ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

বিজাতীয় ধমকের ব্যবচ্ছেদ

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজাতীয় ধমকের ব্যবচ্ছেদ

সামনে নির্বাচন। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন খবর, চমক আর লাগাতার বিশ্লেষণ। এবারের নির্বাচনী প্রচারে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সরকারী দল, বিরোধী দল সবাই এই মাধ্যমে খুবই সক্রিয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে ছোট-খাট অসংখ্য ভিডিও বার্তা। সেগুলোয় মডেল হচ্ছেন নেতা-নেত্রী, নায়ক-গায়ক কে না! ইদানীং ফেসবুকে ঘুরছে ঐক্যফ্রন্টের এমনি একটি ভিডিও বার্তা। তাতে দেখা যায়, অন্ধকার একটি ঘরে লাঠিতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে কোনমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলছেন অশতিপর এক বৃদ্ধ। ব্যাকগ্রাউন্ড বর্ণনায় জানা যায় তার হাত ধরেই ১৬ ডিসেম্বর এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নব্বই-এ গণতন্ত্রের বিজয়ও নাকি তার হাত ধরেই। ব্যাকগ্রাইন্ডে ভাষ্যকার বলতে থাকেন, তিনিই দেশের আগামীর দিশারী। একজন অশতিপর বৃদ্ধ দু’কোটি তরুণ ভোটারের আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন, মেনে নিতে একটু কেমন যেন লাগে! তারপরও দেখতে থাকি, আগ্রহ যায় না। ওই যে তার হাতেই নাকি স্বাধীন স্বদেশ, মুক্ত গণতন্ত্র আর বাঙালীর ভবিষ্যত! আগ্রহ হারাই-ই’ কিভাবে? একসময় আঁধার থেকে আলোয় আসেন ভদ্রলোক। জাতিকে আশ্বস্ত করেন জাতির কা-ারি, অর্থাৎ তিনি প্রস্তুত। কাজেই জাতির নো চিন্তা, নো টেনশন। এতে কে কতখানি আশ্বস্ত হচ্ছেন জানি না, কিন্তু আমি কলম ধরার প্রচ- কম্পালশান অনুভব করি। নির্বাচন নিয়ে মিডিয়ায় বিশ্লেষণ আর পোস্টমর্টেম চলছেই। চলবেও সবখানে। অখ্যাত অনলাইন পোর্টালের আনাড়ি কলাম থেকে প্রখ্যাত জাতীয় দৈনিকের উপ-সম্পাদকীয় আর নামী-দামী টিভি চ্যানেলের টক’শো- বাদ যাবে না কোন কিছুই। নির্বাচনপূর্ব এবং নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের এই হচ্ছে ইদানীংকার চালচিত্র। তারই ধারাবাহিকতায় সামান্য সংযোজন এই লেখাটি। সম্প্রতি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আলোচিত ওই ভদ্রলোকের কিছু বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সমালোচনার ঝড় তুলেছিল সব ধরনের মিডিয়াতেও। কেউ-কেউ বলেছেন, বয়ঃবৃদ্ধ লোক মেজাজ সামলাতে পারেননি। অন্যরা অতটা উদার হননি। নিজের আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজে বলেছেন ‘শহীদ মিনারে’ শহীদদের প্রতি অবমাননাকর উক্তি তাকে আবেগতাড়িত করেছিল। আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমার বিষয়ও নয়। আমি বরং পারঙ্গম জন্ডিসের ব্যবচ্ছেদে। রোগীর চোখ হলুদ হলো যে জন্ডিসে, তা কি লিভারের রোগে না রক্তের লোহিত কণিকাগুলো বেশি বেশি ভাঙ্গছে বলে, নাকি বন্ধই হয়ে গেল কৃমি বা পাথর দিয়ে পিত্তনালিতে পিত্তের চলাচল, এসব বিশ্লেষণেই কাটে আমার সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। কিন্তু একজন ভদ্রলোক ধমকাবেন আর আমাদের বৃক্ষচারী পূর্বপুরুষদের ভঙ্গিমায় দাঁত-মুখ খিচিয়ে ব্যঙ্গোক্তি করবেন- কেন যেন প্রচ- গায়ে লাগছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কয়েকটি বক্তব্য আমার কানে বেজেছে। প্রথমেই যা লক্ষণীয় তা হলো, পরমত অসহিষ্ণুতা আর বাক-স্বাধীনতার কণ্ঠরোধের প্রয়াস। প্রকাশ্যে, দিনে-দুপুরে অনরেকর্ড প্রশ্নকর্তাকে ‘চিনে রাখছি’, ‘দেখে নেব’ ধরনের হুমকি প্রদান, মার্ক জাকারবার্গের বিস্ময় প্রযুক্তির কল্যাণে অনেকেই দেখেছেন। এরপরও যদি কোন জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আর বাক-স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়, তখন ভাবি হাসব না কাঁদব! অবাক হয়ে দেখেছি শহীদ মিনার আর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পার্থক্যটুকুও তার অজানা। তার ভাষায়, শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে শহীদদের অপমান করায় তিনি ক্ষিপ্ত। লক্ষণীয় একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোথাও এমন সৌধ নেই। কারণ পৃথিবীতে আর কোন জাতি ভাষার দাবিতে রক্ত দেয়নি আর যুগে-যুগে দেশে-দেশে গণহত্যা সংগঠিত হলেও পৃথিবীর কোথাও-ই এমন পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী নিধনের নজির নেই। অথচ যিনি হতে চান বাংলাদেশের কা-ারি, তার কাছেই অজানা এসব তথ্য। মানুষ আবেগতাড়িত হলে কিংবা রেগে গেলে তার প্রতিদিনের যে কথ্য ভাষা, তাই উঠে আসে তার জবানীতে। আপনি-আমি ব্যথা পেলে যেমন বাবারে-মারে বলে চিৎকার করি, ‘ও ড্যাডি, ও মাম্মি’ বলে না। ভদ্রলোক ঘটনার পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে এবং প্রেসে ছাপানো বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেছেন যে, তার ভাষায় শহীদের অপমান তাকে আবেগতাড়িত করেছিল। তার নিজ দলীয় প্রার্থীদের জামায়াতি, যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একই প্রতীকে আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ কেন তাকে আবেগতাড়িত করে না, তার উত্তর কে দেবে? যা হোক, আবেগতাড়িত হয়ে কেউ যখন উর্দুতে ধমক দেন তখন সঙ্গত কারণেই একটু ঘেটে দেখার আগ্রহ জন্মায়। আর ঘাটতে গিয়ে যদি দেখা যায়, তিনি পাকিস্তানী এক উকিলের জামাতা, একাত্তরে শ্বশুরবাড়ির কানেকশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়ে নয়টি মাস জমিয়ে আইন ব্যবসা করেছেন, তখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। টেলিফোন কললিকের সুবাদে এটা এখন সর্বজনবিদিত যে, এবারের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন জোটটির তিন শ’ আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। অর্থাৎ আমাদের কোন ভুলে আমরা যদি ৩১ ডিসেম্বর ওই জোটটির প্রার্থীদের জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দেখতে পাই, তবে তা হবে পাকিস্তানের সংসদ আর তারা হবে পাকিস্তানী সাংসদ। কাজেই এই ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। একজন পেশাজীবী হিসেবে তিনি আগামী সংসদ নির্বাচনকে পেশাদারিত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে একটি পাকিস্তানী সংসদ প্রতিষ্ঠা করাই তার এজেন্ডা এবং তার এজেন্ডা এখানেই শেষ। কারণ তার জোট জিতুক চাই হারুক, তিনি ওই সংসদে থাকছেন না। একজন পেশাজীবী হিসেবে তার আনডিক্লেয়ার্ড চুয়ান্ন কোটি টাকা বেড়ে হয়ত এক শ’ চুয়ান্ন বা দুই শ’ চুয়ান্ন কোটি হবে, আর ‘ঢাকা যখন জ্বলবে’ তখন ‘আইএসআই সম্রাট’ আপন মনে বেসুরো বাঁশি সাধবেন। অতএব সাবধান, ত্রিশে ডিসেম্বর কোন ভুল নয়। পাকিস্তানের কা-ারি কিন্তু প্রস্তুত! লেখক : চিকিৎসক ও গবেষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×