ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর জীবন লড়াই

প্রকাশিত: ১২:০৭, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর জীবন লড়াই

অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়, মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার করুণ আখ্যানেই শুধু নয় বীর বাঙালীর বহু মানুষের অকৃত্রিম দেশপ্রেমে স্বাধীন হওয়া এই দেশটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত না হওয়ার নিঃস্বার্থ সমর্পণে এগিয়ে যাওয়া নিবেদিত কর্মীর জীবনালেখ্য যেমন বিচিত্র একইভাবে প্রতিদিনের সংগ্রামী অভিযাত্রাও বটে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই মনে পড়ে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রারম্ভিক সব অগ্নিঝরা সময়কে। ভাষা, ঐতিহ্য আর আবহমান বৈভবকে তার আপন মর্যাদায় টিকিয়ে রাখতে যে লড়াই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নিষ্পেশন থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষার বীজও বপিত হয় তখন থেকে। পঞ্চাশ আর ষাটের দশক ছিল বাংলাও ভাঙালীর ঐতিহাসিক দুর্গম পথযাত্রার এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। যে সংগ্রামী অভিগমনে সময়ের দুর্বার মিছিলে রক্তক্ষয়ী সম্মুখ সমরকে আলিঙ্গন করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে যাদের বৈপ্লবিক ভূমিকা আজও অম্লান চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ছালেহ আহমদ তাদের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের এই নিবেদিত সংগঠক ’৬০-এর দশকের অগ্নিস্নাত দিনগুলোতে তার সংগ্রামী অভিযোজনকে যে মাত্রায় শাণিত করে ’৭০-এর নির্বাচনে সেই বাঙালিত্ব বোধের তাড়নায় বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’র প্রত্যয় নিজের আদর্শিক চেতনাকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করেনি। আর ’৭১ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের নয় মাস ছিল এই বীর মুক্তি সেনানির প্রতিদিনের লড়াকু জীবনের এক অবিস্মরণীয় কাল পর্ব। গৃহহীন, পরিবারহীন জীবন, আত্মগোপনের দুঃসহ পথযাত্রা কোনভাবেই নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন ছিল না। চট্টগ্রামের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে নিজের বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্নিঝরা মুহূর্তগুলো জীবন আর আদর্শিক চেতনায় এক সুতায় গেঁথে নেন। রাতের অন্ধকারে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নজর এড়িয়ে সতর্ক আর সঙ্গোপনে পারিবারিক আঙিনায় পা রাখতেন। কোন এক সময় চলেও যেতে হতো সে সময়ের ঠিকানায়। এভাবে নয়টি মাস পার করতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের এই নেতাকে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্তি হলো হানাদার বাহিনীর কবল থেকে। বিজয় নিশানায় সারা বাংলাদেশ উৎসব আর আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলো। ছালেহ আহমদও স্বাধীন ভূমিকে পারিবারিক আবহে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে এই বীর সংগ্রামী নেতা শ্বাসকষ্ট আর হৃদযন্ত্রের ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। স্ত্রী ফেরদৌস আরা ছিলেন স্বামী পরায়ণ চার পুত্র সন্তানের জননী। শ্বশুর তখন অবধি বেঁচে ছিলেন। সত্তরোর্ধ পিতার সামনে সন্তানের মরদেহ। এক অবর্ণনীয় করুণ আখ্যান তো বটেই। তার চেয়েও বেশি মর্মান্তিক হলো সদ্য বিধবা হওয়া স্বল্প বয়সী ফেরদৌসের চার বালক সন্তানদের নিয়ে কঠিন জীবনের দুর্বিপাকে পড়া। বড় ছেলে তারেক সোলায়মানের বয়স মাত্র ১২ বছর। বাকি তিনজন আরও ছোট। কী এক অদম্য শক্তিতে এই স্বামীহারা নারী তার চার পুত্র সন্তানকে নিয়ে যে সংগ্রামী অভিযাত্রায় পা রাখলেন তা জীবন লড়াইয়ের এক স্মরণীয় দিন যাপন। যে বয়সে অনেক মেয়ের বিয়েও হয় না। সে বয়সে একজন টগবগে যুবতী তার স্বামীকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখল। এক দুঃসহ অনুভবে কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার অসহনীয় অভিজ্ঞতা। চার পুত্র সন্তানকে নিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করলেন। কতিপয় শুভাকাক্সক্ষী অবশ্যই পাশে দাঁড়ালেন। তা না হলে এই অসহায় নারী তার চার সন্তানকে নিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতেও সময় লাগত না। তবে অনেক নিকটজনেরা যে মাত্রায় কষ্টে, দুঃখে জীবনেকে দুর্বিষহ করে তুলত সে সব ঘটনা এই প্রত্যয়ী নারীকে এখনও পীড়া দেয়। কোন এক সময় ভেতরের অন্তর্নিহিত শৌর্যে ঘুরে দাঁড়ালেন। ভাবলেন পেছনের দিকে তাকিয়ে স্বামীর শোকে ভাসলেই শুধু চলবে না বর্তমানে চোখের সামনে চার ছেলের ভবিষ্যতের দিকেও তাকাতেই হবে। সে অকৃত্রিম বোধ আর তাড়নায় ছেলেদের জীবন গড়ার লক্ষ্যে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। এরপর শুধু সামনে এগিয়েই চলা। ছেলেদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে স্বাবলম্বী হওয়াই শুধু নয় সততায় ও নিষ্ঠায় ভাল মানুষ হতে সব ধরনের প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাদের লালন করাও এই লড়াকু নারীর সামনে চলার জীবনের ব্রত হয়ে থাকল। ছেলেরা বড় হচ্ছে নিজেও প্রতিদিন শক্তি আর সাহস সঞ্চয় করে পুরো সংসারের ভিত্তি মজবুত আর সংহত করা ছাড়া অন্য কোন দিকে সময় দেয়ার সুযোগই ছিল না। বয়োসন্ধিকালে সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক গড়নকে নতুন মাত্রা দিতে আরও বৃহৎ এবং সময়োপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে তৎপর হওয়া জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। নজর দিলেন ছেলেদের নিয়ে শিশু-কিশোর ‘খেলাঘরে’র মতো একটি শুদ্ধ বলয় তৈরি করাও ফেরদৌস আরার জীবনের চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ল। উদ্দীপ্ত চেতনায় নবোদ্যোমে শুরু করলেন নিজ বাসভবনে ‘জুঁই খেলা ঘরে’র নতুন আসর। আশপাশের উদীয়মান কিশোরদের সঙ্গে নিয়ে জুঁই খেলাঘরের নবতম শাখা তার চলার পথ অবারিত করে। সঙ্গে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত হওয়া মন ও মননের অকৃত্রিম বোধ, নিষ্ঠা আর সততার উদ্দীপ্ত আলো। আজ সদর্পে এগিয়ে চলা এই লড়কু নারীর জীবন সফলতায় পরিপূর্ণ। চারটি সন্তানই স্বাবলম্বী এবং নিজ নিজ জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে তারেক সোলায়মান সেলিম পিতার রেখে যাওয়া সামান্য সহায়সম্পত্তি রক্ষা করাই শুধু নয় সুশিক্ষিত হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ানো এমনকি আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত সংগঠকের ভূমিকায় নিজের অংশীদারিত্বকেও প্রমাণ করল। আজ সেলিম চট্টগ্রামে তার নির্বাচনী এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তবে সততা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং পিতার আদর্শিক বোধ সব সময়ই পুরো পরিবারকে এক অবিচ্ছিন্ন মাত্রায় সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। প্রতিটি সন্তানই আজ সফল এবং কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। সত্তরোর্ধ এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জীবনের সংগ্রামী অভিযাত্রাকে যে মাত্রায় শাণিত করেছেন সেখানে সন্তানরা শুধু যথার্থ মানুষ হিসেবেই নিজেকে তৈরি করেনি তার চেয়েও বেশি একজন দক্ষ, সৎ এবং আদর্শ নিষ্ঠ সুনাগরিকের মর্যাদায় নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে দৃঢ় ও প্রত্যয়ী করে তোলে। আর এই জীবনযুদ্ধে সফল হওয়া উদ্দীপ্ত মা আজও ছেলেদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তই শুধু নয় অনবদ্য মহিমান্বিত মাতৃশক্তিও বটে। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×