ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৬ এপ্রিল ২০১৯

 ঐতিহাসিক ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বের কাছে প্রথমে এতটা বড় করে প্রকাশ পায়নি। গণহত্যার ভয়াবহতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম যিনি তুলে ধরেছিলেন, তার নাম ছিল আর্চার ব্লাড। তিনি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। একাত্তরের এই দিনে তিনি তীব্র ভাষায় টেলিগ্রাম পাঠান যুক্তরাষ্ট্রে, গণহত্যার ভয়াবহতা জানিয়ে। এটি ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত। ৬ এপ্রিল ১৯৭১, ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছিল ঐতিহাসিক ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’। মার্কিন কর্মকর্তারা পঁচিশে মার্চের সেই ‘কালরাতে’ ঢাকায় চালানো গণহত্যা এবং এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের পশ্চিম পাকিস্তান ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন। তারা খুব ভেবেচিন্তে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন, যা মূলত Blood Telegram নামে আজও আমাদের মহান স্বাধীনতার পক্ষের দলিল হিসেবে স্বীকৃত। ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ এর অর্থ ছিল অনেকটা এ রকম- ‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমনে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার ব্যর্থ হয়েছে কোন শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এ দেশের নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য, যখন একই সময়ে, পশ্চিম পাকিস্তানী নিয়ন্ত্রিত সরকারের পিঠ চুলকাতে ব্যস্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে নেয়া কোন প্রাপ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত কঠিন কূটনৈতিক ব্যবস্থা শিথিলকরণে। আমাদের সরকার প্রমাণ করেছে, যা অনেকের বিবেচনায়, আমাদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে, অথচ আমরা নিরপেক্ষতা বেছে নিয়েছি, এমনকি মানবিক কারণেও, যে এটা জনগণের সংঘাত, শুদ্ধভাবে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, যা দুর্ভাগ্যবশত গণহত্যা হিসেবে প্রযোজ্য। সাধারণ আমেরিকান এর প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। আমরা, পেশাদার আমেরিকান কর্মচারী হিসেবে বর্তমান নীতির সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য ব্যক্ত করি এবং নিশ্চিতভাবে আশা করি যে- এখানে আমাদের সত্যি এবং স্থায়ী স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করা যায় আমাদের নীতিমালা পরিবর্তিত করে। ‘এতে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্লাড এবং তাঁর ২০ জন সহকর্মী। তারা তাতে ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক চালানো গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা জানিয়েছিলেন। ব্লাড তাতে শুধুই স্বাক্ষর দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেইসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত নোটও লিখেছিলেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- ‘আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালীদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।’ এদিন ঠাকুরগাঁও-এর অবস্থা ছিল আগের দিনের চেয়ে আরও নাজুক। কন্ট্রোল রুম খোলার জন্য কোন দায়িত্ববান লোকও পাওয়া যাচ্ছিল না। শহরের দোকানপাট বাড়িঘর পাহারা দেবার জন্য যারা রাতে ছিলেন তারাও আদালত প্রাঙ্গণে আসতে আসতে দুপুর পার করে দিয়েছেন। সবার চোখে মুখে ছিল আতঙ্ক। ঢাকাসহ অন্য কোন জায়গার কোন সঠিক খবর কেউ দিতে পারত না। রাতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা এবং আকাশবাণীর সংবাদ ছিল মূল আকর্ষণ। চট্টগ্রামের দোহাজারীতে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকসেনাদের প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকে থাকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে। সিলেটের করিমগঞ্জ সীমান্তে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচন্ড লড়াই শেষে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করে বলে ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ পরোক্ষভাবে স্বীকার করেন। সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্নি রক্তক্ষয় বন্ধের আহ্বান জানিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে দেয়া পত্রের জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াাহিয়া বলেন, ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেয়া হবে না। এদিন পাকসেনারা অতর্কিতে চাঁদপুর, পুরানবাজারে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। এটাই ছিল চাঁদপুরে পাকবাহিনীর প্রথম বিমান আক্রমণ। গোলাম আযম, হামিদুল হক চৌধুরীসহ একটি দল পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। পাক বর্বররা সিলেট শহরতলীর কলাপাড়ায় এক গণনিধনযজ্ঞ চালায়। ফলে ২৫ জন নিরীহ বাঙালী মৃত্যুবরণ করেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য ও ভাঙ্গার লোকজনসহ সুবেদার এ. কে. এম. ফরিদউদ্দিন আহমদ পাঁচদোনার শীলমান্দি নামক গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অন্যদিকে পাকসেনারা ডেমরায় একত্র হয়ে মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনারা সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলের আয়ত্তের মধ্যে চলে আসে এবং তুমুল গুলি বিনিময় হয়। দুই-তিন ঘণ্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে পাকসেনারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সেনানিবাসে ফিরে যায়। সন্ধ্যা ৬-৭টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী শহর আক্রমণ করে। পাকবাহিনীর প্রবল গোলাবর্ষণ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিবর্ষণের মুখে অদম্য সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং শত্রুর ব্যুহ ভেদ করে শহরে ঢুকে। প্রায় চার ঘণ্টা লড়াইয়ের পর রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহীর চতুর্দিকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। এ যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘রাজশাহী যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। এদিন গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ শিরোনামে বলা হয় ‘আলোচনা ভেঙ্গে যায়নি। ইয়াহিয়া চাননি মুজিব ক্ষমতায় আসুক। তাই তিনি বন্দুক নিয়ে নামলেন। ’আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সার-সংক্ষেপ: বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গন: পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ ৪৮০ কি.মি. দীর্ঘ ঢাকা-শ্রীহট্ট রেলপথটি নানা জায়গায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, ফলে শ্রীহট্ট শহরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে ঢাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ পাঠানো অসম্ভব করে তুলেছে। ময়মনসিংহ মুক্তিফৌজের হাতে। সংলগ্ন নতুন জেলা টাঙ্গাইলের অবস্থাও তাই। মুক্তিফৌজ কুমিল্লা শহরও দখল করছে। পাকফৌজ শহর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। বাংলাদেশের-পশ্চিম রণাঙ্গন: পশ্চিম রণাঙ্গনের কুষ্টিয়ায় প্রচ- লড়াই চলে। যশোরের চাচড়ার মোড় পুনর্দখলের জন্য জোর লড়াই শুরু হতে চলেছে। খুলনায়ও উভয় পক্ষে মরণপণ সংগ্রাম চলছে। বাংলাদেশের-উত্তর রণাঙ্গন: উত্তর রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ একটি সাফল্য অর্জন করেছে- তারা হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রংপুর শহরটি ছিনিয়ে নিয়েছে, তিস্তা সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, লালমনিরহাট বিমান ক্ষেত্র অকেজো করে দিয়েছে। সামরিক দিক থেকে এ সাফল্যের তুলনা নেই। রাজশাহীতেও জোর লড়াই চলছে। বগুড়া ও পাবনা জেলা হানাদার মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের-দক্ষিণ রণাঙ্গন: চট্টগ্রামে আবার প্রচন্ড লড়াই শুরু হয়েছে মুক্তিফৌজ ও হানাদার ফৌজের মধ্যে। পাক বিমান বোমা ফেলেছে চট্টগ্রাম শহরে। নোয়াখালী জেলার নানা অঞ্চলেও উভয় পক্ষ মুখোমুখি। বরিশাল জেলার লড়াই হঠাৎ প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে। দিল্লীতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শদাতা পিএন হাকসারের একান্ত বিশেষ বৈঠক হয়। আলোচনায় সর্ববিধ গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। এইদিনে যে দু’জন কূটনীতিক সর্বপ্রথম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তাদের একজন আমজাদুল হক নয়া দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনের একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস এটাচি। অপরজন ওই দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি, কে এম শাহাব উদ্দিন আহমদ পাকিস্তান হাইকমিশনের চাকরি থেকে পদত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনুগত্য এবং সমর্থনের ঘোষণা দেন। এদিন দু’জনই পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে এসে নয়াদিল্লীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, যদিও সে সরকার তখনও গঠিত হয়নি। এটা এমন একটি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল যে ধরনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে ঘটেনি। কূটনীতিকদের মধ্যে বিদেশের রাজধানীতে কর্মরত কোন কূটনীতিক পদত্যাগ করে আর একটি দেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এর আগে কখনও ঘটেনি। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘ইসলামাবাদ বাংলাদেশের নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের উপর এক নিরবিচ্ছিন্ন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের জনগণ এখন ইসলামাবাদের শাসনকে একটি বৈদেশিক ঔপনিবেশিক শাসন হিসেবে গণ্য করছে। এটা এতই বর্বর যে, ইতিহাসে এর চেয়ে বর্বর ইতিহাস কখনই জানা যায়নি। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি দখলদার বাহিনী। তারা বিবৃতির উপসংহারে বলেন, ‘আমরা ইসলামাবাদের ফ্যাসিবাদী সামরিক একনায়কত্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি, কারণ আমাদের বিবেকের গভীরতম দৃঢ়তার বিরুদ্ধে আমরা এই ফ্যাসিস্ট সরকারের কাজ করতে পারি না। সিঙ্গাপুরের দি নিউ নেশন পত্রিকায় গণহত্যা নিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে চলমান এই হত্যাযজ্ঞ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×