ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন পূরণের পথে উৎপল

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৯

স্বপ্ন পূরণের পথে উৎপল

দু’চোখে স্বপ্নের পরাগ মেখে লোহাগড়া উপজেলার পলাউজেন গ্রাম থেকে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামে পা রেখেছিল উৎপল দাস। স্বপ্ন পূরণের অভিপ্রায়ে চাচার বাসায় থেকে শুরু হয় তার পড়ালেখা, লামা বাজার এএএস সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র উৎপল এ বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.৬৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন বাড়ি থেকে বাবার অসুস্থতার সংবাদ আসে। সংসারের একমাত্র সন্তান হিসেবে অসুস্থ বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য গ্রামে ফেরা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না উৎপলের সামনে; যদিও মা বেনু দাস চাননি- উৎপলের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটুক। কিন্তু মানুষের চাওয়াগুলো কি সবসময় পূর্ণ হয়? পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস গ্রামের ছোট্ট মুদি দোকানটি উৎপলের বাবা চালাতেন। তিনি শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকে দোকান বন্ধ। কিন্তু খাবার-দাবার ও ওষুধপত্র থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন যে চাহিদা, সেগুলো তো বন্ধ করার জো নেই। অতএব পড়ালেখায় ইতি টেনে উৎপলকে দোকান খুলে বসতেই হলো। দীর্ঘ পাঁচ বছর শয্যাশায়ী থাকার পর ২০১২ সালে উৎপলের বাবা ধরাধাম ত্যাগ করে অনন্তলোকের পথে পাড়ি জমান। এই পাঁচ বছরে দোকানের পুঁজি প্রায় পুরোটাই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে। ফলে নিজেদের দোকান বন্ধ করে দিয়ে অন্যের দোকানে মাসিক ৭ হাজার বেতনে ‘গোমস্তা’র চাকরি নেয় উৎপল। কয়েক বছর ‘গোমস্তাগিরি’ করার পর উৎপল একদিন মনস্থির করে ফেলল পুনরায় চট্টগ্রামে ফেরার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় এক দশক পর পুরনো সেই চেনা নগরীতে ফিরে আসে সে। চট্টগ্রাম আসার পরদিন থেকেই কাজের তালাস করছিল উৎপল। একদিন তার পূর্বপরিচিত এক বন্ধু, যে একটি বেসরকারী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়াশোনা করছিল; সে উৎপলকে ‘সেইপ’ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে কোন একটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতা অর্জনের কথা বলে। উল্লেখ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)’ বাস্তবায়ন করছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে পাঁচ লাখ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা হবে। সম্পূর্ণ সরকারী খরচে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশের চাকরির সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কমপক্ষে ৩০% নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যেমনÑ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, চর ও হাওড়সহ দুর্গম এলাকার অধিবাসী, বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ১ লাখ মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। প্রশিক্ষণ চলাকালে এ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ ভাতার পাশাপাশি বিশেষ বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। দেশে-বিদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের চাহিদার আলোকে বেসরকারী পর্যায়ে ১২টি ইন্ডাস্ট্রি এ্যাসোসিয়েশন, সরকারী পর্যায়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই বিভাগ তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ‘সেইপ’-এর তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাসিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত বাংলাশে-কোরিয়া টেকনিক্যাল সেন্টারে (বিকেটিসি) বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। বন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী সেখানে যোগাযোগ করে উৎপল। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে উৎপলের আগ্রহের বিষয় মেশিন টুলস অপারেশন (গঞঙ) কোর্সে ২০১৭ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সেশনে ভর্তি হয় সে এবং প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে। প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরের মাসেই অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শুরুতেই পুরাতন চান্দগাঁওয়ের কালুঘাট এলাকায় ‘এম কালান্তর ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামক প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার টাকা বেতনে উৎপলের চাকরি হয়ে যায়। উৎপল তার মা বেনু দাসকে গ্রাম থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছে। মা-ছেলের ছোট্ট সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও সুখের কমতি নেই। উৎপল এখন স্বপ্ন দেখে একটি ওয়ার্কশপের মালিক হওয়ার। উৎপলের সঙ্গে যখন শেষ হলো, আকাশে উঁকি দিচ্ছিল পঞ্চমির চাঁদ। এ চাঁদ একদিন পূর্ণতা পেয়ে পূর্ণিমায় যাবে; অমল-ধবল জ্যোৎস্নায় ভাসাবে বিশ্ব চরাচর। অনুরূপভাবে উৎপলের স্বপ্নও নিশ্চয়ই একদিন পূরণ হবে; নিজস্ব একটি ওয়ার্কশপের সামনে দাঁড়াবে এ তরুণ। চলে আসার সময় উৎপলের মা বেনু দাস জানতে চাইলেন : কেমন দেখলেন আমার ছেলেকে? বললাম : খুব ভাল; চমৎকার...
×