ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

অধিনায়ক কোহলির অনন্য কীর্তি

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

অধিনায়ক কোহলির অনন্য কীর্তি

নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতল ভারত। সিডনির শেষ টেস্টটি বৃষ্টির কারণে ড্র হয়। তাতে অবশ্য ইতিহাসগড়া আটকায়নি বিরাট কোহলিদের। পার্থের দ্বিতীয় ম্যাচে ১৪৬ রানে হারলেও প্রথম ও তৃতীয় টেস্টে যথাক্রমে ৩১ ও ১৩১ রানের জয় পেয়েছিল অতিথিরা। এর আগে শেষ অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের সুযোগ এসেছিল ২০০৩-২০০৪ মৌসুমে। কিন্তু সেবার কাটা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহ। অসি-অধিনায়কের স্টাম্পিং মিস করেছিলেন উইকেটরক্ষক পার্থিব প্যাটেল, তাতেই মহাকাব্য রচনা করে ভারতকে হতাশ করেছিলেন স্টিভ। শেষ ম্যাচ ড্র হওয়ায় সিরিজ হয়েছিল হাতছাড়া। সৌরভ গাঙ্গুলীর হাত ধরে সেদিন যা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল, ৭১ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তারই শাপমোচন হলো কোহলির হাত ধরে। গর্বিত কোহলি বলেন, ‘আমি একটা কথাই বলতে চাই আমি এই সাফল্যের অংশীদার হয়ে যতটা গর্বিত, আমার ক্যারিয়ারে আগে এতটা কখনই হইনি। অধিনায়কের মুখে এই সাফল্যের হাসি দলের সব খেলোয়াড়ের জন্যই। এখনও পর্যন্ত ক্রিকেটার হিসেবে এটি আমার ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন।’ বলেন কোহলি। ভারত অধিনায়ক আরও যোগ করেন, ‘এই মুহূর্তে এই দলের হয়ে আমি যতটা গর্বিত এর আগে কখনও ততটা ছিলাম না। গত ১২ মাসে আমরা যে সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পেরেছি তা অসাধারণ।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি দেখেন, এই দলটার ক্রিকেটারদের গড় বয়স খুবই কম। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেরা কখনও নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারায়নি। বাইরে থেকে অন্য লোকজন কে কী বলল তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখাটাই হলো আসল কথা। তাতে সেরা ফলটা পাওয়া যায়। এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।’ তিন বছর আগে এই সিডনিতেই আচমকা মহেন্দ্র সিং ধোনি সরে দাঁড়ালে পুরো সময়ের জন্য ভারতীয় দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কোহলি। এখন তিনি অনেক পরিণত। বাইশ গজের লড়াইয়ে মগজাস্ত্র প্রয়োগে অনেক বেশি ধুরন্ধর। কোহলি তাই এভাবেই জানিয়েছেন, কি করে অসিদের গুহা থেকে টেস্ট সিরিজ ছিনিয়ে নিয়ে আসাটা ভারতীয় ক্রিকেটের ভিত্তি নতুন করে স্থাপন করবে, ‘আমার ক্যারিরয়ারের সেরা সাফল্য। ২০১১ সালে আমরা যখন বিশ্বকাপ জিতেছিলাম, তখনকার সেই দলটায় আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। আমার চারপাশের মানুষগুলোকে অদ্ভুত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে দেখেছিলাম। তবে, আমি নিজে কিন্তু সেভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারিনি। অস্ট্রেলিয়ায় এটা আমার তৃতীয় সফর। এতদিন ভারতীয় ক্রিকেট দল যা পারেনি এ বার আমরা সেটাই করে দেখালাম। স্বভাবতই এই সাফল্যের জন্য আমরা গর্বিত।’ কোহলি যোগ করেন, ‘নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এই জয় আমাদের দলকে নতুন পরিচিতি এনে দেবে। ভবিষ্যতে এই কীর্তির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে ভারতীয় ক্রিকেটের তরুণ প্রজন্মকে এই ফল বাড়তি উৎসাহ দেবে।’ এই সিরিজেই প্রথম অধিনায়ক হিসেবে তিন মহাদেশে (দ. আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া) টেস্ট ম্যাচ জিতেছিলেন, এবার সেটিকে ছাড়িয়ে গড়লেন নতুন ইতিহাস। উপমহাদেশের কোন দলেরই যে অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজজয়ের নজির নেই, ৩০ বছর বয়সেই কোহলির নামের পাশে সেটি লেখা হয়ে গেল। স্বভাবতই প্রশংসার জোয়াড়ের ভাসছেন অধিনায়ক, ভাসছে তার দল। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে যদি কোহলিদের হাত ধরে নতুন সভ্যতার উত্থারন হয়, তাহলে অস্ট্রেলীয় সভ্যতার পতনের শঙ্কাটাও কিন্তু তীব্র হয়ে গেল। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপজয়ের চেয়েও এ সাফল্য বেশি আনন্দের বলে উল্লেখ করেছেন ভারত কোচ রবি শাস্ত্রী, ‘৮৩-র বিশ্বকাপ ধরুণ বা তার দুই বছর পর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেট...। আমি তো বরং বলব, সেই সব ট্রফি জয়ের চেয়েও এবার অস্ট্রেলিয়া থেকে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি জিতে নেয়াটা অনেক বেশি কৃতিত্বের, অনেক বেশি আনন্দের। এ স্মৃতি অনেকদিন মনে থাকবে। ছেলেদের বিশেষ ধন্যবাদ। ওদের জন্যই তো এই অর্জন।’ শুধু তাই নয়, ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমের পর প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দুটি টেস্ট জিতল ভারত। সেবার পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে হেরে গিয়েছিল সফরকারীরা। মেলবোর্নে জিতে ভারতের হয়ে ‘অধিনায়ক’ হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলীর দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি ১১ টেস্ট জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করেছেন কোহলি। পাশাপাশি দারুণভাবে ২০১৮ সাল শেষ করল তার দল ভারতও। নতুন বছর ২০১৯Ñএ অপেক্ষা করছির আরও বড় প্রাপ্তি, প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জয় সেটিও পূর্ণতা পেল। আগের ১১ সফরে তিনবার সিরিজ ড্র করতে পেরেছিল ভারত, যার শেষটি ২০০৩-০৪ মৌসুমে। ২০১৪ সালে ভারতের টেস্ট দলের নেতৃত্বভার পান কোহলি। প্রতিপক্ষের মাঠে এ পর্যন্ত ২৫ ম্যাচে দেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। মেলবোর্নে তৃীতীয় টেস্টে বুলে নেয়া জয়টা ছিল ‘অধিনায়ক’ হিসেবে প্রতিপক্ষের মাটিতে তাঁর ১১তম জয়। আর এতেই উঠে আসে সৌরভ গাঙ্গুলী প্রসঙ্গ। ২০০০ থেকে ২০০৫Ñএই সময়ে ভারতের নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিপক্ষের মাঠে সৌরভও ১১টি টেস্ট জিতেছিলেন। ভারতের অধিনায়ক হয়ে প্রতিপক্ষের মাঠে সর্বোচ্চ টেস্ট জয়ের রেকর্ডটি এত দিন সৌরভের একার দখলে ছিল। মেলবোর্নে জিতে পূর্বসূরির সেই রেকর্ডে ভাগ বসালেন কোহলি। তবে এই ১১ টেস্ট জিততে সৌরভের (২৮ ম্যাচ) চেয়ে কম ম্যাচ (২৪ ম্যাচ) লাগে কোহলির। ভারতের এ দুই অধিনায়কই প্রতিপক্ষের মাঠে ন্যূনতম ১০টি করে টেস্ট জিতেছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো কিংবদন্তি ক্যাপ্টেনও এই তালিকায় দু-জনের পেছনে। কোহলি একটি জায়গায় টেক্কা দিয়েছেন তাঁর বাকি সব পূর্বসূরিকে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াÑ এই চার দেশে ১৩ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ৪টিতে জয় তুলে নিয়েছেন কোহলি। ধোনি ২৩ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৩ জয় তুলে নিয়ে দ্বিতীয়। কোহলির মতো আর কোন ভারতীয় অধিনায়কই এই চার দেশে এত জয়ের মুখ দেখেননি। তাও আবার এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে। জয়তু কোহলি।
×