ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

প্লেসিবোর বিস্ময়

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৩ অক্টোবর ২০১৮

প্লেসিবোর বিস্ময়

প্লেসিবো কোন ওষুধ নয়। তবে রোগীর মন রাখার জন্য ওষুধ বলে চালানো হয়। এতে সক্রিয় কোন চিকিৎসা উপাদান থাকে না। তারপরও প্লেসিবো খেয়ে অনেক রোগীকে ভাল হয়ে যেতে দেখা গেছে। চিকিৎসক সমাজ প্লেসিবোর এই ভূমিকা সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই সচেতন। এমনকি অনেক রোগী জেনে শুনে প্লেসিবো সেবন করে সুস্থ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি আমেরিকার হার্ভার্ডের প্রফেসর অব মেডিসিন টেড কাপটচুক প্লেসিবো নিয়ে প্রকাশ্য এক সমীক্ষা চালান। ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) আক্রান্তদের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয় যে, চিকিৎসার জন্য তাদের প্লেসিবো দেয়া হচ্ছে এবং ওষুধের গায়েও প্লেসিবো লেবেলটি এঁটে দেয়া হয়। সমীক্ষক দল সবিস্ময়ে দেখতে পান যে, প্লেসিবো পিল সেবনকারীদের অর্ধেক সংখ্যকের অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুটো আইবিএসের ওষুধ খেয়ে যে ফল পাওয়া যেত তার কাছাকাছি ফল পেয়েছেন তারা। একটি কেন্দ্রে গবেষকরা প্লেসিবো দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে ২৭ জন রোগীর চিকিৎসা করেছেন। প্লেসিবো রোগ নিরাময় বা উপশমে ঠিক কিভাবে কাজ করে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলেন যে, মানবদেহ চিকিৎসার আনুষ্ঠানিকতায় দেহগত ও শরীরবৃত্তীয়ভাবে অবচেতন মনে সাড়া দেয়। অন্যদের বক্তব্য হচ্ছে ইতিবাচক চিন্তার পরিণতিতে এমনটা হয়। তা ভাল হোক আর মন্দ হোক উদ্যোক্তারা এখন প্লেসিবোর দিকে নজর দিতে শুরু করেছেন, যার ফলে প্লেসিবো পিলের শিশু এখন এ্যামাজনের দোকানে ৮ থেকে ১৫ ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। প্লেসিবো ব্যবহারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ১৮০৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, ‘আমার পরিচিত একজন অত্যন্ত সফল চিকিৎসক আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি সত্যিকারের ওষুধ যত না প্রয়োগ করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছিলেন রুটির বড়ি, হিকরি কাঠের ছাই ও রঙিন পানি।’ আজকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্লেসিবো বেশ ভালভাবেই স্বীকৃত। এমনকি সার্জারির ক্ষেত্রেও তা পরীক্ষিত। হাঁটুর জায়গাটা কেটে খুলে কোন চিকিৎসা ছাড়াই আবার সেলাই করে দিয়ে দেখা গেছে যে, হাঁটুর অক্সিওআর্থাইটিসে ভোগা ব্যক্তির সত্যিকারের নী-সার্জারি করে যে সুফল পাওয়া গেছে, সেই একই সুফল পূর্বোক্ত সার্জারিতেও পাওয়া গেছে। তবে প্লেসিবোর প্রভাবের ক্ষেত্রে কিছু তারতম্যও আছে। দেখা গেছে যে একজন রোগীকে যদি বলা হয় একটা ওষুধ পাওয়া কঠিন বা খুব ব্যয়বহুল, সেক্ষেত্রে প্লেসিবোর প্রভাব জোরালো হয়। তাছাড়া রঙেরও আলাদা প্রভাব আছে। ঘুমের ওষুধ হিসেবে নীল রঙের পিল এবং ব্যথার জন্য সাদা রঙের পিল বেশি কাজ দেয়। তবে এখনও অনেক কিছু অজানা। কারও কারও ক্ষেত্রে প্লেসিবো বেশ ভাল কাজ দেয়। আবার কারও ক্ষেত্রে একই প্লেসিবোতে কোন কাজ দেয় না। মাইগ্রেনের কোন চিকিৎসা না নেয়া ব্যক্তিদের তুলনায় প্লেসিবো সেবনকারীরা অধিকতর স্বস্তি পেয়েছে। অন্যান্য সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রকৃত ওষুধের বদলে জেনেশুনে প্লেসিবো সেবন করেছে এমন ক্যান্সারের রোগীরা ক্লান্তি, অবসন্নতার মতো লক্ষণগুলোর ক্ষেত্রে উন্নতি দেখতে পেয়েছে। ২০১৬ সালে ‘পেইন’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপের্টে বলা হয়, লিসবনের একটি হাসপাতালে ক্রনিক লো ব্যাক পেইনে ভোগা ৮৩ ব্যক্তিকে দুই গ্রুপে ভাগ করে এক গ্রুপকে প্রচলিত বেদনানাশক ওষুধ দেয়া হয় এবং অন্য গ্রুপকে প্লেসিবোর লেবেল আঁটা বোতলে প্লেসিবো দেয়া হয়। তিন সপ্তাহ পর এক প্রশ্নপত্রে তাদের সবাইকে বেদনার মাত্রা কার কতটুকু হ্রাস পেয়েছে লিখতে বলা হয়। দেখা যায় পেইনকিলার খাওয়া লোকেরা তাদের গতানুগতিক ব্যথা ৯ শতাংশ এবং চরম ব্যথা ১৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে জানায়, তবে তাদের অক্ষমতার কোন উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে জেনেশুনে প্লেসিবো খাওয়া ব্যক্তিরা জানায়, তাদের গতানুগতিক ও চরম এই দুই ধরনের ব্যথাই ৩০ শতাংশ কমেছে এবং অক্ষমতা সমস্যাও হ্রাস পেয়েছে ২৯ শতাংশ। কেন এমন হয়? এর জবাবে টেড কাপটচুক নামে হার্ভার্ডের মেডিসিনের অধ্যাপক বলেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য নয়। তবে কখনও কখনও মনের চেয়ে বেশি জানে দেহ। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছেন যে, প্লেসিবোর প্রভাবে বিষণœতাবোধক ওষুধে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়। ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যারা প্লেসিবো পিল খেয়ে উপকার পেয়েছেন সেই একই শ্রেণীর লোকদের বিষণœতাবোধক ওষুধ খেয়ে ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে প্লেসিবোতে উপকার পাওয়া গেলেও খোদ প্লেসিবোর কারণে রোগের নিরাময় কদাচিৎ ঘটে থাকে। প্লেসিবো যদিও বা কোন রোগের লক্ষণের উন্নতি ঘটিয়ে থাকে, তথাপি সেই রোগের অন্তর্নিহিত শরীর, বৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলো প্লেসিবোর প্রভাবে পরিবর্তিত হয় কিনা তা স্পষ্ট নয়। যেমন, প্লেসিবো ক্যান্সার দুষ্ট টিউমারের আকার ছোট করতে পারে না। তারপরও প্লেসিবো চিকিৎসায় মস্তিস্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো এমনভাবে সক্রিয় হয়, যা ক্যান্সারের লক্ষণ উপশমে ভূমিকা পালন করতে পারে। স্কুলে যাওয়ার আগে অনেক বাচ্চা পেটব্যথার কমপ্লেন করে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে এটা স্কুলে না যাওয়ার একটা বাহানা হতে পারে। জেনি ডান্টো নামে এক থেরাপিস্ট এ সমস্যার এক সমাধান বের করেছেন, যা প্লেসিবোর আরেক রূপ। ‘ম্যাজিকফিল গুড’ নামে সেই প্লেসিবোটি আসলে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পিল। এ্যামাজনে এটা ৯ ডলারে কিনতে পাওয়া যায়। ডান্টো নিজে পাঁচ বাচ্চার মা। বাচ্চাদের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। বাচ্চারা যখন ছোট ছিল প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন বাচ্চা স্কুলে যাওয়ার সময় পেটব্যথার ভান করত। ডান্টো ব্যাপারটা টের পেয়ে এই প্লেসিবো উদ্ভাবন করেন। এতে বেশ কাজ হয়। বাচ্চারা আর বাহানা করতে পারে না। অনেক বাবা-মা এ ধরনের ক্ষেত্রে ব্যথানাশক টাইলিনল দিয়ে থাকেন, যা শুধু অনাবশ্যকই নয়, অকারণে দেয়ার জন্য ক্ষতিরও কারণ হতে পারে। উয়ি হেইস নামে এক স্বাস্থ্য সেবাকর্মী অনলাইনে প্লেসিবো পিল বিক্রি করে থাকেন। তবে তা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তাঁর নীল ও সাদা রঙের পিলগুলোর নাম ‘জিবো’ এবং এতে কোন সক্রিয় উপাদান নেই। থেইস জানান যে, ২০১৫ সাল থেকে তিনি এই জিনিস বিক্রি করছেন এবং তার কোম্পানি হাজার হাজার বোতল বিক্রি করেছে। এটা যে প্লেসিবো তা বোতলের গায়েই লেবেল এঁটে দেয়া আছে। হেইস নিজেও প্রতিদিন এই পিল খান ব্যথা ও স্ট্রেস থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য। প্রতিবার প্লেসিবো পিল সেবনের সময় তিনি কি উদ্দেশে খাচ্ছেন, মনকে তার ওপর জোর দেয়ার চেষ্টা করেন এবং সেটা উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠেনÑ আমি এই পিলটি খাচ্ছি যাতে আমার মন পিঠের ব্যথার কষ্ট থেকে স্বস্তি লাভ করে। তার দৃঢ়বিশ্বাস, এতে কাজ হয়। আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন অবশ্য প্লেসিবো সম্পর্কে বেশ সতর্ক। সমিতির চিকিৎসা বিষয়ক নীতিমালায় বলা আছে যে, ডাক্তাররা রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য প্লেসিবো শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন, যদি তা গ্রহণের ব্যাপারে রোগীর সম্মতি ও সহযোগিতা থাকে। সূত্র : টাইম
×