ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর পাকুরিয়া

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ১১ মার্চ ২০১৯

 নওগাঁর পাকুরিয়া

নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, আত্রাই নদীর তীরে, মান্দা উপজেলার শান্ত-স্নিগ্ধ একটি গ্রামের নাম পাকুরিয়া। ১৯৭১ সালের ২৮ আগস্ট পাকহানাদার বাহিনী এই গ্রামে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। দিনটি ছিল শনিবার। ভোরবেলা পাকিস্তানী বাহিনী রওনা দেয়। তারা দেলুয়া বাড়িতে গাড়ি রেখে পাকুড়িয়া গ্রামে প্রবেশ করে। কারণ, গ্রামের ভেতরে গাড়ি প্রবেশের কোন রাস্তা ছিল না। তখন রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা এবং সেই সময় বর্ষাকাল হওয়ার কারণে বন্যায় সবকিছু ডুবে গিয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনী মানুষের বাড়ির ভেতর দিয়ে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করে। অনেকেই সে সময় ঘুম থেকে ওঠেনি। তারা অতর্কিতভাবে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করে এবং যাকে যেখানে পায় সেখান থেকেই ধরে নিয়ে যেতে থাকে স্কুল মাঠে, মিটিং-এর নাম করে। পাকিস্তানী বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় প্রত্যেক বাড়ি থেকে লোকজন ধরে আনতে থাকে। একই সঙ্গে বাড়িঘর লুটপাট করে এবং বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে ঘরের ভেতরে থাকা বুলন বেওয়া নামে একজন বৃদ্ধ মহিলা আগুনে পুড়ে মারা যান। সে সময় তার বাড়িতে তিনি ছাড়া অন্য কেউ ছিলেন না। গ্রামের লোকজনকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মিটিংয়ের কথা বলে ধরে আনতে থাকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। প্রায় ৩০০-৪০০ গ্রামবাসীকে স্কুল মাঠে ধরে আনার পর তাদের মধ্যে চলে জিজ্ঞাসাবাদ। মমতাজউদ্দিন (৬৫) তখন ছিলেন স্কুলছাত্র। তার সামনেই তার বাবা ও চাচাকে কপালে গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর অল্প বয়সের ছেলেদের এবং বৃদ্ধ বয়সের লোকজনকে মিলিটারিরা ছেড়ে দেয়। তারপর বাঁশের ঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে এনে সবাইকে অনেক মারধর করে। সবাইকে কালেমা পড়তে বলে। সবাই জোরে জোরে কালেমা পড়তে শুরু করেন। তারা সবাই সেদিন এত জোরে জোরে কালেমা পড়েছিল যে, পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজনেরা বলেছিল তারা সেদিন পাকুড়িয়া গ্রাম থেকে শোরগোলের শব্দ পেয়েছিল। তারপর পাকিস্তানী মিলিটারিরা সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে বন্দুক দিয়ে একধার থেকে গুলি করা শুরু করে। এতে প্রায় ১৫-১৬ জন শহীদ হন। তারপর যারা জীবিত ছিলেন মেশিনগান ফিট করে এক মুহূর্তের মধ্যে তাদের সবাইকে হত্যা করে ঘাতকের দল। গ্রামের অসহায় মানুষেরা অনেকেই সেদিন জীবন-ভিক্ষা চেয়েছিল হায়েনার দালের কাছে। কোন আকুতি-মিনতিই তাদের কানে পৌঁছায়নি। বিনোদ আলীর সামনে তার দুই ছেলে মকবুল ও নজরুলকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। বিনোদ আলী বৃদ্ধ বয়সের ছিলেন বলে তাকে চলে যেতে বলে পাকিস্তানীরা। কিন্তু চোখের সামনে ছেলেদের মৃত্যু তিনি সহ্য করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘হামার ছেলেরক মারে ফেলছেন, হামিকিষক বাঁচে থাকমু, হামাকে মারে ফেলো’। সঙ্গে সঙ্গে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। স্কুল মাঠে তারা ১২৮ জনকে হত্যা করে। তার মধ্যে থেকে ১৭ জন জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসেন। মানবেতরভাবে তাদেরকে পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছিল। পাকুরিয়া গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ থেকে প্রকাশিত গণহত্যা-নির্যাতন গ্রন্থমালা সিরিজের ‘পাকুরিয়া গণহত্যা’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির লেখক মৌসুমী রহমান এবং প্রকাশকাল ভাদ্র ১৪২৫/আগস্ট ২০১৮। লেখক : আর্কিভিস্ট, গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা
×