ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থকরি কৃষিপণ্য হিসেবে বাড়ছে ফুলের বাজার

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অর্থকরি কৃষিপণ্য হিসেবে বাড়ছে ফুলের বাজার

উৎসবপ্রিয় বাঙালীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সারা বছর লেগেই থাকে। এসব উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় ফুলের গুরুত্ব বেড়েছে। ভালবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখে দেশব্যাপী ব্যাপক আয়োজনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান যেন ফুল ছাড়া চলেই না। আধুনিক মনস্ক মানুষের রুচির পরিবর্তনে এখন ঘরেও মানুষ তাজা ফুল রাখতে পছন্দ করে। এসবকে কেন্দ্র করেই বড় হচ্ছে ফুলের বাজার। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালবাসা দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের ফুল বিক্রির টার্গেট ২০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালিতে ফুল বিক্রির টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। বাকি ফুল বিক্রি হবে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা শহরগুলোতে। আধুনিক সমাজে ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে শুধু শৌখিনতায় নয়- ফুল এখন বিরাট অর্থকরী ফসল। সময়ের চাহিদার আলোকে দেশের অর্থনীতিতেও ফুলের অবদান ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ফুলের বাণিজ্যিক প্রসার খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকের আগে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। মাত্র দু’দশকের পথচলায় ফুল বাণিজ্য অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। জানা গেছে ১৯৮২-৮৩ অর্থবছর থেকে দেশে ফুল অর্থকরী ফসল হিসেবে বিবেচিত করা হচ্ছে। এরপর থেকে বাড়ছে ফুলের বাণিজ্য। বাড়ছে কর্মসংস্থান। দেশের গন্ডি বিদেশেও রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ফুল। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। কৃষিভিত্তিক পণ্য হিসেবে ফুলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সারা পৃথিবীতে ফুলের বাজার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে সার্বিকভাবে ফুলের বাজার মূল্য প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। একসময় শুধু যশোরে ফুলের চাষ হতো। জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২০টি জেলায় কমবেশি ১২ হাজার হেক্টর জমিতে ফুল চাষ হচ্ছে। গত চার দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় যশোর ও ঝিনাইদহ জেলায়। এসব এলাকার মধ্য রয়েছে- ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, সাভার, গাজীপুর, সাভার, ময়মনসিংহ, রংপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মেহেরপুর, রাঙ্গামাটি, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, মানিকগঞ্জ ও নাটোর। কেন্দ্রীয় ফুল বিপণন কেন্দ্র ঢাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অধিকাংশ ফুলই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্রি হয়। ঢাকার শাহবাগ ও আগারগাঁওয়ে রয়েছে পাইকারি ফুলের বাজার। খুচরা বিক্রেতারা এসব জায়গা থেকে ফুল কিনে শহরে ছড়িয়ে পড়েন। ফুলের ব্যাপক চাহিদা ও বিরাট সুযোগ থাকার পরেও ফুল বিক্রির জন্য ঢাকায় কোন কেন্দ্রীয় বাজার নেই। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে ফুলবাজার নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন ফুল বিক্রেতারা। আশার খবর হলো এরই প্রেক্ষিতে রাজধানীর গাবতলীতে প্রায় দেড় একর জমির ওপর দুইতলা ভবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে ফুল চাষীদের জন্য স্থায়ী বাজার তৈরি হচ্ছে। ভবনটি হবে সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামো, সংরক্ষণ ও পরিবহন সুবিধার মাধ্যমে ফুল বিপণনে সহায়তা প্রদান প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। আশা জাগাচ্ছে বিদেশী ফুলের চাষ বাংলাদেশে ফুলের সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে। বিশ্ব বাজারে অনেক জাতের ফুল আছে। কিন্তু দেশে ফুলের বেশি একটা জাত নেই। দেশে প্রতিনিয়ত ফুলের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে ফুল এনে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। এই অবস্থা কাটাতে দেশে বিদেশী ফুল চাষে আগ্রহ বাড়ানো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফুল চাষীরা বিদেশী ফুল চাষে অধিক লাভ পাওয়ায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এই উদ্যোগ পুরোমাত্রায় বাস্তবায়িত হলে সারা বছর বিদেশী প্রজাতির বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ করে দেশের চাহিদা মেটানোর পর রফতানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির কর্মকর্তাদের মতে, রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকার মতো ফুল চাষে দেশের কৃষকরা অনেক আগে থেকেই সিদ্ধহস্ত। ফুলের বিশেষায়িত বাজার ও সংরক্ষণাগার হচ্ছে যশোরে দেশে ফুল চাষের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত অঞ্চল যশোর। গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরাসহ ১১ প্রজাতির ফুল সারা বছর চাষ হয় এখানে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিবস ঘিরে ভাল ব্যবসা করলেও বছরের অন্যান্য সময় ফুল সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব ও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় চাষীদের। এ অবস্থায় ফুলচাষীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে ফুলের বিশেষায়িত বাজার ও সংরক্ষণাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। জানা গেছে, কৃষি উন্নয়ন অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ফুলের বাজারটি নির্মাণ করা হবে। সেখানে আধুনিক মোড়কীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা হবে ফুলের বাজারজাত প্রক্রিয়ায়। এর ফলে শ্রমের ন্যায্যমূল্যও পাবেন চাষীরা। গদখালীর বিশেষায়িত ফুলের বাজার ছাড়াও যশোরের গ্রামাঞ্চলে আরও ১২টি আধুনিক বাজার ও ১২টি কালেকশন সেন্টার নির্মাণ হবে এলজিইডির কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়। এসব বাজার ও সেন্টারে চাষীদের উৎপাদিত সবজি ও ফুল আনা-নেয়ার সুবিধার্থে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা। ২০১৯ সালের মধ্যেই সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে কৃষকদের নিরাপদ ফুল ও সবজি উৎপাদনে সহযোগিতা করা হবে। ফুলের রাজধানী গদখালী যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে যেতে ছোট জনপদ গদখালী। ঝিকরগাছা উপজেলা সদর থেকে পশ্চিমে অবস্থিত এই জনপদটির মাঠের যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। এখানকার প্রায় ৪০টি গ্রামে উৎপাদিত হয় রজনীগন্ধা, গোলাপ, গ্ল্যাডিওলাস ও জারবেলাসহ বিভিন্ন ফুল। অন্যান্য অর্থকরি ফসলের পাশাপাশি ফুল চাষ করেও যে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া যায় তা করে দেখিয়েছেন গদখালীর মানুষ। অনুসন্ধানে জানা যায়, গদখালীতে ফুলের চাষ শুরু হয় ফুল চাষী শের আলীর হাত ধরে। ১৯৮৩ সালে তিনি ভারত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বীজ এনে গদখালীতে চাষ শুরু করে, পরে তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের অন্য কৃষকগোষ্ঠী শুরু করে তাদের ফুল চাষের বিপ্লব। শের আলী এরপর সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে অনেক ফুলের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করেন। এখন ঝিকরগাছার দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ। এখানে বিঘা প্রতি সিজনে কৃষকরা আয় করেন প্রায় ৫-৭ লাখ টাকা। রফতানি বাজারে সম্ভাবনা বিশ্ব ফুলের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুল বাংলাদেশের রফতানির তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে। দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল ও বাহারি লতাপাতার গাছ উৎপাদন স্থানীয়ভাবে বাজারজাতকরণ এবং রফতানির তালিকায় একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আশা জাগিয়েছে। জানা যায়, ১৯৯১-৯২ অর্থবছর থেকে ফুল রফতানির জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র মতে, ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের ১২ হাজার টাকা, ১৯৯৪-৯৫ সালে ১৬ হাজার টাকা ফুল রফতানি হলেও ২০০৫ সালে রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ কোটিতে দাঁড়ায়। ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এদেশ থেকে ফুল রফতানি হয়েছিল ২৭৬ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০০৯-২০১০ সালে ৩২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং ২০১০-২০১১ সালে ৩৬২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশের কাঁচা ফুল মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, পাকিস্তান, ভারত, ইতালী, কানাডা, চীন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ফ্রান্সে রফতানি করা হচ্ছে। বিশ্বে ১৬ হাজার কোটি ডলারের বিশাল ফুলের বাজারে আরও বড় আকারের রফতানি প্রবেশের সুযোগ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্যে। তবে উদ্যোক্তাদের অভিমত, কাঁচা ফুল রফতানি করে ৫০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
×