ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

আমার ভোট আমি দেব কিন্তু ‘যাকে খুশি তাকে দেব না’

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 আমার ভোট আমি দেব কিন্তু  ‘যাকে খুশি তাকে দেব না’

‘হাত মে বিড়ি মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’- আমাদের দুই প্রজন্ম আগের বাঙালীদের কাছে অতি পরিচিত এই স্লোগান। এই ভূ-খন্ডের বাঙালীরাই একদিন এই স্লোগান মুখে একটি স্বাধীন পাকিস্তানের দাবিতে স্বোচ্চার হয়েছিল। একটি স্বাধীন পাকিস্তান তাদের পরিপূর্ণ মুক্তিএনে দিবে- এই ছিল সেদিনের বাঙালীদের প্রত্যাশা। ’৪৭-এর ১৪ আগস্ট তাদের সেই দাবি পূরণ হলেও, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক ছিল যোজন যোজন। পাকিস্তান যে বাঙালীর রাষ্ট্র না, বাঙালীর যে শুধু শাসক বদলেছে, শাসন যে তাদের না, এ কথা বুঝতে সেদিনের বাঙালীর অর্ধ দশক লেগে গিয়েছিল। এদিক থেকে তাদের দু’শ’ বছর আগের পূর্বসূরিরা অবশ্য অনেক বেশি প্রজ্ঞাবান ছিলেন। পলাশীর প্রান্তরে যখন ইংরেজ বণিক বাহিনীর হাতে নবাব সিরাজের পেশাদার সেনাবাহিনীর ভরাডুবি হচ্ছে, তখন আশপাশের গ্রামের মানুষ, এমনকি মাঠের কৃষকরা এতটুকুুও বিচলিত হয়নি। তারা বেশ বুঝেছিল তাদের শাসন করার কর্তৃত্ব মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যাচ্ছে মাত্র। সেদিন তারা যদি লুঙ্গি কাছা মেরে, দা-বঁটি-বল্লম হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কে জানে এই ভূ-খন্ডের ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লিখতে হতো! ’৪৭-এর বিভ্রান্তি কাটিয়ে বাঙালীর নতুন হিসাব কষার ল্যান্ডমার্ক ’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার মতো আরও অনেক ভাষাসৈনিকের নেতৃত্বে আর সালাম-রফিক-শফিক-বরকত-জব্বারের রক্তের বিনিময়ে সেদিন বাঙালীর যে নতুন আন্দোলনের উদ্বোধন, তার সফল পরিসমাপ্তি একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ স্লোগান মুখে বাঙালীর দাবি আর প্রত্যাশা পূরণের ফসল ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’। বাঙালীর এবারের দাবি আর স্লোগান যে ভুল কিছু ছিল না, তা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের ক্ষণস্থায়ী শাসনকে নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্নির্মাণ, ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়া আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন- এমনি আরও অনেক সাফল্যের দাবিদার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সেই প্রথম সরকারটি। পাল রাজাদের হাজার বছর পরে আবারও বাংলাদেশের শাসনভার প্রথমবারের মতো বাঙালীদের হাতে সেদিন এসেছিল আওয়ামী লীগের হাত ধরেই আর দলটিও বাঙালীর একাত্তরের দাবি আর প্রত্যাশা পূরণের পথ ধরেই হাঁটছিল ঠিকঠাক মতোই। ২০১৮-এর শেষ প্রান্তে বাংলাদেশে আবারও একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চারদিকে নির্বাচন-নির্বাচন একটা আমেজ ক্রমেই অবয়ব নিচ্ছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আবারও পথচলা শুরু প্রায় দেড় যুগের বিরতিতে ’৯১-এর জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ২০১৮-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, যারা নেবেন নেবেন করছেন আর এমনকি যারা শেষমেশ নেবেন না তাদের কারোরই প্রস্তুতির শেষ নেই। চলছে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ, নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন আর এমনকি নির্বাচন বানচালের চক্রান্তের জাল বুনাবুনিও। আমি এসব কোন প্রক্রিয়ার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নই। কিন্তু যেহেতু আমি বাঙালী, যেহেতু নির্বাচন আমার রক্তে নাচন ধরায়, আমিও তাই এই নির্বাচনী উৎসবের বাইরে শত চেষ্টায়ও থাকতে পারছি না। লেখার শুরুতে ধান ভাঙতে শিবের যে লম্বা গীত গাইলাম তার কারণ, যে কোন আন্দোলন বা নির্বাচন সে যাই হোক না কেন, তার একটা লক্ষ্য থাকে। আর সেই লক্ষ্য প্রতিভাত হয় সেই আন্দোলনের বা নির্বাচনের সময়কার জনপ্রিয় স্লোগানটিতে। যেমন ’৪৭-এর ‘হাত মে বিড়ি মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ কিংবা ’৭১-এর ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।’ হাত মে বিড়ি ... যেমন বাঙালীর একটি ঐতিহাসিক ভুল, আমার বিবেচনায় তার সমকক্ষ কিংবা সম্ভবত তার চেয়েও অনেক বড় ভুলটি বাঙালী করেছে ’৯১-এ ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দিব’ স্লোগানটিকে আপন করে নিয়ে। আজ যে বাঙালীর জন্ম ’৯০-এর পরে তারও মাথায় এই একটাই স্লোগান, মননে এই এক অদ্ভুত বিশ্বাস। আমি যখন শার্টটি কিনি তখন তো যেটা খুশি সেটা কিনি না, কাঁচাবাজারে গিয়েও তো আমি যেটা খুশি সেই মাছটা না কিনে বাছাবাছি করি, অনেক বাছি এমনকি পটলটাও-লেবুটাও। তা হলে আমার যেটা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যে অধিকার আমাকে সাংবিধানিকভাবে পরিণত করেছে এই রাষ্ট্রের ক্ষমতার সকল উৎসে- সেই ক্ষমতা আমি কেন যার তার জন্য, খেয়াল-খুশি মতো প্রয়োগ করব? যাদের হাতে ত্রিশ লাখ বাঙালীর রক্ত, যারা বছর পাঁচেক আগেও মেতেছিল আগুন সন্ত্রাসের উৎসবে, আমি ইচ্ছে হলেই তাদের আমার ভোটটা দিতে পারি না। আমার ভোট আমি অবশ্যই দেব, এমনকি প্রতিবাদী হব, আমার হয়ে অন্য কেউ সেই পবিত্র অধিকারটি প্রয়োগ করার পাঁয়তারা কষলেও। কিন্তু আমার ভোটটি আমি অবশ্যই আমার খেয়াল খুশি মতো যাকে তাকে দিব না। আমার ভোট যদি পেতে হয় আপনাকে হতে হবে স্বাধীনতার সপক্ষের, হতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের রক্ষক। আপনার স্বপ্নালু চোখে থাকতে হবে ‘মেট্রোরেলে’ চড়ে ‘রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র’ থেকে ‘পদ্মা ব্রিজ’ পেরিয়ে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের’ পাশ দিয়ে ‘বুলেট ট্রেনে’ চড়ে ‘বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্র বন্দরে’ আমাকে নিয়ে যাবার স্বপ্ন! শুধু তা হলেই আপনি আমার ভোটটি পাবেন। তাই আসুন, ২০১৮-তে আমাদের স্লোগান হোক ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব না’, ‘আমার ভোট আমি দেব, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে দেব।’ লেখক : চিকিৎসক
×