ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিবর্তন ॥ কচুয়া উপজেলা

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

 গ্রামাঞ্চলে সামাজিক বিবর্তন ॥ কচুয়া উপজেলা

২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দেশের অভ‍ূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জিত হয়েছে। দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে, জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শিক্ষিত এবং স্বাস্থ্যে সমুজ্জ্বল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়েছে। এর ফলে প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে গ্রামাঞ্চলে যে সামাজিক বিবর্তন ঘটেছে তা সাধারণত কোন উন্নয়ন প্রতিবেদনে উল্লিখিত হচ্ছে না। সেই প্রেক্ষিতে গ্রাম পর্যায়ে সামাজিক বিবর্তন বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এই পটে আমার বাসস্থান ও নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার সাম্প্রতিক সামাজিক বিবর্তনের কথা তুলে ধরতে চাই। এই উপজেলার আয়তন ২৩৪ বর্গ কিঃ মিঃ, ইউনিয়নের সংখ্যা ১২, পৌরসভা ১, মোট লোকসংখ্যা ৪ লাখ ৭৫ হাজার, এর মধ্যে হিন্দু ৫০ হাজার। এই উপজেলায় কোন খ্রীস্টান বা বৌদ্ধ নেই। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৭১, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের কলেজের সংখ্যা ৮, স্বীকৃত মাদ্রাসার সংখ্যা ৩৭, সমাজ-স্বাস্থ্য-ক্লিনিকের সংখ্যা ১৫, ৫০ শয্যা সংবলিত সরকারী হাসপাতাল ১, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১, হাসপাতালে কর্মরত ১৮ জন চিকিৎসকসহ ১ম শ্রেণীর অফিসারের সংখ্যা ৩৮। ২০০৮ থেকে শুরু করে আমরা এই উপজেলার ২৪৩টি গ্রামের সবকটিতে বিদ্যুত সংযোগ দিতে পেরেছি। বিদ্যুতের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার জন্য ৩টি বিদ্যুত উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তঃজেলা সড়ক সংযোগের আওতায় পার্শ্ববর্তী ৪টি উপজেলার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য ও গতায়ত বাড়ানো হয়েছে এবং এর বাইরে গৌরিপুর-সাচার-কচুয়া-হাজিগঞ্জ সড়ক নির্মাণ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরের সঙ্গে সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ১০০০ কিঃমিঃ বিদ্যুত সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন স্থাপন করে এই উপজেলার সকল ঘর আলোকিত করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে যাওয়া ও আসার জন্য আমরা পাকা সড়ক নির্মাণ করেছি এবং মোবাইল ফোনের মালিকানার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। সকল ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে ডিজিটাল কেন্দ্র এবং ১১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও কলেজে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ উপজেলায় এখন পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ১৫টি শাখা স্থাপিত হয়েছে। এই এলাকায় কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। আউশ, আমন ও বোরো ধানের আবাদের সঙ্গে সমসাময়িক কালে যোগ হয়েছে গম, আলু, ভুট্টা ও শাক-সবজির আবাদ। স্থানীয় এলাকায় প্লাবন নিয়ন্ত্রণ ও অতিরিক্ত পানির নিষ্কাশন, সেচ সম্প্রসারণ ও উফশী বীজের প্রয়োগ, কৃষি ঋণের সন্তোষজনক বিতরণ এবং কৃষির যন্ত্রীকরণ কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়িয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে দুই যুগের আগে ব্যবহৃত গরুর লাঙ্গল, জোয়াল, চংগা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই উৎপাদন ক্ষুদ্র ও ভাগ চাষীর আয় বাড়িয়েছে এবং কৃষি মজুরদের মজুরির হার শিল্পখাতের মজুরির সমতুল্য করেছে। নগরাঞ্চলে বসবাস বা চাকরিরত এককালের ভূমি ধনীদের গ্রামীণ জমি প্রকৃত চাষীর কাছে বিক্রয়ের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুদ্র ও ভাগ চাষীর উৎপাদনশীলতা ও কৃষি মজুরির বাড়া সমকালে ৩০ বছরের আগে সুপারিশকৃত ভূমি বণ্টনভিত্তিক ভ‚মি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আমাদের চোখে এখন তুলে ধরছে না (দ্রষ্টব্য : ল্যান্ড রিফর্মস ইন বাংলাদেশ : মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ১৯৮০)। ২০১৭-১৮ সালে দেশের কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অনুমিত হয়েছে বার্ষিক ৩.১%। কচুয়ায় কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি জাতীয় পর্যায়ে অনুমিত এই হারের চেয়ে ন্যূন পক্ষে ১% বেশি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শস্য ও সবজির বাইরে বাণিজ্যিকভাবে গবাদি পশু পালন, হাস-মুরগির উৎপাদন এবং মাছের চাষ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। ২০১৭-১৮ সালের সার্বিকভাবে দেশের কৃষি খাতে অনুমিত উৎপাদনের হার থেকে কচুয়ায় অর্জিত হার বেশি হয়েছে বলে অনুমিত হয়েছে। অবশ্য বন ও সংশ্লিষ্ট খাতে দেশের সার্বিকভাবে প্রক্ষেপিত হারের উৎপাদন পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় অর্জিত হয়নি বলে মনে হচ্ছে। শিল্পখাতে ২০১৭-১৮ সালে হিসাবকৃত জাতীয় উৎপাদন বাড়ার ১২% হারের চেয়ে এই উপজেলায় উৎপাদন ১% ভাগ কম হয়েছে। তবে বিদ্যুত ও সড়কের বিস্তৃত যোগাযোগ অচিরেই এই এলাকাকে শিল্পোন্নত এলাকায় উন্নীত করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সেবা খাতে ২০১৭-১৮ সালের অনুমিত দেশের সার্বিক উৎপাদন বাড়ার হার (৬.৩%) এর চেয়ে এই উপজেলায় প্রকৃত উৎপাদন বেশি (১০% ভাগ) হয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে। এ খাতে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটেছে ছোট ছোট বাণিজ্যিক দোকানের সংখ্যায়। এর সঙ্গে যোগ করা যায় সরকারী সমাজ কিøনিক এবং বেসরকারী হাসপাতাল ও চিকিৎসালয় বাড়ানোর সংখ্যা। এই উপজেলায় ৫টি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র, নামত: সাচার, পালাখাল, কচুয়া, রহিমানগর ও জগৎপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসালয়ের সংখ্যা চোখে পড়ছে। ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, পলিও ও যক্ষা রোগ এ উপজেলায় নির্মূল হয়ে গেছে। সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃতি যন্ত্রচালিত পরিবহন দিয়ে আগেকার পশুচালিত ও মানুষবাহিত যানবাহনকে সরিয়ে দিয়েছে। গরুর গাড়ি, ঠেলা গাড়ি এখন দেখা যায় না, পাল্কি বিলুপ্ত এবং নৌবাহিত পরিবহন প্রায় অদৃষ্ট হয়ে গেছে। রিকশা ও রিকশা ভ্যান এখন দ্রæত চীন থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুত-ব্যাটারিচালিত যন্ত্র লাগিয়ে নিচ্ছে, সিএনজি বা অটোরিকশার সংখ্যা ও ব্যবহার বাড়ছে। এ উপজেলায় সিএনজি বা অটো রিক্সার সংখ্যা ২০০ এ উঠে গেছে। মিনি ট্রাক ও ভ্যানের ব্যবহার ৭/৮ বছরের প্রত্যন্ত এলাকাকে যোগাযোগ- সমৃদ্ধ এলাকায় উঠিয়ে নিয়ে এসেছে। নতুন বর বধূর আগমন ও নির্গমণে পাল্কি-নৌকার বদলে সর্বক্ষেত্রে মিনি মাইক্রোবাস ও ট্যাক্সি ক্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও চাঁদপুরের সঙ্গে বাস সংযোগ বেড়ে চলছে। কচুয়া-ঢাকা, কচুয়া-কুমিল্লা ও কচুয়া-চাঁদপুরের মধ্যে সড়ক ধরে প্রতিদিন ৭০টি বাস চলাচল করছে। জনগণের যাতায়াত ও পণ্যাদির পরিবহন দর্শনীয়ভাবে বেড়েছে। বিদ্যুতের লভ্যতা গৃহস্থালি পর্যায়ে শারীরিক শ্রম কমিয়েছে, কাজকর্ম অপেক্ষাকৃত আরামপ্রদ করেছে, খাদ্য সংরক্ষণের উপায় ও মানসিকতা বিস্তৃত হয়েছে। বিদ্যুতের আলো কাজকর্ম করা এবং বিনোদনমূলক উপভোগ্যতার সময় ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে, ছোট খাট শিল্প- উদাহরণত কাঠ চেরাই, আধুনিক পদ্ধদিতে আসবাবপত্র নির্মাণ, চিড়া-মুড়ি গ্যাসের চুলায় ভাজা, রুটি-বিস্কুট বানানো, হালকা প্রকৌশল কারখানা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে। ৩টি হিমাগার, ৫টি মাছের খাবার তৈরির শিল্প, ৩টি বরফ কল স্থাপিত হয়েছে, ৫টি আধুনিক ইটের ভাটা দিন রাত কাজ করছে। এলুমিনিয়ামের তৈজসপত্র ও সিট মেটালের অনুষঙ্গ ও যন্ত্রপাতি নির্মিত হচ্ছে। সেচভিত্তিক ফসল উৎপাদন, উদাহরণত বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু ও টোমেটোর উৎপাদন বাড়িয়েছে। রাইস কুকার, এয়ার কুলার, কাঠের ও স্টেনলেস ইস্পাতের আসবাব পত্র, সাইকেল ও মোটরসাইকেলের দোকান ও ডিলারশীপ এখন এই এলাকার বাজারে দৃষ্ট হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিদ্যুতের লভ্যতা ও ব্যবহার মন থেকে কুসংস্কার দূর করে আত্মশক্তিতে অধিকতর প্রত্যয়ী হিসেবে সকল মানুষকে বাঁধা, ব্যত্যয় পার হয়ে জয় করার সন্দিপন যুগিয়েছে। আমাদের বিবেচনায় উৎপাদশীলতা ও উদ্ভাবনশীলতা বাড়ানোর পথে বিদ্যুতের লভ্যতা সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক উপকরণ হিসেবে কাজে লেগেছে। বলা হচ্ছে যে সকল গ্রামে বিদ্যুৎ লভ্য সেসব গ্রাম থেকে প্রথাগত ভীতির দৈত্য দানব ও ভুত পেত্নী বিদায় নিয়েছে। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এখন ১৭৫২ মার্কিন ডলার বা টাকার হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গড় গৃহস্থালীর আকার ৪.৫জন এর হিসাবে ১টি গৃহস্থালীতে আয় দাঁড়িয়েছে মাথা পিছু বার্ষিক ৩২,৭০০ টাকা। এই হিসাবে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বাঙালীরা এখন সচ্ছল। এই সচ্ছলতা কচুয়ায় দৃশ্যমান। সমকালে এই এলাকায় কারও গা উদাম নয়, পরিচ্ছদ ছেড়া নয় এবং ঘরের বাইরে হাঁটা জুতাবিহীন নয়। বেশ সংখ্যক গ্রামে গ্যাস সংযোগ এসেছে, ৯৭% গৃহস্থালীতে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিষ্টা ব্যবস্থাপনার সুবিধা বিদ্যমান। চলবে... লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা
×