ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঝালকাঠির কাঠিপাড়া

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ২৯ মার্চ ২০১৯

 ঝালকাঠির কাঠিপাড়া

মোঃ রোকনুজ্জামান বাবুল ॥ ১৭ মে, ১৯৭১। সোমবার। সকাল ৭টার দিকে এই এলাকার মানুষ জানতে পারেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের এলাকায় আসছে। সবাই জীবন বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে সবাই দলে দলে ঘন জঙ্গল ও আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। নারী ও শিশুদের অধিক নিরাপত্তা দিতে পুরুষরা সামনে থাকেন আর নারী-শিশুদের জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু স্থানীয় রাজাকারদের শ্যেন দৃষ্টি এড়াতে পারেননি তারা। রাজাকারদের মধ্যে কোন একজন তাদের দেখে ফেলে। গণহত্যার দিন কাঠিপাড়ার তিন দিক থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী এ অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর একটি দল কাঠিপাড়ার পিছনের দিকে স্কুলের পাশ দিয়ে, একটি দল দক্ষিণ কাঠিপাড়ার পাশের খালের ধারে এবং অন্য দলটি খালের ওপারের নারিকেলবাড়িয়া হয়ে পুরো জঙ্গল ঘিরে ফেলে। এরপর গুলি করতে করতে গণহত্যার স্থলে প্রবেশ করে রাজাকার ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। প্রবেশ পথসহ জঙ্গলের ভিতরে চালায় ব্যাপক গণহত্যা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে একে একে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধশত লোককে গুলি করে হত্যা করে। সকাল ৯টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত চালায় হত্যাযজ্ঞ। সেদিন সকালে এখানে এক পরিবারের ৮ জনসহ প্রায় অর্ধশত নিরীহ লোককে স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। একই বাড়িতে ২২ জন মহিলা বিধবা হন (স্থানীয়ভাবে এটি বিধবা পল্লী নামে খ্যাত)। যেহেতু হিন্দুদের প্রতি আক্রোশটা বেশি ছিল তাই নির্যাতিত হিন্দুদের সংখ্যাও বেশি ছিল। জঙ্গল ছাড়াও আশপাশের খালের ভাসমান কচুরিপানার (স্থানীয়ভাবে টগর বলা হয়) নিচে বহু হিন্দু আশ্রয় নেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী কচুরিপানার নিচ থেকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এদেরকে হত্যা করে। আবার রাজাকার বাহিনীর প্রতিহিংসার শিকারও হন কেউ কেউ, যেমন-কার্তিক চন্দ্র হালদার। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্থানীয় রাজাকার আবয়ুব আলী ঘরামি কুপিয়ে হত্যা করে তাকে। ছোরার আঘাতে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসে তার। আর উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাজাকাররা হরিমোহন হাওলাদারকে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। রাজাকার খালেক মাস্টার তার ব্যবসায়িক অংশীদার হরিমোহনকে সরিয়ে পুরো ব্যবসা আত্মসাত করতে তাকে গুলি করে হত্যা করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয় প্রিয়নাথ এদবরকে। সেই সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান অনেকে। তারা বিকেলে ফিরে এসে গণহত্যার জায়গাটি ছাড়াও আশপাশের অনেক এলাকাজুড়ে পড়ে থাকতে দেখেন শুধু লাশ আর লাশ। এসব দেখে যারা বেঁচে যান সেইসব স্বজনহারা দুর্ভাগাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। সেদিন গণহত্যার স্থলেও শহীদদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণের গহনা ও নগদ টাকা লুট করে লুটেরারা। এমনকি পাকিস্তানী বাহিনী চলে যাবার পর শহীদদের মৃতদেহগুলো নিয়ে পরিবারের বেঁচে যাওয়া সদস্যরা যখন কান্নাকাটি করেছেন, অন্যদিকে তখন পাকিস্তানী রাজাকার ও লুটেরারা গ্রামে লুটতরাজ করেছে। গণহত্যার পরের দিন গ্রামবাসী স্বজনদের মৃতদেহ ওই জঙ্গলে ভিতরেই ৪টি গর্ত করে ১০-১২ জন করে কবর দেয়। গণকবর দেবার কাজটি করেন চন্দ্রকান্ত মন্ডল, অমল কৃষ্ণ মন্ডল, নিশিকান্ত মন্ডল, শরত হালদার, সুমন্ত কুমার রায়, হরেন্দ্রনাথ হালদার, মুকুন্দু বড়াল প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে গণহত্যার পাশাপাশি রাজাকাররা এই এলাকায় ব্যাপক লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে। রাজাকার ও লুটেরা বাহিনী গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং সম্পদ লুট করে। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটত গ্রামবাসীর। কেননা ঘরে কোন জিনসিপত্র বা খাবার উপকরণও রাখতে পারত না। মূল্যবান সম্পদ থেকে শুরু করে তরকারি গরু ছাগল, কাসা-পিতল, হাঁড়ি পাতিল, ঝাড়– পর্যন্ত নিয়ে যায় স্থানীয় রাজাকার ও লুটেরা বাহিনী। যেগুলো লুট করা সম্ভব হয়নি সেগুলো নষ্ট করে রেখে যেত যেমন, ডিমগুলোকে ভেঙ্গে রেখে দিত, যেমন কুমড়াগুলাকে কুচিয়ে রেখে দিত আর মাটির জিনিসগুলো ভেঙে রেখে যেত। এমনকি ঘরের ভেতর গর্ত করে বস্তা ভরে জিনিসপত্র রাখলে তাও নিয়ে যেত। রাজাকাররা মিলিটারি আসছে বলে ভয় দেখাত। সবকিছু ফেলে যখন নিরীহ মানুষগুলো পালাত, তখন জিনিসপত্রগুলো তুলে নিত। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই অঞ্চলে প্রতি রাতে চলে নারী নির্যাতন। কোন ঘরে বিশেষ করে গ্রামের হিন্দু পরিবারের সুন্দরী মেয়ে রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দিত। সুন্দরী মেয়েদেরকেও মাটির নিচে লুকিয়ে রাখলে সেখান থেকেও মাটি খুঁঁজে বের করে নিয়ে যেত রাজাকাররা। কয়েকদিন নির্যাতন চালিয়ে পরে ফেলে রেখে যেত। অন্যদিকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের মুসলমান হওয়ার প্রলোভন দেখায় স্থানীয় রাজাকাররা। কিছু মানুষ তাতে বিশ্বাস করে স্থানীয় মসজিদে উপস্থিত হলে তাদেরকেও হত্যা করা হয়। এভাবে প্রতিনিয়তই রাজাকাররা আশপাশের গ্রামের মানুষদের ধরে নিয়ে এসে এখানে হত্যা করত। স্থানীয় খালেক হাওলাদার ওরফে খালেক মাস্টার ছিলেন শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য এবং রাজাকার কমান্ডার। তার নেতৃত্বে হত্যা, লুণ্ঠন, হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ নানাবিধ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর প্রধান সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নৈকাঠি গ্রামের হামেদ জমাদ্দার ও তার দুই ছেলে বেলায়েত জমাদ্দার ও মিল্লাত জমাদ্দার। এছাড়াও তারাবুনিয়া ইউনিয়নের মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ও কুট্টি দুই ভাই, আইয়ুব আলী ঘরামি, সামসের হাওলাদার, নুরু গাজী, রসুল খাঁর ছেলে ফজল খাঁ ও মালেক মিরা অন্যতম। বারেক হাওলাদার ছিলেন নির্যাতনকারী রাজাকার নেতা। সর্বোপরি এই এলাকায় গণহত্যা ও নির্যাতনে রাজাকার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা কখনও কখনও পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। এই গণহত্যা নিয়ে আরও জানতে পড়ুন ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় মুনিরা জাহান সুমি রচিত কাঠিপাড়া গণহত্যা গ্রন্থটি। লেখক : উপ-পরিচালক, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×