ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এই সমাজেও একজন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

এই সমাজেও একজন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন

Politics has become dirty and expensive- রাজনীতি এখন নোংরা এবং ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। কথাটি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিকের। শ্রদ্ধাভাজন এবং বিশ্বব্যাপী মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত তিনি। তারপরও তাঁকে রাজনীতি করতে হচ্ছে। এটুকুই কেবল নয়। ২০ বার এ্যাটাকের পরও মৃত্যুভয় তাঁকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। কখনও দলের প্রধান, কখনও অপজিশন বেঞ্চের ডাকসাইটে বক্তা, কখনও রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ামক। তাঁর সেই কথাটি যে কত সত্য, কতখানি বাস্তব এবং যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকর- আজকের পরিস্থিতির দিকে তাকালে সহজেই অনুমান করা যাবে। সেই কবে শুনেছিলাম হোন্ডা-গুন্ডা-আন্ডা নির্বাচন ঠান্ডা। এই ধারা আজও অব্যাহত আছে। জনপ্রিয়তার চেয়ে গুন্ডাপ্রিয়তা, সততার চেয়ে টিআর-কাবিখাপ্রিয়তা, বিদ্যার চেয়ে অস্ত্রপ্রিয়তা এখনও নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি। কাউকে দোষও দেয়া যাবে না। প্রতিপক্ষ যদি টাকাওয়ালা হয় তবে এ পক্ষকেও যে টাকাওয়ালা ভাড়া করতে হবে। প্রতিপক্ষ যদি রাজাকার হয় তবে এ পক্ষেও যে একটা রাজাকার বা আলবদর খুঁজতে হবে, প্রতিপক্ষ যদি আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হয় তবে এ পক্ষকেও যে মাফিয়া সর্দার খুঁজতে হবে, প্রতিপক্ষ যদি খুনী হয় তবে এ পক্ষকেও যে খুনের আসামি খুঁজতে হবে- এভাবেই চলছে রাজনীতির মঞ্চসজ্জা। এর বাইরে যে যাবে তাকে রাজনীতির ফুটপাথ আঁকড়ে রাজপথের পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে নিরন্তর, হয়তবা অনন্তকাল। ক্ষমতার সোনার হরিণটি রাজপথে মাঝ দিয়ে আসা-যাওয়া করবে আর তিনি চেয়ে চেয়ে দেখবেন। মিটিমিটি হাসবেন- পেটি বুর্জুয়ার দল, ভুল রাজনীতির ঝান্ডা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবছে বিরাট এক যুদ্ধ জয় করে ফিরছে। কত বড় বোকা এই লোকগুলো! লোক না বলে তাদের অপদার্থ বলাই শ্রেয়। নিজের ভালটাও বোঝে না। এমনিভাবে রাজনীতি অঙ্গনের দিকে তাকালে কেবলি চোর-গুন্ডা-বাটপাড়, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, আন্ডারগ্রাউন্ড ডন, মাফিয়া সরদার, রাজাকার-আলবদর, ভুঁইফোড়দেরই দৌরাত্ম চোখে পড়বে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মিলিটারি জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করলেন- Money is no problem- টাকা কোন সমস্যা নয় এবং এও বললেন- ও will make politics difficult for the politicians, আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তুলব। তুললেন। একদিকে গরু-ছাগল কেনার মতো (horse trading) এ-দল ও-দল থেকে রাজনীতিকদের কিনতে শুরু করলেন। কারণ, তার কাছে Money is no problem, সেইসঙ্গে সামরিক-বেসামরিক আমলা-কামলাদের দলে ভিড়িয়ে বড় বড় পদে বসিয়ে সত্যি সত্যি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি ডিফিকাল্ট করে দিলেন। পরাজিত পাকিস্তানে পলাতক রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের দেশে ফিরিয়ে এনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উৎপাটিত সাম্প্রদায়িকতার মরা বৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢেলে যে চারাগাছটি রোপণ করলেন তা-ই আজ সাম্প্রদায়িক জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে সমাজটাকেই পঙ্কিলতায় ভরে দিয়েছে। আর তাই তো কামাল-আসম-মন্টু-মনসুররা গা ভাসিয়ে দিতে দ্বিধা করছেন না। দ্বিধা করছেন না বদি মজুমদার, জিল্লুর, আসিফ, ইফতেখার, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায় ‘সেনাপ্রিয় ভট্টাচার্য’), ডাঃ জাফরুল্লাহর মতো মানুষেরা কেবল গা-ই ভাসাচ্ছেন না, পঙ্কিলে নাকও ডুবিয়ে দিচ্ছেন। এদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী। এরা কি বুদ্ধি ফেরি করছেন তা কিন্তু কেউ জানেন না। কেবল জানে এরা রাজনীতির পঙ্কিল পথের যাত্রী। বুদ্ধিজীবীদের পাশে এদের হাওয়া লাগতেও পারে; কিন্তু মানুষের সমাজে রাজপথে এদের কী অবদান কেউ অবগত নন। যেমন মিলিটারি জিয়া, স্বাধীনতার ইহা উহা কত কী; কিন্তু ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে একটি বীরত্বগাথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তার। মুক্তিযুদ্ধের ওপর হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে, দেশে-বিদেশে অগণিত প্রবন্ধ লিখেছেন লেখকগণ, কোটি সংবাদ রিপোর্ট লিখেছেন পত্রিকার রিপোর্টাররা, কোথাও কি মিলিটারি জিয়া বা মিলিটারি জিয়া পতœীর নাম আছে? না, নেই। যেমন ওই সব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, পাতি-বুদ্ধিজীবী এবং মিলিটারির পরিত্যক্ত নেতারা যখন চিবিয়ে চিবিয়ে মিথ্যা বলেন, টকশোতে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায়, মিলিটারি পতœীয় প্রশংসায় বিভোর, তখন যদি প্রশ্ন করা হয় দৃশ্যমান কি কি করেছেন দেখান। একটি দৃশ্যমান উদাহরণও দেখাতে পারবেন না। থাকলে তো! এটাই শেষ কথা নয়। এই পঙ্কিলতার মাঝেও একটি সৎ, সাহসী, সংগ্রামী মেধায়-মননে একেবারে আলাদা বাংলার চিরায়ত স্নিগ্ধ শ্যামল মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে। মুখে ভাষা পাবে- ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/আমি বাংলায় কথা বলি/এই বাংলার আলপথ দিয়ে/হাজার বছর চলি...’ যাকে দেখামাত্র গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষ বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো কাতারবন্দী হয়ে মিছিলের জন্ম দেয়। কারও হাতে লাল-সবুজ পতাকা, কারও মুখে স্লেøাগান জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু, এগিয়ে চলেছে ওই নতুন দিনের সন্ধানে। এ যৌবন জলতরঙ্গে রুধিবে কে? কার সাধ্য? ১৯৭৩ সাল। বিশ্বব্যাপী খরা। খাল-বিল-জলাভূমি শুকিয়ে গেছে, বৃষ্টিরও দেখা নেই। সেইসঙ্গে ওপেক অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশগুলোর জোটবদ্ধ তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সেইসঙ্গে হু হু করে খাদ্যশস্যসহ সবকিছুর দামও বেড়ে চলা, এরই মাঝে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যা, যারা বলেছিল ‘Bangladesh is a bothomless basket’ তাদের চক্রান্তে দুর্ভিক্ষ, নগদ অর্থে কেনা চালের জাহাজ বন্ধু দেশের বন্দরে ভিড়িয়ে জাতির পিতার সরকারের দুর্নাম রটানো। জাতির পিতা কোন কিছু লুকালেন না। পার্লামেন্টের ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বেদনাবিধুর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি ২৬ হাজার মানুষকে বাঁচাতে পারিনি।’ মহান রাষ্ট্রনেতা জাতির পিতার পক্ষেই সম্ভব অকপটে সব কিছু স্বীকার করা। অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বন্দুক-কামান নিয়ে ক্ষমতা দখলকারী জিয়ার সময় পেটের ক্ষিধের জ্বালায় উত্তরবঙ্গে যে শত শত নারী স্বেচ্ছায় বারবনিতার খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন সে কথা একটিবারের জন্যও স্বীকার করেননি। অনুতাপ করেননি কিংবা মিলিটারি স্ত্রীর আমলে সারের দাবিতে পথে নামলে গুলিতে কৃষকের মৃত্যুর খবরও তারা স্বীকার করেননি। ‘আপোসহীন’ যে! মিলিটারি জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া পূর্ণিমা, মহিমাদের ধর্ষণ বা সাংবাদিক হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি। বরং ২০০১-এর নির্বাচনের পর খালেদা-তারেকের ছায়ায় লালিত গুন্ড-সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন নেমে আসে, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে, তাও স্বীকার করেননি। সেদিনও পাশে দাঁড়ান সেই বঙ্গবন্ধুকন্যা ও তাঁর দল। শেখ হাসিনা একটার পর একটা বড় বড় কাজ দেখিয়ে চলেছেন : ১. পদ্মা সেতুর ৬৬% কাজ এরই মধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। ২. সমুদ্রের তলদেশ বা ব্লু ইকোনমি এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। ৩. মহাকাশের কক্ষপথে বিচরণ করছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। ৪. দেশ চলছে তথ্যপ্রযুক্তিতে। ৫. খাদ্যশস্য উৎপাদন ৪ কোটি টন। খাদ্যে উদ্বৃত্ত বাংলাদেশ। ৬. একটি মানুষও এখন না খেয়ে থাকে না। ৭. উত্তরবঙ্গের ‘মঙ্গা’ ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দ দুটি এখন আর যাপিত জীবনে নেই, ডিকশেনারিতে ঢুকে গেছে। ৮. শেখ হাসিনার দিন বদলের সনদ অর্জিত। ৯. গ্রামের ছেলেমেয়েরাও এখন জুতা পায়ে ইউনিফরম পরে স্কুলে যায়। ১০. প্রাথমিক উপবৃত্তির টাকা এখন ছাত্রছাত্রীর মায়ের কাছে মোবাইল টু মোবাইলে চলে যায়। আর কোন অসৎ শিক্ষক কমিশন খেতে পারে না। ১১. কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ জীবনেও মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে। ১২. নারীদের ক্ষমতায়ন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়েছে। কয়েকদিন আগে আইএমএফের জরিপে বলা হয়েছে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে গেছে। ১৩. এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ১৭৬২ মার্কিন ডলার। ১৪. বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৫. জিডিপি ৭.৬৮%। ১৬. ঘরে ঘরে বিদ্যুত চলে গেছে। ১৭. বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াট। ১৮. ঘরে ঘরে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি। ১৯. গ্রামের মানুষও এখন রাত জাগে টকশো দেখে। ২০. মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। ২১. শাক-সবজি উৎপাদনে চতুর্থ। ২২. গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পাকা রাস্তা। মানুষ রিকশা, বাইকে চলে। ২৩. শহরের মানুষ শুক্র-শনি ছুটির দিন গ্রামে যায়। শাক-সবজি চাষ করে। আবার কেউ কেউ গাড়ির ব্যাকে করে শহরে নিয়ে আসে। শহরের টাকা গ্রামে যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে চলেছে। ২৪. বাংলাদেশের মানুষের পোশাক-আশাকেও পরিবর্তন এসেছে। ২৫. ঢাকাসহ বড় বড় শহরের দিকে তাকালে দেখা যাবে ফ্লাইওভারের পর ফ্লাইওভার। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নেমে শহরের দিকে আসতে থাকলে মনেই হবে না এটা বাংলাদেশের কোন শহর। মনে হবে পশ্চিমা কোন দেশের রাজধানী শহর। চট্টগ্রামে তো কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল। ২৬. ঢাকায় চলছে মেট্রোরেলের কাজ। ২৭. অতীতে রেলকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে মাফিয়া বাস-লঞ্চ ব্যবসায়ীরা ভূমি দস্যুদের মতোই রেলকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, যেমন করে লঞ্চ মালিকরা স্টিমার সার্ভিসকে তাড়িয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছরে এই রেলকে আবার সজীব করেছেন। রেলমন্ত্রী মজিবুল হক একটার পর একটা নতুন রেললাইন চালু করে চলেছেন। ২৮. এবার আমি যে কথাটি বলতে চাই- ডাঃ জাফরুল্লাহ বা বদি মজুমদার, মইনুল হোসেনের মতো সুশীল পোশাকরা চোখ থাকতে অন্ধের মতো বিচার করছেন, কোন উন্নয়ন দেখতে পারছেন না। তারা শেখ হাসিনার উৎখাত চান, যা অলীক কল্পনামাত্র। মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে ‘মান্না’ যোগ করা ব্যক্তিটির মতো। তারা কিছু না দেখতে পেলেও দেশের জনগণের কিছু অজানা নেই। এই শক্তিতেই শেখ হাসিনা সংলাপে ভয় পান না, কারও হুমকিতে ভয় পান না, ঠিক একইভাবে নির্বাচনেও ভয় নেই। তবে নেতাকর্মীদের সামান্য অবহেলা বা দুর্বলতার কোন সুযোগ নেই। ২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের যে চেহারা জাতি দেখেছে, এবারও সেই জামায়াত ভিন্ন নামে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন করছে। যোগ হয়েছেন ড. কামাল গং। পাশাপাশি জনগণও ঐক্যবদ্ধ, তাই হতাশার কিছু নেই। সর্বোপরি রয়েছে বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যা। গোটা উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিশেষ করে হাওড় অধ্যুষিত ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ এবং রংপুরের চিলমারী প্রভৃতি অঞ্চলের ফসলাদি ডুবে পচে গেছে। মানুষের ঘরবাড়ি, চলাচলের রাস্তাঘাট সবই পানির নিচে। তখন আমি দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টার। আমাকে পাঠানো হলো ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা অঞ্চলে, সহকর্মী মরহুম শফিকুল কবিরকে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে। আমরা দু’জন প্রায় ৪ মাস সে সব অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করেছি। প্রথম দিকে নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও খালিয়াজুড়ি অঞ্চলে লঞ্চ নিয়ে যাওয়া যায়নি হাওড়ের ঢেউয়ের কারণে, হাওড় যেন উত্তাল সমুদ্র। নেত্রকোনা ডাকবাংলোতে উঠেছিলাম। সেখানে শত শত ছাত্রছাত্রী দিনরাত রুটি বানিয়েছে; কিন্তু পৌঁছে দেয়ার কিছু নেই। একমাত্র বাহন হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। স্বেচ্ছাসেবীরা তাতে করে দুর্গত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে রুটি-গুড বিলিয়েছে। কোথাও নামার জায়গা নেই। মানুষ গাছে, ভেলায় বা নৌকায় বসবাস করছে। সবার তো নৌকাও নেই। তাই ওপর থেকে লিফট করতে হয়েছে। তারপরও বন্যা, ডায়রিয়া বা জ্বরে ২৬ হাজার মানুষ মারা গেছে। বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক লোক পানি টান দিলে বেশি মারা গেছে। ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষের কথা বলা হয় তাও মনুষ্যসৃষ্ট বা ম্যান মেইড। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। গোটা মার্কিন প্রশাসন আমাদের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ালেও পাকিস্তান হেরে যায়। হেরে যাওয়ার পর হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন ‘The emergence of Bangladesh is my personal defeat- বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমার ব্যক্তিগত পরাজয়।’ সেই থেকে তারা আমাদের বিরোধিতা করতে থাকে। কিভাবে বঙ্গবন্ধু সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করবে সেই চক্রান্ত করতে থাকে। ’৭৪ সালে নগদ টাকা দিয়ে খাদ্যশস্য কেনার পর খাদ্যশস্যের জাহাজ চট্টগ্রাম কিংবা মংলা বন্দরে না ভিড়িয়ে ভারতের মোম্বাই বন্দরে ভেড়ায়। বলা হয় ভুল হয়েছে। ততদিনে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। সদ্য স্বাধীন দেশ তখন, খাদ্যশস্য আনা-নেয়ার ভাল ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। তারপর বঙ্গবন্ধু সরকার যে যে এলাকায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে সে সব এলাকায় খাদ্য পাঠিয়েছে। দেশাভ্যন্তরেও স্যাবোটাস কম হয়নি। উত্তরবঙ্গগামী খাদ্যশস্য ভর্তি একটি মালবাহী ট্রেন ২২ দিনব্যাপী পাকশীতে থেমে থাকে কোন কারণ ছাড়াই। স্থানীয় কর্তৃপক্ষও এর কোন জবাব দিতে পারেনি। দৈনিক সংবাদের তৎকালীন রিপোর্টার আবু আল সাঈদ নান্টুর (মরহুম) রিপোর্টটি প্রকাশ করার পর চক্রান্ত ও স্যাবোটাসের পর্দা উন্মোচিত হয়। এভাবে দেশাভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বের কিছু শক্তি বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে, স্যাবোটাস করে। বঙ্গবন্ধু হারবার পাত্র নন। বন্যার পানি নামার আগেই দেশব্যাপী সেচযন্ত্র, পাওয়ার পাম্প, ডিপ টিউবওয়েল, বীজ, সার ইত্যাদি বিনামূল্যে সরবরাহ করেন। আবার গোটা বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু ফসল ঘরে আনার আগেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নার্সিং করা ফসল বাম্পার ফলন হয়। ঘরে ওঠে মুশতাক-জিয়ার সময়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর কেনা খাদ্যশস্যের জাহাজ তখনই এসে চট্টগ্রামবন্দরে ভিড়ে। চালের দাম যখন সাড়ে ৩ টাকায় নেমে আসে সে সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও চিলমারীর বাসন্তীর দুর্গতির কোন গতি হয়নি। বরং মিলিটারি জিয়ার আমলে উত্তরবঙ্গে শত শত নারী স্বেচ্ছায় বারবনিতার খাতায় নাম লেখায় ক্ষিধের জ্বালায়। জিয়াপতœী খালেদার পুলিশের গুলিতে ১৭ জন কৃষক প্রাণ হারায়। তাদের অপরাধ জমি চাষের জন্য সারের দাবিতে প্রশাসনের কাছে সমবেত হয়ে দাবি তুলেছিলেন। এমনি এক বৈরী পরিবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা দেশের হাল ধরেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে প্রথমেই রংপুরের চিলমারী ভ্রমণ করেন। বাসন্তী দুর্গতির বাড়ি যান। বাড়িটির তখন ভাঙ্গাচোরা বেড়া, ঘরের ছাদ ফুটো, বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। বাসন্তী তখন বাড়িতে, দুর্গতি কোথায় চলে গেছে। বাসন্তীকে মনে হলো মানসিক প্রতিবন্ধী। এ অবস্থায় নেত্রী তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন দিলেন। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে নির্দেশ দিলেন- ‘আমি কোন অজুহাত শুনতে চাই না, এই চিলমারী কেন, রংপুরের কোথাও যেন আর মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ না হয়। কিভাবে করবেন আপনারা জানেন। সেদিন আমি নেত্রীর সঙ্গে ছিলাম। পরের বছর গিয়ে দেখলাম মানুষের মুখে হাসি। বাসন্তীর কাপড়ও ছেঁড়া নয়, ঘরও মেরামত হয়েছে। এভাবে একজন মানুষ বর্তমান বৈরী পরিবেশেও বীরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা। নিরলস পরিশ্রম করে দেশকে আজ এমন এক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা উন্নত বাংলাদেশের মহাসড়কে অগ্রসরমান। শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিশ্বাসীদের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো তিনিও বিশ্বাস করেন- ‘and miles to `go before we sleep. ঢাকা- ২৩ নবেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ই-মেইল: [email protected]
×