ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তি সংগ্রামের রণকৌশল নির্ধারণ ॥ ৪ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১০:৪১, ৪ এপ্রিল ২০১৯

মুক্তি সংগ্রামের রণকৌশল নির্ধারণ ॥ ৪ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল দিনটি ছিল রবিবার। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার পর ভারতসহ সারাবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন সহকর্মী নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যাঁরা ছায়া সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক- যাঁরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভূমিকা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা হয়। এইদিন ঢাকায় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান নূরুল আমিনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধি দলের সদস্য মৌলবী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, খাজা খয়রুদ্দিন, শফিকুল ইসলাম, মওলানা নুরুজ্জামান প্রমুখ জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ণ সমর্থন জানায় ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তারা সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। পাক হানাদার বাহিনী অপ্রত্যাশিতভাবে ফেনী শহরের ওপর বিমান আক্রমণ চালায়। এই বিমান হামলায় শহরের বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয় ও অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। ঠাকুরগাঁও ৯ নম্বর উইং-এর সুবেদার মেজর কাজিমউদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল, তৃতীয় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আশরাফ, মেজর মকসুল হুসেন চৌধুরী, এএমসির অবসরপ্রাপ্ত মেজর টি হোসেন, সুবেদার মেজর ওসমান গণি প্রমুখের উপস্থিতিতে ভাতগাঁও সেতুর কাছে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুবেদার এ মজিদ একটি কোম্পানি নিয়ে নীলফামারীতে, ক্যাপ্টেন আশরাফ তৃতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানি, সুবেদার হাফিজ ইপিআর বাহিনীর দুটি কোম্পানি এবং হাবিলদার নাজিম দুটি এন্টি-ট্যাংক গান নিয়ে ভুষিরবদর নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। নায়েব সুবেদার কায়সার ও হাবিলদার জায়দুল হোসেনের নেতৃত্বে একটি কোম্পানি বদরগঞ্জ নামক স্থানে ডিফেন্স নেয়। ক্যাপ্টেন আশরাফ সার্বিকভাবে ফিল্ড কমান্ডার মনোনীত হন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ নিয়ে একটি যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। পাকসেনাদের একটি রেজিমেন্ট বাঙালী দালালদের সহায়তায় হারাগাছ নামক এলাকা হয়ে তিস্তা নদী অতিক্রম করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে এবং হত্যা লুণ্ঠন চালিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। পাকবাহিনী ও রাজাকাররা লালমনিরহাট দখল করে নেয়। রাতে মুক্তিযাদ্ধাদের ‘এ’ কোম্পানি কালুরঘাটে, ‘বি’ কোম্পানি রাজারহাটে, ‘ডি’ কোম্পানি সাপটিবাড়ি বাজারে সুবেদার আরব আলীর কমান্ডে এবং ‘সি’ কোম্পানি বোরহানউদ্দিনের কমান্ডে কালীগঞ্জ থানা এলাকাতে ডিফেন্স নেয়। সার্বিক কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন। মেজর জলিল খুলনা বেতার কেন্দ্র দখলের লক্ষ্যে পিরোজপুর হয়ে বাগেরহাট অভিমুখে রওনা হন। সিলেট শহরের টিবি হাসপাতালে অবস্থানরত পাকঘাঁটির ওপর মুক্তিযাদ্ধারা বড় ধরনের আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে ব্যাপক ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী ঘাঁটি ছেড়ে শালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। একদিকে ঠাকুরগাঁও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যেমন কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না অন্যদিকে অবাঙালী নিধনের জের কিভাবে কার ওপর এসে পড়বে তা নিয়ে সবাই আলোচনা করছিল। ফলশ্রুতিতে ঠাকুরগাঁও এর সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আগের দিনের চেয়ে আদালত প্রাঙ্গণে উৎসুক জনতার ভিড় কম মনে হলো। এদিন থেকেই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তাদের পরিবার পরিজন শহর থেকে গ্রামের দিকে সরিয়ে দিতে শুরু করেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে এক কোম্পানি নিয়মিত সৈনিকসহ ইপিআর সৈনিকরা নরসিংদী এলাকায়, ক্যাপ্টেন নাসিমের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি মুজাহিদ সহযোগে আশুগঞ্জে, লেফটেন্যান্ট মোর্শেদের নেতৃত্বে এক প্লাটুন নিয়মিত সৈনিকসহ ইপিআর সৈন্যরা লালপুরে, ইপিআর ও মুক্তিযাদ্ধাদের মিশ্রণে এক কোম্পানি একজন জেসিও এর (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) নিয়ন্ত্রণে আজবপুরে, ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে ইপিআর সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয়। ইপিআর ক্যাপ্টেন মতিনের কমান্ডে একটি কোম্পানি সরাইলে, ক্যাপ্টেন আজিমের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানি শেরপুর-শাদীপুরে, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি মেজর মঈনের কমান্ডে তেলিয়াপাড়ায় অবস্থান নেয়। একাত্তরের এই দিনে ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের উপস্থিতিতে দেশপ্রেমিক বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা বৈঠকে মিলিত হন। সে দিনের বৈঠকে ৭২ জন দেশপ্রেমিক বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উল্লেখযোগ্য সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন, কর্নেল এম এ জি ওসমানি, লেঃ কর্নেল আবদুর রব, লেঃ কর্নেল সালাহ উদ্দিন মোঃ রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন নাসির, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর সাফাত জামিল, মেজর মাইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর কে এম শফি উল্লাহ, লেঃ সৈয়দ ইব্রাহীম, কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও অন্যরা। সভায় কর্নেল এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয়। ৪ এপ্রিলের সেই মিটিংটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি ল্যান্ডমার্ক। এ বৈঠকেই পুরো রণাঙ্গনকে প্রাথমিকভাবে ৪টি এবং পরবর্তী সময়ে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন আতাউল গনি ওসমানী। বৈঠকে রাজনৈতিক আন্দোলন জোরদার, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বৈঠকে রণনীতি রণকৌশল ম্যাপ রচনা করা হয়। তেলিয়াপাড়া থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক মেজর জেনারেল এমএজি ওসমানি নিজের পিস্তলের ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। একই সঙ্গে দেশকে স্বাধীন করার শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবং জঙ্গল কেটে চা শ্রমিকদের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত যাওয়ার মতো একটি রাস্তা ও তৈরি করা হয়। ঔপনিবেশিক মুক্তি আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ব্রিটিশ লর্ডস সভার সদস্য লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে ৪ এপ্রিল ১৯৭১ ব্রিটেনের এক উন্মুক্ত জনসভায় বলেন- তাঁর শৈশব কেটেছে বাংলায় তাই নিজেকে তিনি সবসময় বাংলার বন্ধু হিসেবে মনে করেন। পূর্ব বাংলায় তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয় ঘটছে অতি দ্রুত তা বন্ধ করতে অবদান রাখার জন্য তিনি দাবি জানান। এ জন্য তিনি ছয় দফা দাবি পেশ করেন-১. পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত মানুষদের জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে। ২. সব রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৩. পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে জনসাধারণের ওপর গুলি করা বন্ধের আদেশ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাদের প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে স্বাধীনভাবে জনগণের ভবিষ্যত নির্ধারণের অধিকার নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ৫. পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ বিবেচনা করে জাতিসংঘকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে সিঙ্গাপুর ঘোষণায় সম্মতি দাতা দেশের তালিকায় পাকিস্তানও ছিল। ব্রিটেন, ভারত ও কানাডার মতো প্রথম সারির কমনওয়েলথ সদস্য দেশ কার্যকরী ভূমিকা রেখে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী তুলে ধরার জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠাবে। যশোরের একটি ক্যাথলিক চার্চের ফাতিমা হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযাদ্ধাদের চিকিৎসার সেবার তদারকি করতেন ফাদার মারিও। এই হাসপাতালে প্রাণ বাঁচাতে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন বিকেল ৪টায়, পাক বাহিনীর একটি দল গালি দিতে দিতে চার্চে প্রবেশ করে। রেডক্রসের পতাকা, বুকে ঝোলানো রেডক্রসের ব্যাজ সব কিছু অবজ্ঞা করে চার্চে ঢুকে সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে। ফাদার মারিও দুই হাত উঁচু করে এক সেনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাঁকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গুলি করা হয়, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গরিব-দুঃখী মানুষের দরদী এই বন্ধু। যুগোশ্লাভ সংবাদ সংস্থা তানযুগ-এর সংবাদদাতা পিকিং থেকে জানিয়েছিল, ‘চীনা পত্রিকাগুলো এই প্রথম বাংলাদেশ সম্পর্কে খবর প্রকাশ করেছে। তবে কোন মন্তব্য করেনি, কিন্তু এমনভাবে তথ্য প্রকাশ করেছে, যা থেকে মনে হয় যে, সেখানকার (বাংলাদেশের) পরিস্থিতি গুরুতর ও জটিল। ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে- পাকিস্তানের এই অভিযোগ চীনা পত্রিকাগুলো ফলাও করে ছেপেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×