ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

নির্বাচনের পরেই কেন এত আগুন!

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ৯ এপ্রিল ২০১৯

নির্বাচনের পরেই কেন এত আগুন!

ভাল করে স্মরণ করে দেখলে অবশ্যই এ প্রশ্ন মনে না উঠে পারে না যে, ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের আগে অক্টোবর, নবেম্বর, ডিসেম্বর মাসে জাতি কোন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, বিশেষত ঢাকা শহরে দেখেনি! পুরো ডিসেম্বর মাস বাধা-বিঘ্নহীন অগ্নিকাণ্ডহীন কাটার পর কেন হঠাৎ করে জানুয়ারি মাস থেকে ঢাকা শহরেই, বিশেষ করে বনানী, গুলশান, ধানমণ্ডি, এমনকি গাউছিয়া মার্কেট, নওগাঁয় বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যেন প্রতিযোগিতা করেই একের পর এক সংঘটিত হয়েছে! কেন? পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি অঞ্চলে নানা রকম দাহ্য রাসায়নিকের গুদামভরা সরু সরু গলির পাশের বসতিগুলোতে দাহ্য পদার্থ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চারদিকের ভবনে, রাস্তার যানবাহনে দ্রুত আগুন লেগে অন্যান্য দাহ্য পদার্থে ছড়িয়ে পড়ে শতাধিক মানুষ, দোকান, যান, ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সব কিছুকে অঙ্গারে পরিণত করতে পারে- এটি সম্ভব বলে জনসাধারণ মনে করছে। কিন্তু ভয়াবহ আগুন প্রকৃত অর্থে কি উৎস থেকে লেগেছিল সে সম্পর্কে কমপক্ষে দুটি ভিন্ন মত উঠে এসেছে। এর একটি কোন গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে চারদিকের দাহ্য পদার্থে, পলিথিনের গুদামে আগুন তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য মত হলো, কোন লোশন, বডি স্প্রের কৌটা বিস্ফোরিত হয়ে এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে, পাশের দোকানে, ওপরে, রাস্তার পথচারী, যানের যাত্রী, যান সবকিছুতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শতাধিক মৃত্যুর প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে কিনা জাতি জানে না। এরপর কারখানা, গুদাম, বস্তি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, এখন বনানীর মতো অভিজাত স্থানের বহুতল ভবনে আগুনে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হলো তরুণ-তরুণী, মধ্য বয়সী ছাব্বিশ কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে এ ভবনটি যদি নির্মিত হয়, তাহলে সেটি তেইশ বছর যাবত কোন অগ্নিকা-ের শিকার না হয়ে শত শত নারী-পুরুষকে কর্মজীবনযাপন করতে এতদিন কোন সমস্যা হলো না কেন? আজ তেইশ বছর পর কেন এই সমস্যা? তাও আবার আগুন, যে আগুনের কেবল ধোঁয়াই মানুষের মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। জানুয়ারি থেকে লাগাতার আগুন লাগার ঘটনা দেখে দেখে বারবার মনে পড়ছিল ২০১৪-১৫-এর পেট্রোলবোমায় মাসাধিককাল চলা অগ্নি-সন্ত্রাসের অপরাধের কথা, যে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছিল রাস্তার বাস, ট্রাক, গাড়ি, সিএনজি, রেল ও এসবের নারী-পুরুষ, শিশু-তরুণ, কিশোর-কিশোরীর অবর্ণনীর কষ্টের মৃত্যু! পাঠক, চিন্তা করে দেখুন আমাদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বয়স কমপক্ষে পঞ্চাশ। এ হাসপাতালে এত দীর্ঘকাল পর আগুন লাগে কেন? কিভাবে? আজকাল প্রায়ই একটি কথা শুনি বিদ্যুতের শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগার কথা। তাহলে পঞ্চাশ বছর আগে যখন বিদ্যুত অনেক কম ছিল তখন শর্টসার্কিট হতো না কেন? শর্টসার্কিট হলে একটি দিকের বিদ্যুতের তার পুড়ে যায় এবং ঐদিকের লাইট-ফ্যান চলে না। কালো ধোঁয়া বের হলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়ার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। আগুন লাগতে দেখিনি। বর্তমানে পর্যাপ্ত বিদ্যুত উৎপাদন হওয়ার পর এই বিধ্বংসী আগুন সৃষ্টি করার উৎস শর্টসার্কিট হতে পারে কি? জানি না প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলীরা কি বলবেন। এরপর গুলশানের সিটি কর্পোরেশনের মার্কেটে আগুন লেগে প্রায় সব দোকান, সব পণ্যসহ পুড়ে ছাই হওয়া- এসব কিসের আলামত, সন্দেহ না হয়ে পারে না। এ তথ্যটি তো আমাদের জানা আছে যে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক রকম নাশকতা, বিশেষ করে সরকারকে বিব্রত, সমস্যায় ফেলার জন্য, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপকৌশলে মানুষকে ব্যবহার করার জন্য কোটি কোটি টাকা দেশে ছড়ানো হয়েছিল। এর মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক অপকৌশল খুব বেশি না হলেও আগেই ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভরার ঘটনা মাত্র একটি কেন্দ্রে পাওয়া গেলেও এটি অবিশ্বাস্য রকমের প্রচার পেয়েছে গোয়েবলসীয় কায়দায়। বিরোধী দল নির্বাচন হয়নি এ কথা বলে বলে বিদেশীদের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তবে তারেকের সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রটি ছিল উচ্চমূল্যে কেনা পশ্চিমা নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দিয়ে নির্বাচনে অসম্ভব জালভোট হয়েছে, আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ব্যালট পেপার ভরে রাখা, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর হামলা, তাদের প্রচারে বাধা দেয়া হয়েছে ইত্যাদি বলে নির্বাচনটি অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে পুনর্নির্বাচন চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগটি সূচনাতেই ব্যর্থ করে দেয়ার ফল সম্ভবত বর্তমান সরকারকে অযোগ্য প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন অগ্নিকা-ের দ্বারা সাধারণ মানুষের মৃত্যু সংঘটিত হলে এই অপরাধের সামনে সরকারকে অসহায় করে রাখা বোধহয় নতুন একটি ষড়যন্ত্রই। সরকারকে বলব, অন্তত বনানীর বহুতল ভবনের এবং গুলশান সিটি কর্পোরেশনের আগুন এ দুটি অগ্নিকা-ের কারণ, উৎস গোয়েন্দাদের দিয়ে সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করে বের করে জনগণের সামনে নেপথ্যের মূল অর্থ ও অপকৌশল প্রদানকারীর পরিচয় উন্মোচন করা সরকারের স্বার্থেই প্রয়োজন। এটা তো জনগণ জানে কে, কারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শত্রু এবং ’৭১-এর বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতাকারীদের বন্ধু। জাতি বারবার জানুক সব রকম অশান্তি, অস্থিতিশীলতা, হত্যা, নাশকতা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন নস্যাতকারী কারা। একটি প্রস্তাব, ফায়ার সার্ভিস তাদের সব সরঞ্জামের সঙ্গে একটি বড় নেট বা জাল নিয়ে যাবে। উপস্থিত তরুণরা সেটি ধরে রাখবে এবং আগুন লাগা বহুতল ভবন থেকে আক্রান্ত মানুষকে নিচে লাফিয়ে নামতে এটি উঁচু কোন খুঁটিতেও বাঁধা যেতে পারে মানুষের যা প্রাণ বাঁচাতে সহায়ক হবে। এই বড় জাল বা নেটের ব্যবহার দেখেছি খুব ছোট বেলায় বিখ্যাত কমলা সার্কাসের বিস্ময় জাগানিয়া খেলা দেখার সময়। খেলার মেয়েগুলো অনেক ওপরে এক বার থেকে অন্য বারে দুলতে থাকা মেয়ের কাছে গিয়ে হাত ধরে দুলতে থাকে। তখন কেউ কেউ হাত ফসকে হঠাৎ নিচে পড়ে যায় বড় একটা জালের ওপর, কিছুক্ষণ লাফিয়ে লাফিয়ে পরে নেমে আসে। এ ছাড়া তারের ওপর ছাতা হাতে হাঁটা মেয়েদের জন্যও নিচে ওই নেট থাকত, নিরাপত্তার জন্য। তাদের কোনদিন পড়তে দেখিনি। বহুতল ভবনে আগুন লাগলে আমার মনে হয় জানালা দিয়ে দ্রুত বহু মানুষ নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে যদি নিচে ফায়ার ব্রিগেড বড় একটি জাল চারদিকের ইলেকট্রিক খুঁটিতে বেঁধে রাখে। মানুষকে চারদিকে খুঁটি থেকে জাল যাতে খুলে না যায় সেদিকে নজরদারি করতে বলা হবে। পাশাপাশি উঁচু সিঁড়ি বা ল্যাডারও ব্যবহার করতে হবে আটকে পড়া মানুষকে দ্রুত নামিয়ে আনার জন্য। শুরুতেই বনানীতে ল্যাডার ব্যবহার করা হয়েছে কি? পানি দেয়ার পাশাপাশি দ্রুত ল্যাডার ব্যবহার করা গেলে মনে হয় আরও বেশি মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো। ল্যাডারের ব্যবহার মনে হয় হয়েছে তিনটার পর, যেখানে আগুন লেগেছে সাড়ে বারোটার দিকে। ইউরোপের শহরগুলোর সব ভবন প্রায় লাগালাগি, নিউইয়র্কেও তাই। বরং ভবন লাগালাগি ছিল বলেই এফ আর ভবনের ছাদ থেকে অনেক মানুষ পাশের ভবনের ছাদে লাফ দিয়ে নেমে জীবন বাঁচাতে পেরেছে। সমস্যা হলো এক্সিট পথের অগ্নিনির্বাপক দরজার অপ্রশস্ততা, বিদ্যুতের মেইন সুইচ, প্রত্যেক ফ্লোরের মেইন সুইচ সঙ্গে সঙ্গে অফ না করা, ধোঁয়া ওঠার পথটির দিকের দরজা, জানালা বন্ধ রাখা। প্রত্যেকের মুখে রুমাল, ওড়না, আঁচল ঢুকিয়ে ছাদে চলে যাওয়া, সেখান থেকে হেলিকপ্টারের সাহায্যে তাদের উদ্ধার ফায়ার সার্ভিসের সে সব ব্যবস্থা রাখা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, আগুন লাগবে, এটা ভেবে কাজ করা হবে? নাকি আগুন লাগার কোন সম্ভাবনা থাকবে না, সেটা ভেবে কাজ করা হবে? প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, বড় বড় শহরে বড় রাজপথের ওপর সারি সারি বাড়ি লাগালাগিই থাকে। কিন্তু রাজপথটি প্রশস্ত থাকবে। বাড়িটির ভেতরের ফায়ার এক্সিটগুলো প্রশস্ত থাকবে। অফিস ফার্নিচার সব সময় দাহ্যই হবে; কিন্তু বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করা হয়েছিল কিনা, কে বা কারা বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করার দায়িত্বে ছিল, সেটি দেখা। এসি সব অফিসেই থাকবে। সে জন্য বিদ্যুতের সঞ্চালন তারটি যথেষ্ট শক্তিশালী কিনা, সেটি দেখা আবশ্যক। সাধারণত এসি লাগানোর সময় তারটি এই ভার নিতে না পারলে তখনই তারটি জ্বলে নিভে যায় এবং এ তারের সঙ্গে যুক্ত ফ্যান, লাইটও নিভে যায়। আমি ওভারলোড থেকে আগুন জ্বলতে প্রায় দেখিনি। সবশেষে বলব, যেহেতু নির্বাচনের পর প্রতিদিন আগুন লাগছে, সুতরাং এগুলোর পেছনে নাশকতা থাকার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না। এটি অনুসন্ধান করা জরুরী। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×