ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যৌতুকের বলি

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ১২ এপ্রিল ২০১৯

যৌতুকের বলি

বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় সমৃদ্ধির যে জোয়ার সেখানে নারী-পুরুষের সমন্বিত অংশগ্রহণ অতি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। অর্ধাংশ নারী জাতি পিছনে পড়ে থাকলে পুরো সমাজ কখনও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না, সেটা যেমন প্রতীয়মান পাশাপাশি নারী-নিপীড়নের অনেক অঘটন সংবাদ মাধ্যমের পাতাকে ভারি করে তোলে। শারীরিক নির্যাতন, হয়রানি, যৌতুকের যঁাঁতাকলে বলি হওয়া আরও অনেক কিছু নারীদের স্বচ্ছ, স্বাভাবিক যাত্রা পথকে এখনও নির্বিঘ্ন করতে পারেনি। বাল্য-বিয়ের আবর্তে পড়া অরোধ বালিকাদের অকাল মাতৃত্বের বোঝা বইতে হয়। তার ওপর পারিবারিক পরিবেশ সুস্থ ও নিরাপদ হতে বাধাগ্রস্ত হয়। সমৃদ্ধ বাংলাদেশে আজও গতানুগতিক অপসংস্কারকে একেবারে ভেতর থেকে লালন করা হয়। তাই কন্যা সন্তান এখনও সামাজিক অভিশাপ। তবে ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে দেশ থেকে বিশ্ব পরিসীমায় যে মাত্রায় স্পষ্ট করে তুলছে সেখানে দেশের অর্ধেক এই গোষ্ঠী কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। সমতাভিক্তিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখ করার মতো। বিশ্বে ১৪৪ দেশে ৪৭তম। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারে শীর্ষস্থানে। তারপরেও নারীদের ওপর অত্যাচার কিংবা নিপীড়নের মাত্রাও কম উদ্বেগজনক নয়। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, স্বামীগৃহে অসম্মান, অপমান, যৌতুকের দাবিতে শারীরিক অত্যাচার সব মিলিয়ে এখনও অনেক নারী এক বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্বে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছে। এই চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে-এর প্রকোপ আশঙ্কাজনক। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরিতে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর নারী-পুরুষের বৈষম্যের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেখানেও স্পষ্টভাবে নারীদের অধিকারহীনতার মাত্রা ধরা পড়ে। আর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে # মি-টুর ব্যানারে সারা বিশ্বে নারীদের সম্মিলিত প্রতিবাদ নারী নিগ্রহের ব্যাপারগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এছাড়া পণপ্রথার আবর্তে পড়া নারীদের প্রতিদিনের দুঃসহ জীবন তো যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক জঘন্য অপসংস্কৃতি। ফলে অতি বাল্যকাল থেকে একজন কন্যাকে বড় হতে হয় পিতা-মাতার বোঝা হিসেবে। তাকে শুধু বাবা-মার স্নেহাতিশয্যে বড় করা নয় বরং শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর যোগাড় যন্ত্রও করতে হয়। ফলে পুত্র সন্তানের লেখাপড়া সামলাতে গিয়ে বাবা-মার সহায়সম্পত্তি বিক্রি করা গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে। কিন্তু কন্যা-সন্তানের বেলায় এই সম্পদ কমতে থাকে তার বিয়ের যাবতীয় খরচ যোগাড় করতে। এটা অস্বীকৃত, পর্দার আড়ালে থাকা এক অলিখিত সামাজিক বিধি। যা কালক্রমে ব্যাধিতে রূপ নিতেও সময় নেয় না। পণ প্রথার মতো এমন অপসংস্কারকে লালন করতে গিয়ে পিতা-মাতার জীবন দুর্বিসহ হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছের একটা ব্যাপার তো থাকে বিয়ের সময় মেয়েকে সামর্থ্য মতো কিছু দেয়ার। তার ওপর ভর করে সামাজিক মর্যাদা। এই মর্যাদার লড়াইয়েও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের হিমশিম খেতে হয়। সব চাইতে বেশি দাম দিতে হয় বর পক্ষের চাহিদায় দেনা-পাওনার হিসাব কষতে গিয়ে। এই এক পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক চাপ যার থেকে একজন অসহায় কন্যাসহ তার বিচলিত পিতা-মাতাও সঙ্কটের আবর্তে পড়ে। বিয়ের শুভক্ষণ থেকে শুরু হওয়া যৌতুকের এই কঠিন বলয় কোন মেয়েকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। বিয়ের আসরের হিসাব-নিকাশ এক রকম। তাৎক্ষণিকভাবে কোন পিতাকে যে দায় সম্পূর্ণভাবে মিটিয়ে দিতে হয়। ধরে নেয় এই বোধহয় শেষ। অনেক ক্ষেত্রে শেষ হলেও সববেলায় তা হয় না। ফলে পরবর্তীতে এমন চাহিদা সাংসারিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। শ্বশুরবাড়িতে যখন কোন মেয়েকে যৌতুকের বলি হতে হয় সেখানে স্বামী ছাড়াও ননদ, দেবর এমনকি শাশুড়ির চরম নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। যৌতুক নিরোধ-আইন-২০১৮ কে আবার পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে নবায়ন করে অসহায় ও নিপীড়িত নারীদের পক্ষে বিধি-নিষেধকে কার্যকর করা হয়। আর অপরাধীর শাস্তির মাত্রা ও অর্থদ-ও বাড়ানো হয়। কিন্তু কোন প্রচলিত অপসংস্কারকে মূল থেকে উপড়ে ফেলতে আরও সংঘবন্ধ এবং জোরালো আন্দোলন জরুরী। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মেয়েদেরই যথার্থ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ। উল্লেখ্য, ১৮৯০ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প ‘দেনা-পাওনা’র নায়িকা নিরুপমাকে যৌতুকের অত্যাচারে পিষ্ট হয়ে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। আবার ১৯১৪ সালে লেখা ‘অপরিচিতা’ গল্পের নায়িকা কল্যাণী পণপ্রথাকে ঘৃণা ও দর্পভরে অস্বীকার করে বিয়ের আসর থেকে বরকে উঠে যেতে বাধ্য করে। সুতরাং এমন মেয়ে বাংলাদেশে উদ্দীপ্ত চেতনায় জেগে উঠুক যে নিজেই তার যাত্রাপথকে নির্বিঘ্ন করবে।
×