ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরা খাতুন

কিংবদন্তি মাশরাফি

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

কিংবদন্তি মাশরাফি

একটা সময় বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করেছেন ফাস্ট বোলাররা। আর সেই পেসাদের আবাসভূমি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া। নিয়মিত একাদশে ৪/৫ জন পেসার খেলিয়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করেছে এ দুই ক্রিকেট পরাশক্তি। সে সময়েও দুয়েকজন স্পিনার পরবর্তী সময়ের জন্য উদাহরণ হিসেবে কিংবদন্তির আসনে আসীন হয়েছেন। তবে মিলেনিয়াম যুগ শুরুর পর পেসারদের দাপট সে তুলনায় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে, এখন ক্যারিবীয় ও অসি দলেও নিয়মিত স্পিনারদের বিস্ময়কর কিছু করতে দেখা যায়। পেসারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বরং স্পিনারদেরই ক্রিকেট বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। তবে এর মধ্যেই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ খ্যাতি পাওয়া মাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি দলের হয়ে সেই ২০০৬ সালে একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েছিলেন, টাইগারদের দেখিয়েছিলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশানা। সে বছর ওয়ানডে ক্রিকেটের পারফর্মেন্সে সবাইকে ছাড়িয়ে সেরা হয়েছিলেন এ ডানহাতি পেসার সর্বাধিক ৪৯ উইকেট নিয়ে। এখন ক্যারিয়ারের ১৭ বছর পার করেছেন, অনন্য এক উচ্চতায়ই হয়তো আসীন হয়ে কিংবদন্তিদের কাতারে থাকতে পারতেন। ধারাবাহিক যত কঠিন ইনজুরি সেটা হতে দেয়নি ১২ বছর আগেই ফর্মের তুঙ্গে থাকা মাশরাফিকে। এরপরও একের পর এক অনন্য এক উচ্চতায় আসীন করছেন নিজেকে। প্রথম বাংলাদেশী হয়ে ওয়ানডে ইতিহাসের ৭৮তম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ ওয়ানডে খেলার নজির সৃষ্টি করেছেন। আর এই অবিস্মরণীয় মাইলফলক অর্জনের ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়ে জিতিয়েছেন দলকে। ক্যারিয়ারের শততম ম্যাচেও হয়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে ১৪ বছর আগে বাংলাদেশের প্রথম জয়ে অন্যতম কারিগর হিসেবে ম্যাচসেরা। এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারে ২৫৫ উইকেট নিয়ে ভারতীয় কিংবদন্তি কপিল দেবকে পেছনে ফেলে ওয়ানডে ইতিহাসে ২৪তম স্থানে উঠে এসেছেন। এশিয়ার ওয়ানডে ইতিহাসে ডানহাতি পেসার হিসেবে উচ্চতাটা আরও ওপরে। তিনি এখন এক্ষেত্রে ৬ নম্বরে। এসব কীর্তি গড়ার মাধ্যমে অনেক কিংবদন্তিকে পেছনে ফেলেছেন মাশরাফি। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ওয়ানডে ইতিহাসের ৪০৭১তম ম্যাচ যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ততোদিনে ২৪৭২ জন ক্রিকেটার খেলেছেন এই ফরমেটে। কিন্তু, মাত্র ৭৮তম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ বা তার বেশি ওয়ানডে খেলার কীর্তি গড়লেন সেদিন মাশরাফি। ক্যারিয়ারের ২০০তম ম্যাচের মাইলফলক ছোঁয়ার দিনে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ তকমা পাওয়া মাশরাফি জ্বলে উঠলেন দারুণভাবে। মাত্র ৩০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেয়ার পথে ভারতীয় কিংবদন্তি অলরাউন্ডার কপিলকে পেছনে ফেলেছেন। মাশরাফির মোট উইকেট ২৫৫, আর কপিলের ২৫৩! ক্রিকেট ক্যারিয়ার গত মাসেই ১৭ পেরিয়ে গেছে। তবে এর মধ্যে দুই পায়ে মোট ৭ বার অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন ইনজুরির ধকলে মাশরাফির ক্যারিয়ার থেকে প্রায় পাঁচটি বছরই হারিয়ে গেছে। তবে যখনই খেলার মতো সুস্থ ও ফিট থেকেছেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলে জায়গা করে নিয়েছেন অপরিহার্য এ ক্রিকেটার। এমনকি ইনজুরি নিয়ে এবং শতভাগ ফিটনেস না থাকার পরেও খেলেছেন মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়ে। এ কারণেই সবার আগে ২০০ ওয়ানডে খেলার দারুণ মাইলফলকটি ছুঁয়ে ফেললেন ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে। তার কাছাকাছি আছেন মুশফিকুর রহীম ১৯৬ ও সাকিব আল হাসান ১৯৩ ওয়ানডে খেলে। ক্যারিয়ারের এই মাইলফলক ম্যাচে মাশরাফি বোলিংয়ে আসেন ৪ নম্বরে। প্রথম বলেই চারের মার হজম করলেও নিজের নবম ওভার পর্যন্ত আর কোন বাউন্ডারি তাকে হাঁকাতে পারেনি কোন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা। শুধু স্পেলের একেবারে শেষ ওভারে হজম করেছেন একটি ছক্কা। প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ১৩ রান দিয়ে ড্যারেন ব্রাভো ও শাই হোপের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট দুটি তুলে নেন। দারুণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আটসাট বোলিংয়ের আরেকটি পুরস্কার পেয়েছেন নিজের অষ্টম ওভারে ক্যারিবীয় অধিনায়ক রোভম্যান পাওয়েলকে। শেষ করেন ১০-০-৩০-৩ বিশ্লেষণ নিয়ে। মাঝে ১৫ ওয়ানডে বিরতি দিয়ে গত ২২ জুলাই প্রভিডেন্সে ৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। ৩ উইকেটও নিতে পারেননি। এরপর ১১ ওয়ানডেতে ৩ বা তার বেশি উইকেট নিতে না পারা মাশরাফি সেই ক্যারিবীয়দের বিপক্ষেই আবার ৩ উইকেটের দেখা পেলেন। সবমিলিয়ে ২০০ ওয়ানডেতে বোলিং করে মাশরাফির মোট উইকেট এখন ৩১.৪০ গড় ও ৪.৮০ ইকোনমিতে ২৫৫। ইনিংসে ৫ বার তার বেশি উইকেট পেয়েছিলেন একবারই। নাইরোবিতে ২০০৬ সালের ১৫ আগস্ট কেনিয়ার বিপক্ষে নিয়েছিলেন ২৬ রানে ৬ উইকেট। ৪ উইকেট পেয়েছেন ৭ বার। আর ৩ উইকেট নিলেন ২২তম বার। এদিন ক্যারিয়ারে ১২তম ম্যাচসেরার পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার ওয়ানডে জিতেছিল বাংলাদেশ অলরাউন্ডার মাশরাফির নৈপুণ্যে। ৩১ রান করার পর নিয়েছিলেন ২ উইকেট, হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। সেটি ছিল তার শততম ওয়ানডে। ২২৫ ম্যাচে কপিলের উইকেট ২৫৩। শুধু বাংলাদেশের জার্সিতেও ১৯৮ ম্যাচে ২৫৪ উইকেট নিয়ে মাশরাফি কপিলকে পেছনে ফেলেছেন এদিন। বাংলাদেশের পক্ষে মাশরাফির পরেই আছেন সাকিব ২৪৫ উইকেট নিয়ে। দেশের মাটিতে মাশরাফি ৯৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১৪০ উইকেট, সে তালিকায় অবশ্য সাকিব এগিয়ে ৯৭ ম্যাচে ১৪৭ উইকেট নিয়ে। নির্দিষ্ট ভেন্যুতে সর্বাধিক উইকেট নেয়ার তালিকায় বিশ্বে এখনও মাশরাফি চার নম্বরে। মিরপুরে তিনি ৬৩ ম্যাচে ৯৩ উইকেট নিয়েছেন। তার ওপরে সাকিব একই ভেন্যুতে ৭৯ ম্যাচে ১১৩ উইকেট নিয়ে ৩ নম্বরে। শীর্ষ দুইয়ে আছেন পাকিস্তানের বাঁহাতি কিংবদন্তি পেসার ওয়াসিম আকরাম শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৭৭ ম্যাচে ১২২ উইকেট ও তারই স্বদেশী ওয়াকার একই ভেন্যুতে ৬১ ম্যাচে ১১৪ উইকেট নিয়ে। অনেক আগেই মাশরাফি বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ওয়ানডে উইকেটের মালিক হয়েছেন। এখন তার ওয়ানডে ইতিহাসে বোলারদের মধ্যে অবস্থান ২৪ নম্বরে। শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরন সর্বাধিক ৫৩৪ এবং পাকিস্তানের পেসার ওয়াসিম আকরাম ৫০২ এবং ওয়াকার ইউনুস ৪১৬ ও শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাস ৪০০ উইকেট নিয়ে সেরা চারে আছেন। ৯ জন পেয়েছেন ৩ শতাধিক উইকেট। আড়াইশ’ পেরোনো বোলারের সংখ্যা ১২! তবে হিসেবটা পেসারদের হলে মাশরাফির অবস্থান বিশ্বে এখন ১৬ নম্বরে। ডানহাতি পেসারের তালিকায় ১৩তম। এমন অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে মাশরাফির পেছনে পড়ে গেছেন গতি তারকা শোয়েব আখতার (২৪৭), কাইল মিলস (২৪০), মিচেল জনসন ও হিথ স্ট্রিক (২৩৯ করে), ড্যারেন গফ (২৩৫), কোর্টনি ওয়ালশ (২২৭), কার্টলি এ্যামব্রোস (২২৫) ক্রেইগ ম্যাকডারমট (২০৩) ও ক্রিস কেয়ার্নসের (২০১) মতো পেসাররা। ইমরান খান, আকিব জাভেদ, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, ডেল স্টেইন, স্টুয়ার্ট ব্রডরা তো ২০০-ই ছুঁতে পারেননি। এশিয়ার মধ্যে হিসেবটা আসলে মাশরাফির অবস্থান আরও ভাল। এশিয়ান বোলারদের তালিকায় সার্বিকভাবে তিনি ১৩তম, পেসারদের মধ্যে নবম। তবে এশিয়ার ডানহাতি পেসারদের তালিকায় তিনি ৬ নম্বরে। ওয়াকার (৪১৬), জাভাগাল শ্রীনাথ (৩১৫), লাসিথ মালিঙ্গা (৩১১), অজিত আগারকার (২৮৮) ও পাকিস্তানী আব্দুল রাজ্জাকের (২৬৯) পরেই মাশরাফি। এ তালিকায় আরও ওপরে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব কাছাকাছি রাজ্জাক আর ওয়ানডে ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার মাখায়া এনটিনিকে (২৬৬) ও ভারতীয় স্পিনার হরভজন সিংকে (২৬৯) পেরোতে পারলে দারুণ এক অবস্থানে থেকেই শেষ করতে পারবেন মাশরাফি।
×