ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

রাজায় রাজায় ফ্যাকাসে যুদ্ধ!

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

রাজায় রাজায় ফ্যাকাসে যুদ্ধ!

দোস্ত কাইল কিন্তু সকাল সকাল যামুগা। খেলা কয়ডায়? সন্ধ্যা সাড়ে ছয়ডায়। আমি নাস্তাডা সাইরাই দৌড় দিমু। বড় ভাইগো লাইগা আবার জাগা রাহন লাগবো। হালায় আমাগো একটা আবার কার্ড খাওয়া। খেলতে পারবো না। আগের ম্যাচে শেষ মুহূর্তে তোর ফাউল করার কোন দরকার আছে? টিমডারে পুরা বেকায়দায় ফালাইয়া দিছে। খেলার পরের দিন কাইল্লা হালায় এতো গিলি ফাঁকা নেট পাইলো, মাগার কাম করবার পারল না। আর সাদাডা পুরা খাসি। মনে হইলো রাইত কানা। হুদাই দৌড়াইলো। দু’বন্ধুর কথোপকথন। শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা ১৯৮০-৯০ দশকের মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচের খেলার আগের দিন এবং পরের দিনের কথাবার্তা। এরকমই আলোচনা হতো এই দুই দলের খেলার আগে এবং পরে। সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় খেলা হলে স্টেডিয়ামের গেট দুপুর ১২ টায় বন্ধ। কতজনের কাছ থেকে টিকিট কেটে ঢুকতে না পারার কষ্টের কথা শুনতে হয়েছে। স্টেডিয়াম চত্বরে গ্যালারি গ্যালারি চিৎকারে ব্ল্যাকারদের টিকিট বিক্রির দৃশ্য ছিল তখন নিত্যদিনের। স্বাধীনতার আগে থেকে দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা থাকলেও স্বাধীনতার পর তা জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। বিশেষ করে আবাহনী আসার পর থেকেই চির শত্রুতে পরিণত হয় ঢাকা মোহামেডানের। ফুটবলে এই দুই দলের প্রথম মোকাবেলাতেই প- হয়ে যায় ম্যাচ। এরপর থেকে আবাহনী-মোহামেডান শুধু ফুটবল নয় হকি ক্রিকেট ছাড়াও যে কোন ম্যাচে উত্তেজনার রেশ বয়ে যেত। দলবদলের সময় দেখা যেত অন্য রূপ। কিভাবে খেলোয়াড়কে অন্য দলের চোখকে ফাকি দিয়ে বাগিয়ে আনতে হবে, তা ছিল দেখার মতো। ১৯৮০ সালে দলবদলের সময় বিজেআইসির স্ট্রাইকার সালামকে সেই আরিচা থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে ঢেকে ডামফা অফিস পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল ঢাকা মোহামেডান। ঘটনা এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। সই করার সময় বিজেআইসির এক কর্মকর্তার সঙ্গে বাকবিত-া শুরু হয়। পরে তা হাতাহাতি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। হাতাহাতিতে সেই কর্মকর্তার নাক পর্যন্ত ফাটিয়ে দেওয়া হয়। ফুটবলে মোহামেডান-আবাহনী যুদ্ধটা ২০০০ সাল পর্যন্ত চলেছিল। এরপর জৌলুসটা আস্তে আস্তে ম্লান হতে দেখা যায়। খেলার আগের দিন থেকে খেলার দুই তিনদিন পর্যন্ত আলোচনা চলতো বাসা অফিস আর রেস্টুরেন্টে। খেলার দিন বাড়ির ছাদ পাড়া মহল্লা এমনকি প্রধান রাস্তার দুই ধার ছেঁয়ে যেত সাদাকালো আর আকাশী হলুদ পতাকায়। আজ সব গল্পের মতো মনে হয়। দুদলের খেলা থাকলে এখন অনেকেই জানে না। টিভিতে খেলার খবরে যখন দেখেন মাঠে আজ লড়েছে মোহামেডান-আবাহনী তখন অনেকই চমকে উঠেন। হতভম্ব হয়ে যান খেলার ফুটেজ দেখে। দর্শকবিহীন গ্যালারি যেন মনটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। অনেকের মতে এই দুই দলের খেলতে আগে গ্যালারিতে যত হকার হতো আজকাল সেই পরিমাণ দর্শক হয় না। মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ অথচ অনেক ফুটবল সমর্থককে প্রশ্ন করতে শোনা গেছে, ‘ভাই কার কার খেলা হচ্ছে?’ মোহামেডানের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক আকরাম শাহিন জানিয়েছেন, ১৯৮৬ সালের লীগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ। তিনি সুদূর কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এসে খেলা দেখেছেন। খেলার আগের দিন তার মা তাকে ঘরে তালা মেরে রাখেন যেন খেলা দেখতে না যেতে পারেন। আকরাম শাহিন খালাতো ভাইকে পাঁচ টাকা ঘুষ দিয়ে তালা খুলে রাতের গাড়িতে ঢাকা চলে আসেন। এমন কাহিনী অনেক আছে। তবে আজকাল তা আর শোনা যায় না। দুই দলের এত দর্শক সব গেলো কোথায়? ভাবতে অবাক লাগে ১৯৮৭ সালে মোহামেডান-আবাহনী তথাকথিত লীগ ফাইনাল রিপ্লে ম্যাচ নিয়ে দেশের মানুষ শঙ্কিত ছিলো । খেলার মাঠে বড় কোন অঘটন ঘটতে পারে এই চিন্তায় ওই ম্যাচ দর্শকশুন্য আর্মি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। অথচ সেই মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ এখন এমনিতেই প্রায় দর্শক শুন্য মাঠেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সমর্থক কিংবা সাধারন মানুষের মনে কোন রকম শঙ্কা বিরাজ করে না। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে কি আমাদের দেশের দুই জনপ্রিয় দল মোহামেডান-আবাহনী তাদের নিজস্ব সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে? নাকি এই দুই দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন ক্লাবের আবির্ভাব? অনেকে হয়ত তাই ভাবছেন। যদি তাই হয় তাহলে তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা যেতে পারে নতুন আবির্ভাব হওয়া ক্লাবগুলোর খেলায় দর্শক কোথায়? ১৯৮০-৯০ দশকে এই দুই দলের প্র্যাকটিস ম্যাচ দেখার জন্য যে পরিমাণ দর্শক হতো সে পরিমাণও দর্শক মাঠে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফুটবল হকি ক্রিকেট তিন বিভাগেই দাপট ছিল ক্লাব দুটির। দুই দলের মোকাবেলায় কত না আয়োজন করে সব খেলা দেখতে মাঠে ছুটতো। বিদেশী খেলোয়াড় সংগ্রহের ব্যপারে আবাহনী সর্বদাই এগিয়ে ছিল। ১৯৮৭ সালে ইরাকের বিশ্বকাপের ফুটবলার সামির সাকির আর করিম মহাম্মদকে উড়িয়ে আনেন। পক্ষান্তরে মোহামেডানও বসে থাকেনি। তারা কোচ কাম খেলোয়াড় হিসেবে নিয়ে এসেছিল ইরানের ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করা গোলরক্ষক নাসের হেজাজি কে। সঙ্গে ছিল নালজেগারের মতো কুশলী ফুটবলার। ক্রিকেটে আবাহনী ইংলিশ ক্রিকেটার নেইল ফ্রেয়ার ব্রাদার আর রিচার্ড ইলিংওয়ার্থকে এনে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। হকিতে আবাহনীতে দেখা গিয়েছিল ভারতীয় খ্যাতিমান হকি খেলোয়াড় ধনরাজ পিল্লাইকে। মোহামেডানও কম নয়। তারা খেলিয়েছে ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও সনাথ জয়সুরিয়ার মতো ক্রিকেটারকে। হকিতে খেলিয়েছে ‘হকির ম্যারাডোনা’ খ্যাত পাকিস্তানের শাহবাজকে সঙ্গে ছিল তাহির জামান। দুই দলের জনপ্রিয়তা দেখে বিদেশী খেলোয়াড়রা পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতেন। ১৯৯৯ সালের মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ। খেলা মিরপুর মাঠ। মতিঝিল থেকে এক মোহামেডান সমর্থক পংকজ রয় যাবে খেলা দেখতে। হিসেব কসে দেখেন মাঠে পৌঁছতে পৌঁছতে তার ১০/১৫ মিনিট খেলা দেখা মিস হবে। বাসায় ২/৩ টা রেডিও। কিন্তু বাসায় গেলে আর খেলা দেখা হবে না। তাই বাসায় রেডিও থাকা সত্ত্বেও স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ২১০ টাকা দিয়ে রেডিও কিনে বেবি ট্যাক্সিতে করে রওনা দেন। শ্যাওড়াপাড়া যেতে না যেতেই খেলা শুরু হয়ে যায়। স্টেডিয়াম যেতে যেতেই পর পর দুই গোলে এগিয়ে যায় মোহামেডান। অবশেষে ৩-০ গোলে জয়লাভ করে তার দল। রেডিও কেনার ২১০ টাকার শোক ভুলে যান। এমন অনেক মজার মজার স্মৃতি আছে দুই দলের সমর্থকদের। আবাহনী-মোহামেডানের এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন সরকার গলফ টুর্নামেন্টের আয়োজন করেন যেখানে এই দুই দলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবাহনী ফুটবল হকি ক্রিকেটে নিয়মিতই শিরোপার দেখা পাচ্ছে কিন্তু মোহামেডান যেন কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মোহামেডান অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যেতে পারে বলেই খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের ধারণা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আজ সেই মোহামেডান-আবাহনীর ফুটবল ম্যাচ। অনেক সাবেক খেলোয়াড়রা হয়ত এই খবর জানেন না। তবুও মাঠে গড়াবে, খেলা হবে কিন্তু গ্যালারির আসনগুলো খুঁজে বেড়াবে সমর্থকদের। মোহামেডান-আবাহনী একটা সময় দুই প্রান্তের দুই রাজা। যুদ্ধ হতো দুই দলের। সারা দেশ বিভক্ত হতো দুই ভাগে। স্কুল কলেজ, পাড়া মহল্লা, অফিস আদালত কিংবা রেস্টুরেন্টে খেলার আগের দিন থেকে খেলার পর তিন চার দিন পর্যন্ত চলতো মুখরোচক আলোচনা। বিংশ শতাব্দী শুরু হতে না হতেই তা হারিয়ে গেছে। এখন দুই প্রান্তের দুই রাজা আছে। পাইক পিয়াদা নেই। দুই রাজার মাঝে এক রাজার কিছুটা হুংকার থাকলেও অপর রাজার যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতই দিন কাটাচ্ছে। তাই আগে সেই রাজায় রাজায় ময়দানি জমজমাট যুদ্ধ হলেও আজ যেন যুদ্ধের রংটা বড়ই ফ্যাকাশে!
×