ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যামেরার পেছনের তারকা

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ৩ জানুয়ারি ২০১৯

ক্যামেরার পেছনের তারকা

কখনও পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানসের জলদস্যুদের মতো উত্তাল সাগরে চষে বেড়ানোর কথা কল্পনা করেছেন? অথবা ইন্টারস্টেলার থেকে মুগ্ধতা নিয়েছেন? কিংবা জোকারের হাসিতে শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা ¯্রােত বয়ে গেছে? তাহলে নিশ্চিত কিছু সুর আপনার মাথায় আক্রমণেই বাজছে। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে নামটি অপরিচিত নয়, হুট করে মাথায় নাও আসতে পারে। ইন্টারস্টেলার, ইনসেপশন, ডার্ক নাইট, ডানকার্ক, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবায়ানের দুর্দান্ত মুহূর্তগুলোকে সাউন্ডট্র্যাকে কল্পনার সীমারেখা পার করাতে পরিচালকরা যার ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন তিনি হলেন মিউজিক ডিরেক্টর হ্যান্স জিমার। একটি দুটি নয় জিমার সাউন্ড কম্পোজ করেছেন ১৫০টির বেশি সিনেমাতে। মিউজিক যেন জিমারের রক্তে মিশে আছে। ১৯৫৭ সালে ফ্রাঙ্কফুটে জন্ম নেয়া হ্যান্স জিমার বাল্যবয়সেই তার পিতাকে হারান। তার পিতা ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং তার মা ছিলেন সুরকার। পিতামাতার গুণগুলো যেন এক হয়েছিল জিমারের মধ্যে। পিতা গত হবার পর থেকেই মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টগুলোকে নিজের বন্ধু ভেবে আঁকড়ে ধরে থাকেন। বাড়ির পিয়ানোতে ছোটখাটো পরিবর্তন এনে সুরে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করতেন তিনি। ২০১৩ সালে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন একবার ইলেক্ট্রনিক করাতের কিছু যন্ত্র খুলে এনে পিয়ানোতে বসিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও তার মা এসবে আতঙ্কিত ছিল। ১৯৭৭ ব্রিটেনের ব্যান্ড বাগলসের সঙ্গে কাজ শুরু হ্যান্স জিমার। বাগলসের পর যোগ দেন ইটালিয়ান ব্যান্ড ক্রিশমাতে। কাজের পরিধি ছড়িয়ে যায় স্পেন, ব্রিটেনেও। গান অথবা ডকুমেনট্রিতে সুর করা ছাড়াও জিঙ্গেল (টিভি-রেডিওর বিজ্ঞাপনের সুর বা গান) লেখা শুরু করেন তিনি। ৮৪ সালে স্প্যানিশ গানের দল ম্যাকানোর সঙ্গে তিনি প্রথম লাইভ পারফর্ম করেন। ৮০র দশকে স্টানলি মায়ার নামের আরেকজন কম্পোজারের সঙ্গে তিনি ইয়ার্ড স্টুডিও গড়ে তোলেন। সাউন্ডের এই জাদুকর তখন থেকেই হলিউডে পর্দার পেছনে কাজ শুরু করেন। তিনি প্রথম কম্পোজারের কাজ করেন ঝঁপপবংং ওং ঃযব ইবংঃ জবাবহমব সিনেমাতে। উঁংঃরহ ঐড়ভভসধহ এবং ঞড়স ঈৎঁরংব অভিনীত জধরহ গধহ সিনেমা থেকেই জিমারের উত্থান শুরু। সাউন্ডট্র্যাকে মনোনয়ন পেলেও শেষ পর্যন্ত অস্কার পায় না জধরহ গধহ, তবে অস্কার না পেলেও জিমার চলে যায় নতুন এক উচ্চতায়। তবে এত কিছুর পরেও জিমার হলিউডে তখনও এক বহিরাগত। যুদ্ধ আর রাজনীতির রেশে জন্মগতভাবে এই জার্মানকে খানিকটা অপ্রস্তুত করছিল। জিমার বেশ অবাক হয়েই আবিষ্কার করলেন সিনেমা জগতের তুঙ্গে থাকা হলিউড শব্দ প্রকৌশলে ইউরোপের থেকে বেশ পিছিয়ে। বিবিসির হয়ে কিছুদিন কাজ করায় ইউরোপের নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন জিমার। অভিজ্ঞটা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে জিমার নিজের কাজটা এগিয়ে নিতে থাকেন। জিমার দেখলেন বেশিরভাগ মিউজিকই প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকে সংগ্রহ করে খানিকটা পরিবর্তন করে চালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু কল্পনার শক্তি দিয়ে তিনি এমন সব মিউজিক তৈরিতে হাত দিলেন যেগুলোর অস্তিত্ব আসলে প্রকৃতিতে নেই। চিড়িয়াখানায় হরিণের ডাক রেকর্ড করার বদলে তিনি খানিকটা কল্পনার মিশ্রণে নতুন কিছু করতে থাকলেন। এরই মধ্যে জিমারের নাম ছড়িয়ে পড়েছে হলিউডে। খ্যাতি তাকে নিয়ে যায় ওয়াল্ট ডিজনির দরজায়। এ্যানিমেশন ফিল্ম ঞযব খরড়হ করহম এর সাউন্ডট্র্যাকে শিহরিত হয় দর্শকরা। ৮ বছরের মাথায় ২য় বারের মতো অস্কারের জন্য মনোনয়ন পান জিমার। সেরা মিউজিকের জন্য ঞযব খরড়হ করহম সিনেমাটি অস্কার জিতে নেয়। ২০০০ সালের দিকে হ্যান্স জিমারের সঙ্গে পরিচয় হয় সিনেমা জগতের কিংবদন্তি পরিচালক নোলানের। পারফেকশনিস্ট এই পরিচালক খুঁজে পেলেন সুরের পারফেকশনিস্টকে। বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে, ঝড়ের আগের পিনপিনে নিস্তব্ধতা হঠাৎ পরিণত হলো কোন সাইরেনের শব্দে। অমবহঃ ড়ভ ঈযধড়ং জোকার যে কতটা বিপজ্জনক, হাসতে হাসতে কি ভয়ানক ত্রাসটাই না সৃষ্টি করতে পারেন তারই মাত্রাটা সুরে তুলে দর্শকের কানে বাজিয়েছেন জিমার। সাফল্যের তুঙ্গে থাকা জিমারের কিংবদন্তি হবার যাত্রাটা শুরু এখান থেকেই শুরু। বেশিরভাগ সময় দেখা যায় বিখ্যাত পরিচালকরা একজনের উপরেই ভরসা করেন। বর্তমানে পরিচালক-কম্পোজার জুটির মধ্যে সেরা হলেন নোলান-জিমার জুটি। দি ডেইলি টেলিগ্রাফের তৈরি করা সেরা ১০০ জীবন্ত জিনিয়াসের মধ্যে তিনি একজন। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সিনেমার প্রাণ না হতে পারে ঠিকই। তবে দৃশ্যগুলোকে প্রাণবন্ত করে রাখতে এটার যেন কোন বিকল্প নেই। আর দিনশেষে জিমারকে সবাই একবাক্যে সর্বকালের সেরা ফিল্ম স্কোর কম্পোজারের স্বীকৃতি দেয়। ধন্যবাদ জিমার, কল্পনার সীমারেখা পার করে অনুভূতি করতে শেখানোর জন্য।
×