অপূর্ব কুমার ॥ বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তারের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করা টাকা দ্রুত ব্যবহারের কারণে বসুন্ধরা পেপার মিলের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। প্রধানত টিস্যু ও কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫০ মেট্রিকটনে। আগের তুলনায় ২৬.৫০ শতাংশ উৎপাদ বেড়েছে কোম্পানিটির। সাম্প্রতিক সময়ে টিস্যু ও কাগজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে পেপার মিলটি নারায়ণগঞ্জে ১০৭ কোটি টাকা দিয়ে অস্ট্রিয়া বেইজড এন্ড্রিজ মেশিনের নতুন ইউনিট চালু করে। বিশ্বব্যাপী এই মেশিনটির বিভিন্ন ধরনের টিস্যু ও কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। একইসঙ্গে কোম্পানিট বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে পণ্যের বৈচিত্রতা আনার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, কোম্পানিটির ইতোমধ্যে আইপিও ফান্ডের ১০০ শতাংশ টাকাই টিস্যু প্রজেক্টের জন্য ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে টিস্যুর রফতানিই কোম্পানিটির মূল লক্ষ্য। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ নিতেই কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা বছরে ৩০ হাজার মেট্রিকটন বাড়ানো হচ্ছে। নতুন মেশিন ব্যবহারের আগে বসুন্ধরা সব ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০ মেট্রিকটন।
বসুন্ধরা পেপার বসুন্ধরা শিল্প পরিবারের এ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গণণা করা হয়। এটি আগামীতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখবে বলে কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ১৯৯৩ সালে কোম্পানিটির যাত্রা শুরু হয়েছে। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ২০১৮ সালে। ৮০ টাকা কাট অব প্রাইসে কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ১৭৩ কোটি টাকা। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৭০.৮৬ শতাংশ শেয়ার, ৬.১৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
তবে কোম্পানিটির কর্মকর্তারা জানান, পাল্পের দাম বাড়ার কারণে এখন উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দেশীও কাগজ উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ পড়ছে। কারণ দুই বছর আগেও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন পাল্পের দাম ছিল ৫০০ ডলার। তবে দাম বেড়ে বর্তমানে তা প্রতি টন ৯০০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। দুই বছরের ব্যবধানে কাগজ তৈরির প্রধান কাঁচামাল পাল্পের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সেভাবে কাগজের দাম বাড়াতে না পারায় মুনাফা নিয়ে চাপের মুখে রয়েছেন স্থানীয় কাগজ উৎপাদকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের কাগজ শিল্পে ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যেও শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড। বর্তমানে তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে বিড়ি পেপার ও বুক প্রিন্টিং, বাল্ক পেপার, টিস্যু পেপার ও হেলথ এ্যান্ড হাইজিন ক্যাটাগরিতে ৫২ ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে তারা। সম্প্রতি বসুন্ধরা পেপার মিলসের কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছে কোম্পানিটি। পাশাপাশি আরও বেশিকিছু নতুন পণ্য বাজারে আনার প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি কাঁচামালের বাড়তি দাম সমন্বয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে কোম্পানিটি। এর সুফলও পেয়েছে তারা। গেল হিসাব বছরে উৎপাদন ব্যয় বাড়া সত্ত্বেও আগের বছরের তুলনায় বেশি মুনাফা হয়েছে কোম্পানিটির।
বসুন্ধরা পেপার মিলস ইউনিট-৩-এর হেড অব প্রজেক্ট প্রকৌশলী মোঃ আবুল হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের উৎপাদন ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। যদিও আমরা নিজেরা ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত কাগজ থেকে কিছু পরিমাণ পাল্প তৈরি করছি, কিন্তু সেটি আমাদের চাহিদার তুলনায় সামান্য। তাছাড়া পাল্প তৈরিতে প্রচুর গাছের প্রয়োজন, যা আমাদের এখানে অপ্রতুল। ফলে পাল্প আমদানি করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। আর আন্তর্জাতিক বাজারের দাম আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আমরা বিভিন্নভাবে কারখানায় উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছি। এই যেমন আমরা জেনারেটরের তাপ কাজে লাগিয়ে বাষ্প তৈরি করা, যন্ত্রপাতি যথাযথ মেইনটেন্যান্সের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোসহ কারখানায় ব্যবহৃত পানি পরিশোধনের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে বসুন্ধরা পেপার মিলসের ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ অবস্থিত। ১৯৯৩ সালে স্থাপিত ইউনিট-১-এ বিভিন্ন গ্রেডের হোয়াইট ও প্রিন্টিং পেপার, কার্বনলেস পেপার, অফসেট পেপার, র্যাপিং পেপার, এ ৪ পেপার, কালার লেজার পেপার, স্টিকার পেপার, সিগারেটের কাগজ, ওজিআর পেপার, এক্সারসাইজ বুক ও কাগজের ব্যাগ তৈরি হয়। তাছাড়া এখানে গ্লাসিন পেপার, পিপি ওভেন ব্যাগ, এমজি পেপার, কোটেড ও আনকোটেড বোর্ডসহ টিস্যু তৈরি করা হয়।
১৯৯৪ সালে স্থাপিত ইউনিট-২-এর আগের নাম ছিল বসুন্ধরা নিউজপেপার এ্যান্ড ডুপ্লেক্স বোর্ড লিমিটেড। এ ইউনিটে মূলত নিউজপ্রিন্ট, প্রিন্টিং পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, লিনার পেপার ক্রাফট পেপার, আর্ট কার্ড ও আর্ট পেপার তৈরি করা হয়। এ ইউনিটে দুটি ডি-ইনকিং প্লান্ট রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবহার্য ও পরিত্যক্ত কাগজ থেকে পাল্প তৈরি করে নতুন কাগজ উৎপাদন করা হয়। ডি-ইনকিং প্লান্টের দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ১২০ টন। বসুন্ধরা পেপার মিলের ইউনিট-২ এর জেনারেল ম্যানেজার (স্টোর) সুনীল কুমার চৌধুরী বলেন, ডি-ইনকিং প্লান্টের মাধ্যমে ওয়েস্টেড কাগজ থেকে নতুন কাগজ তৈরি করা হয়ে থাকে। ব্যবহারকৃত কাগজ, বিভিন্ন কাগজের বোড, দৈনিক পত্রিকা থেকে যেকোন ধরনের ব্যবহৃত কাগজ থেকেই এখানে কাগজ তৈরি করা হয়ে থাকে।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার আনারপুরে অবস্থিত বসুন্ধরা পেপার মিলসের ইউনিট-৩ ১৯৯৫ সালে স্থাপন করা হয়। আগে এর নাম ছিল বসুন্ধরা টিস্যু ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এটি দেশের প্রথম বেসিক টিস্যু তৈরির কারখানা। পাঁচটি প্রডাকশন লাইনের মাধ্যমে এ ইউনিটে বিভিন্ন ধরনের টিস্যু, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বেবি ডায়াপার, ডায়াপ্যান্ট, হ্যান্ডগ্লাভস, কটন বাড, ড্রিংকিং স্ট্র, টুথপিক, কাগজের কার্টন, এমজি পোস্টার পেপার, লেজার প্রিন্টিং পেপার, কালার প্রিন্টিং পেপার, লিনার পেপার, ম্যানিফোল্ড পেপার ও প্লাগ-র্যাপ পেপার তৈরি হয়।
বর্তমানে বসুন্ধরা পেপার মিলসের তিনটি ইউনিট মিলিয়ে বার্ষিক ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫০ টন টিস্যু ও পেপার, ৩৪ হাজার ৩০৮ টন পেপার, ১ কোটি ৮৯ পিস প্রিন্টিং, ১২ কোটি পিস পিপি ওভেন ব্যাগ ও স্যাক ব্যাগ, এক কোটি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, ৫ কোটি ৩৯ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ পিস বেবি ডায়াপার, ৮ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার পিস ডায়াপ্যান্ট, ১ হাজার ৬৬৭ টন স্ল্যাজ বোর্ড ও আড়াই কোটি পিস হ্যান্ডগ্লাভস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
বসুন্ধরা পেপার মিল ইউনিট-৩ এর হেড অব প্রজেক্ট প্রকৌশলী এস এম সারোয়ার বলেন, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত বসুন্ধরা পেপার। মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে পণ্য রফতানিই এখন কোম্পানির মূল লক্ষ্য। এতে কোম্পানিটির প্রতি আস্থা বাড়বে।
বসুন্ধরা পেপার মিলসের ২০১৭-১৮ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটি ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকার কাগজ ও কাগজজাত পণ্য বিক্রি করেছে, আগের বছরে যা ছিল ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেছে ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা আর বিদেশে রফতানি করেছে ৩৮ কোটি টাকার পণ্য। সর্বশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে বসুন্ধরা পেপার মিলসের ইউনিট-১ থেকে ৩৮১ কোটি টাকা, ইউনিট-২ থেকে ১৮১ কোটি ও ইউনিট-৩ থেকে ৫৬৯ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। এদিকে ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটির উৎপাদন খাতে ব্যয় হয়েছে ৮৯০ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৮১৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে ৬৯ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৩৮ কোটি টাকা।