ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্ত পাড়ের সাধারণের স্মৃতিতে একাত্তর ॥ মুর্শিদাবাদ

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ১১ মার্চ ২০১৯

সীমান্ত পাড়ের সাধারণের স্মৃতিতে একাত্তর ॥ মুর্শিদাবাদ

মুর্শিদাবাদ নবাবী ইতিহাসে আলোকিত এক হারিয়ে যাওয়া নগর। আমাদের আবেগের, ইতিহাসের এক বড় অংশের ঠিকানা। এক করুণ রঙিন ইতিহাস যার পরতে পরতে। ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত অবিভক্ত বাংলার শেষ স্বাধীন রাজধানী বিহার, উড়িষ্যা, বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁর সূত্রে নাম প্রাপ্তি ঘটেছিল এই শহরের। এই শহরের সঙ্গে সহবাস করে ইতিহাস। ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদের মুকুট থেকে রাজধানীর পালক ছিঁড়ে নিয়ে গিয়ে কলকাতার টুপিতে বসিয়ে দিয়েছিল ইংরেজরা। দীর্ঘ ৫৫ বছরের রাজধানী গরিমার হঠাৎ পতন আপাত বিষণ্ণতা উপহার দিয়েছিল এই শহরকে। তবে সেই সব মন খারাপ দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্ধত অবস্থান আজও নিজের মতো করেই। কাউকে পরোয়া না করার নবাবি মেজাজে এখনও এর বুক চিরে দৌড়ে বেড়ায় ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা গাড়ি। সৌজন্যে সেই ইতিহাস। নদীর এ পাড়ে লালবাগে, ইতস্তত নবাব-নামার চিহ্ন। ও পাড়ে, খোসবাগে বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত বুকে নিয়ে মাটির নিচে গভীর ঘুমে চির শায়িত বোহেমিয়ান নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজ, আলীবর্দী, কিংবা মুর্শিদকুলির মতো ঐতিহাসিক চরিত্র, স্থাপত্য, রাজধানী হিসেবে গৌরবময় ইতিহাস, পলাশী ষড়যন্ত্রের নানা চিত্রকমের্র বর্ণনা আর মিথের নগরী মুর্শিদাবাদ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহমর্মী হয়েছিল। জলাঙ্গি, কাহাড়পাড়া, লালগোলা সীমান্ত দিয়ে হাজারো শরণার্থীর শেষ আশ্রয়স্থল হয়েছিল এটি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমন সবকিছু মিলিয়ে কেমন ছিল সীমান্ত পাড়ের এই জেলা শহরটির একাত্তরের চিত্র। সেই সময়কে খুঁজে পেতে আমি বহরমপুর, জলাঙ্গী, ডোমকল, ইসলামপুর ও লালগোলার সীমান্ত গ্রামগুলোর পথে প্রান্তরে ঘুরেছি। নানাজনের স্মৃতি আর অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে একাত্তর। স্মৃতিনির্ভর সেসব গল্প থেকে ইতিহাস বিনির্মাণের চেষ্টা করেছি। বহরমপুরের পূর্ণিমা দাসগুপ্ত বলছিলেন, একাত্তর ছিল আমাদের দায়বদ্ধতার বছর, বাংলাভাষী মানুষগুলোর প্রতি আমাদের যে সহমর্মিতা সেটি ছিল মূলত একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা। সেই দায়বদ্ধতা থেকে একাত্তরে মুর্শিদাবাদ বহরমপুরে শরণার্থী সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ঈপ্সিতা গুপ্ত। পূর্ণিমা দাসগুপ্ত, ঈপ্সিতার স্বামী রাধারঞ্জন, ত্রিদিব চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে শরণার্থীদের আশ্রয়, আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন ঈপ্সিতা গুপ্ত। গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক মহিলা সমিতি।’ যে সংগঠন বাংলাদেশের গণআন্দোলনের সমর্থনে মুর্শিদাবাদÑবহরমপুরে বিশাল জনমতের সৃষ্টি করেছিলেন। ঈপ্সিতা গুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ৬ বেডের একটি ফিল্ড হাসপাতাল। আরএসপি নেতা প্রমথেশ মুখার্জি এগিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরিতে। একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতি মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষের বালকোপম, তীব্র আবেগপূর্ণ এক ভালবাসার জন্ম নেয়। এই তীব্র আবেগপূর্ণ ভালবাসায় একাত্তরে প্রায় সাত লাখ শরণার্থী আশ্রয় পেয়েছিল এখানে। দর্পনগর প্রাইমারি স্কুল, জিয়াগঞ্জের সরকারী অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল, মোহন্ত রামদাস আউলিয়া প্রাইমারি স্কুল, লালবাগের নিশাদবাদ প্রাথমিক স্কুল, মুকুন্দবাগ জুনিয়র বেসিক স্কুল, ডন বস্কো ইনস্টিটিউট, আজিমগঞ্জ, রাজা বিজয় সিং বিদ্যামন্দির হোস্টেল, আজিমগঞ্জ, এম এন একাডেমি, লালগোলা, হাবাসপুর প্রাইমারি স্কুল, বাগ ডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল, কালুখালী মাদ্রাসা ও প্রাইমারি স্কুল, ভগবানগোলা হাইস্কুল, ভগবানগোলা প্রাইমারি স্কুল, আসানপুর প্রাইমারি স্কুল, দারারকান্দি প্রাইমারি স্কুল, রাম চন্দ্রমতি প্রাইমারি স্কুলসহ মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাত্তরে পরিণত হয়েছিল শরণার্থী ক্যাম্পে। আমি বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সেসব ক্যাম্পগুলো। আজিমগঞ্জে কথা হচ্ছিল সমীরণ দাশের সঙ্গে। একাত্তরে শিক্ষা দফতরে কর্মরত সমীরণ বলছিলেন, একাত্তরের মে মাসে আমরা স্কুলগুলো থেকে শরণার্থী সরানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বন্যার স্রোতের ন্যায় শরণার্থী প্রবাহের ফলে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। জুলাই মাসে নতুন নতুন ক্যাম্প করে আমরা সরানোর উদ্যোগ নিই। কিন্তু স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।’ একাত্তরে মূলত রাজশাহী, পাবনা অঞ্চলের মানুষের প্রধান আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে মূলত শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়। স্থানীয় যুবকরা শেখের পাড়ায় ট্রানজিট শরণার্থী ক্যাম্প করে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। জেলা শাসক অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায় ১৪টি ক্যাম্প খুলে বিপন্ন মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। লালগোলায় স্থানীয় যুবকরা শরণার্থীদের জন্য আহার ও থাকার জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করে। অনেক শরণার্থী আশ্রয় নেয় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামের সামনে কথা হচ্ছিল আলমগীরের সঙ্গে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রিলিফ ক্যাম্পে কাজ করা আলমগীর বলছিলেন, যুদ্ধদিনের স্মৃতি। মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কথা। শরণার্থীদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে জামা কাপড় সংগ্রহের কথা। কলেরার মতো মহামারিতে শত শত শরণার্থী আক্রান্ত হচ্ছে। লাশের পর লাশ। এত বেশি লাশ সাংবাদিক জন সার লিখেছেন শকুনের অরুচি ধরে গেছে। কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষের অরুচি ধরেনি। মহামারি জানার পরেও শরণার্থীদের সেবা প্রদানের জন্য, কলেরার টিকা দিতে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে বেরিয়েছে শত শত স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক। জয়বাংলা রোগে বিপর্যস্ত ছিল জনজীবন। কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতার জয় বাংলা, জয় মুজিবের উদ্দীপিত হয়েছিল একাত্তরের বহরমপুর। একাত্তরে ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ। জলাঙ্গী, ডোমকল, ইসলামপুর তলিয়ে গিয়েছিল পানিতে। শরণার্থী ক্যাম্পে ছিল গলা সমান পানি। নৌকায় করে আসতে শুরু করল শরণার্থী। মুর্শিদাবাদে সীমান্ত এলাকা কাহারপাড়া। একাত্তরে এই সীমান্ত জনপদে আশ্রয় নিয়েছিল লক্ষাধিক শরণার্থী। ভয়াবহ বন্যা, কলেরাসহ নানাধিক রোগে প্রায় পাঁচ হাজার শরণার্থীর মৃত্যু ঘটেছে মুর্শিদাবাদের জলাঙ্গী, লালগোলা, কাহারপাড়া ও ডোমকলে। একটি চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল আনিস রহমান, আবু বক্কর, আমির শেখ, আনোয়ার উদ্দীন ম-লের সঙ্গে। যারা সবাই একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী। একাত্তরে এখানে সাহেবরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। বন্যায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়, সঙ্গে কলেরা। আনিস রহমান আমাকে নিয়ে যান জলাঙ্গী নদীর পাড়ে, সারি সারি বাঁশঝাড়, সারি সারি কবর। একাত্তরের নীরব ঘাতকের চিহ্ন। জানতে চাইলাম এখানে কত শরণার্থীর কবর আছে। আনিস রহমান বললেন, সেটা সংখ্যায় পরিমাণ করা যাবে না। একটি কবর খুঁড়ে আমরা ২০-২৫ জনকে একত্রে দিয়েছি। আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হলে কবর দেয়ার আর কোন জায়গা জলাঙ্গীতে ছিল না। কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে শত শত মৃতদেহ। একাত্তরে শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্ত একজন নন-রেজিস্টার্ড পল্লী চিকিৎসক মুর্শিদাবাদের জলাঙ্গীর বাশার মুন্সী। একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলছিলেন, ‘জলাঙ্গী, কাহাড়পাড়া সীমান্তে একাত্তরে ভয়াবহ কলেরা বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বিপুল শরণার্থী আক্রান্ত হয়েছিল কলেরায়। সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তার এমনকি ওষুধের ছিল তীব্র সংকট, সেই অন্তিমে আমরা স্থানীয় নন-রেজিস্টার্ড ডাক্তাররা দিন-রাত ঘুরে বেরিয়েছি ক্যাম্পে ক্যাম্পে। সেবার পদ্মার পানি রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। শরণার্থীদের আমরা কোমর সমান পানি অতিক্রম করে চিকিৎসা দিয়েছি।’ আশ্রয় দিতে গিয়ে একসময় বিপন্ন হয়েছে আইনশৃঙ্খলা, স্বাভাবিক জীবনযাপন। ১৫ মে ১৯৭১ দৈনিক যুগান্তর সে রকম এক সংবাদ তুলে ধরেন, ‘শুধু আশ্রয় প্রার্থীরা নয়, আশ্রয়দাতারাও বিপন্ন।’ পূর্ববঙ্গের ভয়াবহ কলেরা একসময় স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, স্থানীয় অনেকে এতে মারা যায়। সীমান্ত এলাকাগুলোতে নিয়মিত পড়তে থাকে পাকিস্তানী গোলা। শরণার্থীদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল মুর্শিদাবাদের অনেক ক্লাব ও সামাজিক-ক্রীড়া সংগঠন। জুলাই মাসে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এবং আগস্টে জলাঙ্গীতে একটি ফুটবল ম্যাচের সংবাদ পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদের জলাঙ্গীর নিত্যানন্দ বন্দোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘আগস্ট ১৯৭১, মুর্শিদাবাদ ডুবে গেছে অথৈই পানিতে, শরণার্থীদের ভয়াবহ অবস্থা, একদিকে কলেরা, অন্যদিকে বন্যার পানি। সঙ্গে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার, স্বজন হারানোর দুবির্ষহ স্মৃতি। সে সময়ে আমরা ঠিক করলাম কিছু একটা করতে হবে, এদের স্বাভাবিক করতে হবে। আমরা বেশ কিছু উদ্যেগ নিয়েছিলাম, ফুটবল ম্যাচের আয়োজন তার একটি।’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে ১৬ জুলাই ১৯৭১ জুমার নামাজের পর বিশেষ মুনাজাতের আয়োজন করেছিল মুর্শিদাবাদের কাঁহারপাড়া জামে মসজিদের ইমাম। মোনাজাতে শরিক হয়েছিল স্থানীয় সকল মুসল্লি। জলাঙ্গীর আবদুর রউফ বলছিল, আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুজিবের মুক্তি চেয়ে মিছিল করেছি, ভুট্টোর কুশপুতুল দাহ করেছি। কিন্তু কেন? মানবিকতা কি এর একমাত্র কারণ ছিল? নাকি ভাষার আবেগে আকুল হয়েছিল মুর্শিদাবাদ। কাঁটাতর ধরে হেঁটে সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী জানতে চেয়েছিল একাত্তরে তাদের এই পাশে দাঁড়ানোর কারণ। নানাজনের উপস্থাপন ছিল ভিন্ন, কিন্তু সবাই এক উত্তরে স্থির। ফেলে আসা দেশের টান আর ভাষা একাত্তরে এখানে জনযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। একাত্তরে কবি শুভ্রশঙ্কর তাই লিখেছেন- ‘এবার মুর্শিদাবাদে নয়, বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায়; শেষ ফয়সলা চলছে।’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার পথে-প্রান্তরে মানুষের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল একাত্তর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা শরণার্থীর স্মৃতি। এখনও বাংলাদেশ তাদের আবেগ, অনুভূতিতে শিহরণ জাগায়, স্মৃতিকাতরতার জন্ম দেয়। যেই স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে শক্ত ভিত্তি পায় জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক। ভাষা শহীদ বরকতের স্মৃতিধন্য মুর্শিদাবাদের সাধারণের অসাধারণ সহায়তা, সহমর্মিতা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মানবিক ইতিহাস। লেখক : শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×