেকে এই রোগ আর ছড়াতে পারে না । কিছু সুপারিশ যে সকল হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা দেয়া হয় সে সকল হাসপাতালের যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার দায়িত্বে যিনি থাকেন তিনি অবশ্যই নিয়মিত যক্ষ্মা ক্লিনিকে উপস্থিত থাকবেন যদি উপস্থিত না থাকেন তাহা হলে রোগী এসে ফেরত যাবে এবং তাহার চিকিৎসার ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে যাবে এবং ওষুধ প্রতিরোধি যক্ষ্মার দিকে ধাবিত হবে। যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার জন্য কোন রোগী প্রাইভেট চেম্বারে যাবেন না, যাবেন সরকারী/বেসরকারী হাসপাতালে। যদি কেউ মনে করেন যে আপনার যক্ষ্মা হয়েছে তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে উপজেলা হাসপাতালে অথবা কাছাকাছি এনজিও পরিচালিত ক্লিনিক এ গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, যক্ষ্মা একটি সামাজিক স্বাস্থ্য সমস্যা, আপনার দ্বারা এলাকার বাকিরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×