ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তবু হৃদয় জয় করেছে লাল-সবুজের দল

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

তবু হৃদয় জয় করেছে লাল-সবুজের দল

আগে প্রচুর হলেও বর্তমান ফুটবল-বিশ্বে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোর বেশিরভাগই চলে গেছে হিমাঘরে। অল্প কয়েকটি হাতে গোণা টুর্নামেন্ট হয়, সেগুলোর একটি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা।’ সেই এ টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে গেল কদিন (১২ অক্টোবর) আগেই। এ নিয়ে আসরটি অনুষ্ঠিত হলো পঞ্চমবারের মতো। সর্বশেষ ২০১৬ আসরে ৮ দল অংশ নিলেও এবার দলের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬-এ। এশিয়ার পাঁচটি ফুটবল জোন আছে। এই ৫টি জোন থেকে ৫টি দেশ এবং স্বাগতিক বাংলাদেশতে নিয়েই আসরটি আয়োজিত হয় তিনটি ভেন্যু সিলেট, কক্সবাজার এবং ঢাকায়। আগের চার আসর খেলে একবার রানার্সআপ হয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনাল খেলা। সেই লক্ষ্য শতভাগ পূরণ হয়েছে তাদের। তবে একটু চেষ্টা করলে ফাইনালেও উঠতে পারতো তারা। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হওয়াতে সেই আশা পূরণ হয়নি। তবে ফাইনালে উঠতে না পারলেও ঠিকই দেশবাসী-ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে লাল-সবুজ বাহিনী। সেমিতে তারা যাদের কাছে হেরেছিল, সেই ফিলিস্তিনই শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতে। ফাইনালে তারা টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে তাজিকিস্তানকে হারিয়ে এই আসরের নতুন শিরোপাধারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। এবারের টুর্নামেন্টের দলগুলোকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। যেখানে ‘এ’ গ্রুপে ছিল ফিলিস্তিন, নেপাল ও তাজিকিস্তান। আর গ্রুপ ‘বি’তে ছিল বাংলাদেশ, ফিলিপিন্স ও লাওস। গ্রুপ পর্বের ৬টি খেলা অনুষ্ঠিত হয় হাওড়-বাওড়ের দেশ, দেশের আধ্যাতিœক রাজধানী এবং পর্যটনের নগরী সিলেটে। দেশের সবচেয়ে ধনী জেলা হিসেবেও সুখ্যাতি আছে সিলেটের। তাছাড়া এ অঞ্চল সুপরিচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ওসমানীর জন্মস্থান হিসেবে। উল্লেখ্য, এর আগে সিলেটে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের খেলা হয়েছিল ২০১৫ সালে। সেবার রানার্সআপ হয়েছিল লাল-সবুজরা। নিজেদের প্রথম ম্যাচে তারা ১-০ গোলে লাওসকে হারিয়ে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটায়। এই সিলেটের মাটিতেই প্রথমবারের মতো তারা কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললো। আর অভিষেকেই কুড়িয়ে নেয় সফলতা। আসর শুরুর আগে তারা দুদিন সিলেটের খাদিমনগরে বিকেএসপির মাঠে অনুশীলনে ঘাম ঝরায়। ‘জয় বাংলাদেশ! বাংলাদেশের জয়! জিতেছে রে জিতেছে, বাংলাদেশ জিতেছে! ... এরকম অসংখ্য স্লোগানে সোমবার মুখরিত হয়ে উঠেছিল সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি। উল্লসিত হাজার বিশেক দর্শকের অধিকাংশের হাতেই মোবাইল ফোনের অন করা ফ্লাশলাইট যেন সৃষ্টি করেছিল মায়াবী এক পরিবেশের। সুরমাবাসীদের এই আবেগকে বৃথা যেতে দেননি ‘লোকাল বয়’ বিপলু আহমেদ। ম্যাচের ৬০ মিনিটে তার দেয়া গোলেই হারের তেতো স্বাদ পেতে হয় আসিয়ান অঞ্চলের ফুটবল-শক্তি লাওসকে। সিলেটের মাটিতে এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ঐতিহাসিক ‘প্রথম’ জয়! এই জয়ে ‘বি’ গ্রুপ থেকে সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা উজ্জ্বল করে স্বাগতিক দল। মাঠের চারদিকে ডিজিটাল সাইনবোর্ডের অনুপম প্রদর্শনীÑ সিলেট দিয়েই শুরু হয়। ম্যাচের বিরতির পরই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। সেটা লোকালবয় বিপলুর বদৌলতে। নিজের প্রিয়জনদের চোখের সামনে খেলে ঘরের মাঠে গোল এবং দলের জয় ... এই দুটি ঘটনা যখন একসঙ্গে মিলে যায়, তখন স্বভাবতই আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকে না। সোমবার লাওসের সঙ্গে ম্যাচ শেষ হবার পর থেকেই মনটা আনচান করছিল, পরিবারের সবার সান্নিধ্যে গিয়ে একটু সময় কাটানোর। অবশেষে কোচের কাছ থেকে মিললো কাঙ্খিত সেই অনুমতি। সঙ্গে সঙ্গে দে ছুট সুবিদবাজারের বাসায়। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল বিশেষ এক চমক। আত্মীয়-স্বজনরা ফুলের মালা দিয়ে সাদরে বরণ করে নেয় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বিপলু আহমেদকে। আর প্রিয় গর্ভধারিণী মা হালিমা বেগম তো ছেলেকে আবেগে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসালেন (বাবা সাবেক ব্যবসায়ী রেহান আহমেদ, সাত ভাই দুই বোন। বিপুল সবার ছোট)। তার ছেলের গোলেই যে লাল-সবুজরা লাওসকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শেষ চারে যাবার স্বপ্ন জোরালো করে তুলেছে! বিপলুর ফুটবলার হওয়ার গল্পটা এরকম, ‘আমি আসলে অলরাউন্ডার-ক্রিকেটার ছিলাম। ভাল অফস্পিন করতাম। তবে বড় ভাইদের (আরেক ভাই শিপলু, তিনিই বিপলুর আদর্শ, বিদেশে আদর্শ ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো) ফুটবল খেলতে দেখেই ফুটবলে আগ্রহী হই। ফুটবলার হয়েছি বড় ভাই বাবলু আহমেদের (ব্যবসায়ীও বটে) অনুপ্রেরণায়। তিনি নিজেও সিলেটের ফুটবলার। আমার প্রথম কোচ তিনিই। ফুটবলের মৌলিক বিষয়গুলো তার কাছেই শেখা। এলাকার কোন ক্লাবে না খেলে ঢাকায় মোহামেডান অ-১৬ দলে আমাকে ট্রায়াল দিতে তিনিই পাঠান। তবে ঢাকায় যাবার বিষয়টি সবার আগে ভাইয়াকে বলেছিলেন সাবেক জাতীয় ফুটবলার ওয়াহেদ আহমেদ।’ ঢাকায় যাবার আগে সিলেটে উপজেলা কাপ এবং কিছু স্থানীয় টুর্নামেন্ট খেলেন বিপলু। এরপর ঢাকায় যান ২০১৩ সালে। মোহামেডান অ-১৬ দলের হয়ে খেলেন। মোহামেডানের সিনিয়র দলেও ট্রায়াল দেন (কোচ ছিলেন সাইফুল বারী টিট ও জসিম আহমেদ জোসি)। ৪০০ জন থেকে চূড়ান্ত ৪০ জনের মধ্যে ছিলেন। তবে অনুশীলন করলেও খেলা হয়নি। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম বিভাগে খেলার পর। সেটা ২০১৪ সালে। এখন যোগ দিয়েছেন শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রে। একসময় ইউরোপে খেলার স্বপ্ন দেখেন তিনি। প্রথম আন্তর্জাতিক গোল প্রসঙ্গে বিপলু জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গোলরক্ষক কোচ নুরুজ্জামান নয়ন ম্যাচের আগে এবং বিরতির সময় অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ। এছাড়া সহকারী কোচ কায়সার ভাইও অনেক সাপোর্ট করেছেন।’ লাওস ম্যাচের শেষদিকে ডান পায়ের গোঁড়ালির একটু ওপরে প্রচ- চোট পান দলের অন্যতম সিনিয়র-অভিজ্ঞ লেফট ব্যাক ওয়ালী ফয়সাল। পরের ম্যাচে তাই তাকে বিশ্রামে রাখেন কোচ জেমি ডে। ঢাকার মাঠে ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো ড্রিবলিং করে গোল করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন গত বছরের ডিসেম্বরে (লীগ ম্যাচে সাইফের হয়ে, বিপক্ষ মুক্তিযোদ্ধা)। সেরকম কিছু করে দেখানোর আকাক্সক্ষা ছিল জন্মভূমি সিলেটের মাঠেও। কিন্তু বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে যেখানে অন্য তিন ‘সিলেটী’ জনি, বিপলু এবং সুফিলকে লাওসের বিপক্ষে খেলালেও কোচ জেমি ডে তাকে মাঠেই নামাননি! ফিলিপিন্সের বিরুদ্ধে খেলার জন্য এই প্রতিবেদকের কাছে তার ছিল আকুতি কণ্ঠ,‘জানি না কোচ আমাকে খেলাবেন কি না। তবে যদি বদলি হিসেবে বা সময়ের জন্য হলেও খেলান, আমি প্রস্তুত আছি এবং সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল করার চেষ্টা করে দলকে সাহায্য করতে পারবো। আমি এক মিনিটের জন্য হলেও খেলতে চাই।’ কোচ অবশ্য মতিনকে খেলিয়েছেন। তবে শেষের ১০ মিনিট। লাওসের বিপক্ষে ম্যাচটি দেখতে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে হাজির হয়েছিল মতিনের পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা। সংখ্যাটা ৭০০! তবে ওই ম্যাচে মতিনকে না খেলানোয় তারা হতাশ হয়েছিলেন। অভাবের সংসারে অর্থের জোগান দিতে মতিন ঢুকেছিলেন রং মিস্ত্রির কাজে। তারপর হয়ে যান ‘খেপ’ ফুটবলার। তারপর সুযোগ পেয়ে ঢাকায় চলে আসনে ক্লাব ফুটবলে। তারপর জাতীয় দলে। কদিন আগে নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত ফিফা প্রীতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলেছেন। ওটাই তার ছিল অভিষেক ম্যাচ। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের এবারের আসরে সেমিফাইনালে উঠতে বাংলাদেশকে মাঠে নামতেই হয়নি! তাদের শেষ চারে নাম লেখানোটা সম্ভব হয় ফিলিপিন্সের বদৌলতে। গ্রুপ ম্যাচে তারা ৩-১ গোলে হারায় লাওসকে। এই ম্যাচের আগে সমীকরণটা ছিল এমনÑ ফিলিপিন্স জিতলে তারা বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে শেষ চারে। লাওস জিতলে শেষ ম্যাচে ফিলিপিন্সের বিরুদ্ধে ম্যাচে বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে ড্র। আর লাওস ড্র করলেও সেমিতে যাবে স্বাগতিক দল। শেষ পর্যন্ত লাওস আর জিততে পারেনি। বরং হেরেই এই আসর থেকে সবার আগে বিদায় নেয়। তাদের বিদায়ে কপাল খুলে যায় লাল-সবুজদের। এটা তাদের জন্য যেন ফিলিপিন্সের উপহার! এজন্য ফিলিপিন্স দলকে ধন্যবাদ দিতেই পারে বাংলাদেশ। এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো এই আসরে সেমিতে ওঠে লাল-সবুজরা। এর আগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে এমন কৃতিত্ব দেখিয়েছিল স্বাগতিক দল। ২০১৫ আসরে রানার্সআপ হয়েছিল তারা। ‘মাসুক’ শব্দের অর্থ প্রেমাস্পদ, ভালবাসার পাত্র। ফুটবল খেলে, দেশের মুখ উজ্জ্বল করে সবার ভালবাসার পাত্র হতে চান মাসুক মিয়া জনি। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে লাওসকে হারানোর ম্যাচের গোলদাতা বিপলু আহমেদের সঙ্গে তিনটি মিল আছে মাসুকের। দুজনেই একসময় একসঙ্গে মোহামেডানে খেলেছেন (মাসুক এখন যোগ দিয়েছেন বসুন্ধরা কিংসে, আর বিপুল শেখ রাসেলে)। দুজনেই খেলেন মিডফিল্ড পজিশনে। দুজনেই সিলেটের সন্তান। আরও মজার ব্যাপারÑ জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড মাহবুবুর রহমান সুফিল হচ্ছেন জনির দূর সম্পর্কের ভাগ্নে! একই পাড়ায় পাশাপাশি বাসা। বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। ২০১৫ সালে জাতীয়-সিনিয়র দলে অভিষেক হওয়া মাসুক এ নিয়ে ১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। তবে সিলেটে খেলেছেন এই প্রথমবারের মতো। শ্রীমঙ্গল ফুটবল একাডেমি দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু মাসুকের। একাডেমির কোচ ছিলেন সাবেক জাতীয় ফুটবলার একরাম রহমান রানা। ‘এলাকায় ফুটবল খেলতাম খালি পায়ে। ভালই খেলতাম। সবাই বললো, বুট পড়ে খেপ খেলতে হবে। সেটা ২০০৬/০৭ সাল। এভাবেই শুরু।’ স্মৃতিচারণ মাসুকের। ঢাকায় তিনি খেলতে যান ২০১৩ সালে, দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল খেলতে, চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে। এর আগে খেলেন চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার লীগে, চট্টগ্রাম ব্রাদার্সের হয়ে। ২০১৫ সালে অ-১৯ দলে ডাক পান মাসুক। ছিলেন ওই দলের অধিনায়ক। মজার ব্যাপারÑ ওই দলের সাত ফুটবলার বর্তমান সিনিয়র জাতীয় দলে আছেন। তারা হলেন : মাসুক, বিপলু, বাদশা, রহমত, বিশ^নাথ, জিকো এবং ইব্রাহিম। ২০১৫ সালেই সিনিয়র জাতীয় দলে অভিষেক, তাজিকিস্তানের বিরুদ্ধে (বিশ^কাপ বাছাইপর্বে)। এখনও কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল নেই তার। মাসুকের পরিবারে আছে বাবা, মা এবং তিন বোন। মাসুকই সবার বড়। ফুটবল খেলে সংসারটা তিনিই চালান। দু’দলের সেমিফাইনালে নাম লেখানোটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। ফলে ‘বি’ গ্রুপের শেষ ম্যাচটি ছিল একদিকে আনুষ্ঠানিকতার, অন্যদিকে ছিল গ্রুপসেরা নির্ধারণের। যাতে ভাল খেলেও ভাগ্যবঞ্চিত হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। সিলেট জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় তারা ০-১ গোলে হেরে যায় ফিলিপিন্সের কাছে। বৃহস্পতিবারের ম্যাচে স্টেডিয়ামের গ্যালারির ২৫ হাজার আসন ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। স্টেডিয়ামের বাইরে অপেক্ষমান ছিল আরও কমপক্ষে ১৫ হাজার দর্শক। অভিযোগ উঠেছেÑ এদের অনেকেই ৫০ টাকার টিকেট কিনেও স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে ঢুকতে পারেনি। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষের সঞ্চার হয় দর্শকদের মাঝে। পরিসিস্থি সামাল দিতে মাঠে ঢুকে খেলা শুরুর আগে মাইক্রোফোন নিয়ে দর্শকদের কাছে ক্ষমা ও দুঃখপ্রকাশ করেন সিলেট জেলা ফুটবল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং বাফুফের সদস্য মাহিউদ্দিন আহমেদ সেলিম। তিনি বলেন, ‘যেসব দর্শক ৫০ টাকার টিকেট কিনেও গ্যালারিতে ঢুকতে পারেননি, তাদেরকে টিকেট প্রদর্শন স্বাপেক্ষে ১০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আর ঘটবে না।’ পুরো ম্যাচে একমাত্র গোল হজমের বিষয়টি বাদ দিলে বাকি ৭৬ মিনিটই রাজত্ব-আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছে বাংলাদেশ। প্রচুর আক্রমণ শাণিয়েছে। গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। শুধু গোলটিই করতে পারেনি! কখনও ছোট পাস, কখনও লম্বা পাস, কখনও চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং ... দর্শকরা হয়েছেন মুগ্ধ। কিন্তু জয় দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাদের। ভাল খেললেই যে জেতা যায় না, সেটা যেন আরেকবার প্রমাণ করে জেমি ডের শিষ্যরা। ফুটবলটা যে বাংলাদেশে এখনও জনপ্রিয়, সেটা বোঝা যায় ঢাকার বাইরে খেলা হলে। স্টেডিয়াম বা মাঠ তো বটেই, দর্শক দেখা যায় মাঠের আশপাশের উঁচু বাসার ছাদে, গাছের ডালে, টিনের চালে, বৈদ্যুতিক টাওয়ারে ... আরও কত জায়গায়, তার কোন হিসেব নেই। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল আছে, যেগুলো একসময় ছিল ফুটবলার তৈরির আঁতুরঘর। যেমন নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর। এই জেলাগুলো বিভিন্ন সময়ে দেশকে উপহার দিয়েছে মোনেম মুন্না, চুন্নু, কায়সার হামিদসহ অনেক ফুটবলার। এই তালিকায় আরেকটি জেলার নাম সংযোজন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। জেলাটির নাম হচ্ছে কক্সবাজার। অনেকের মতে, বর্তমানে ঢাকার ফুটবলে সবচেয়ে বেশি ফুটবলার খেলে থাকেন কক্সবাজারের। সেক্ষেত্রে বলা যায়, দেশের ফুটবলে নীরব বিপ্লব ঘটাচ্ছে কক্সবাজার। গ্রুপ পর্যায়ের সব খেলা শেষ হয় সিলেটে। সেমিফাইনালের খেলা দুটি হবে কক্সবাজারে। সিলেট থেকে কক্সবাজারে এসেই কক্সবাজারের বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামে গিয়ে জানা গেল এই এলাকার ফুটবলারদের সম্পর্কে। এই মুহূর্তে এই জেলার দেড়শো ফুটবলার ঢাকার প্রিমিয়ার লীগ, চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগ, পাইওনিয়ার লীগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলছে। এদের মধ্যে ২০ জন খেলছে পেশাদার লীগের সর্বোচ্চ স্তরে এবং চারজন খেলছে জাতীয় সিনিয়র দলে। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার।’ সেমিতে বাংলাদেশ মোকাবেলা করে ফিলিস্তিনের। খেলা হয় বৃষ্টিভেজা-পিচ্ছিল মাঠে। কারণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ। এটা স্থানীয় জনগণ বা পর্যটকদের জন্য স্বস্তির হলেও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অতিথি দলগুলোর জন্য। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের জন্য। এদিকে সেমির একদিন আগে বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন বাংলাদেশ কোচ জেমি ডে। পুরোপুরি সুস্থ অনুভব করলে ম্যাচের দিন দুপুর ১২টায় হাসপাতাল ছেড়ে টিম হোটেলে ফিরে যান জেমি। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে হেরে যায় বাংলাদেশ, ২-০ গোলে। এই আসরে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো সেমিফাইনাল খেললো বাংলাদেশ এবং সেমিফাইনাল খেলে বিদায় নিল দ্বিতীয়বারের মতো। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সেমির ম্যাচে বাহরাইন অ-২৩ জাতীয় দলের কাছে ০-১ গোলে হেরেছিল স্বাগতিক দল। বুধবার বিপুল দর্শক সমর্থন এবং অনুকূল আবহাওয়া (বৃষ্টির কারণে মাঠ ছিল ভেজা, কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল) ... কোনটি দিয়েই হার এড়াতে পারলো না বাংলাদেশ দল। যদিও তারা চমৎকার গতিশীল-লড়াকু ফুটবল খেলেছে, কিন্তু সেটা যে যথেষ্ট ছিল না জেতার জন্য। আসলে স্কোরলাইন কখনই বোঝাতে পারবে না সেমির ম্যাচে কতটা অসাধারণ-ভাল খেলেছিল বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে গোল মিসের আক্ষেপ নিয়ে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ দল। ব্যর্থ হয়ে যায় কন্ডিশনকে কাজে না লাগাতে পারা কক্সবাজারের মাটিতে অভিষিক্ত জাতীয় দলের সব প্রচেষ্টা। ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ফাইনালে ফিলিস্তিন মোকাবেলা করে তাজিকিস্তানকে। দু’দলই খেলে গতিশীল এবং আক্রমণাতœক ফুটবল। ম্যাচের ৩৪ মিনিটে দশজনের দলে পরিণত হয়েও দুর্দান্ত খেলে তাজিকিস্তান। বাকি সময়টা তারা এমনভাবে খেলে যেন তাদের কোন খেলোয়াড় কমতি নেই। বরং উল্টো তারা পাল্টা আক্রমণ করে বার বার ত্রাসের সঞ্চার করে ফিলিস্তিনের রক্ষণভাগে। তাজিকদের রুখতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে তারা। মনে হচ্ছিল ফিলিস্তিনেরই বরং এক খেলোয়াড় কম আছে! ফিলিস্তিন যখনই তাজিকিস্তানের গোল-সীমানায় চড়াও হয়েছে, তখনই ৯ তাজিক ফুটবলার ‘দেয়াল’ তৈরি করে তা সামাল দিয়েছে সুনিপুণভাবে। আর পাল্টা আক্রমণ করার সময় অবিশ^াস্য দ্রুতগতিতে ওপরে উঠে গিয়ে বিপদে ফেলে দেয় ফিলিস্তিন-ডিফেন্ডারদের। দু’দলই গোল করা একাধিক সুযোগ সৃষ্টি ও নষ্ট করে। তবে তাজিকদের আক্ষেপÑ তাদের একটি গোল অফসাইডের অজুহাতে বাতিল করে দেন বাংলাদেশের রেফারি মিজানুর রহমান। দশজন নিয়েও ‘তাজিক-ম্যাজিক’ হতে পারেনি টাইব্রেকার ব্যর্থতায়। এক খেলোয়াড় কম নিয়েও তাজিকদের বল নিয়ন্ত্রণ ছিল অবিশ^াস্যভাবে ফিলিস্তিনের চেয়ে বেশি (৫১%-৪৯%)! তবে আক্রমণে (৮৪-৬৬), বিপজ্জনক আক্রমণে (৫৭-৪২), কর্নারে (৮-৩) এবং শট অন টার্গেটে (৯-৩) ... সবকিছুতেই এগিয়ে ছিল ফিলিস্তিন। কিন্তু আসল কাজের কাজ ‘গোল’ই করতে পারেনি তারা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট এবং অতিরিক্ত ৩০ মিনিট ... মোট ১২০ মিনিটেও কোন দল গোল করতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচ গড়ায় ‘টাইব্রেকার’ নামক ভাগ্যপরীক্ষায়। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের পঞ্চম আসরে দু’দলই খেলেছে প্রথমবারের মতো। সোনালী প্রলেপে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ২৭ ইঞ্চি লম্বা ট্রফিটি ফিলিস্তিন দলের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনীদের জোর করে নিজেদের ভূখ- থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে পুর্ণবাসন করা করা ইহুদীদের। ওই বছরই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয়। সেই থেকে নিজেদের ভূখন্ড ফিরে পেতে লড়ে যাচ্ছে হতভাগ্য ফিলিস্তিনীরা। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইসরাইল নিপীড়ন ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনীদের ওপর। তাদের অল্প কিছু যা ভূখ- আছে, তার ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ চালিয়ে হত্যা ও গুম করছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে। এর মধ্যেই ফিলিস্তিনীরা চালিয়ে যাচ্ছে ফুটবল খেলা। যদিও তাদের বেশিরভাগ সময়ই অনুশীলন করতে হয় বিদেশের মাটিতে। এত প্রতিকূলতা স্বত্তে¦ও ফিলিস্তিন আজ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের ১০০ নম্বরে। আর তাদের চিরশুত্রু ইসরাইলের র‌্যাঙ্কিং ৯৪, যারা কিনা শতভাগ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সে তুলনায় ফিলিস্তিনের নৈপুণ্য বেশ আশাব্যঞ্জকই বটে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটি ফিলিস্তিনের চতুর্থ শিরোপা। এর আগে তারা জেতে দু’বার ‘আল নাকবা কাপ’ (২০১২ ও ২০১৪ সালে) এবং ‘এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ’ (২০১৪ সালে)। তারমানে মাত্র ছয় বছরের মধ্যে চার শিরোপা। বেশ ঈর্ষণীয়ই বলতে হবে।
×