ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্যুতিময় দুর্লভ দলিল

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

দ্যুতিময় দুর্লভ দলিল

যে কোন রাষ্ট্রেরই পেশাদার গোয়েন্দাবাহিনী থাকে, গোপন তথ্যের জন্য যাদের ওপর সরকারকে নির্ভর করতে হয়। বিশেষ ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর গোয়েন্দা নজরদারির কাজটি করতে হয় অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও সতর্কতার সঙ্গে অনুপুঙ্খভাবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অন্যতম লক্ষ্যযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন নবীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। চল্লিশের দশকের শেষ দিনগুলো থেকেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের গোয়েন্দারা তাঁকে অনুসরণ করে এসেছে। বলা যেতে পারে গোয়েন্দারা ছিল শেখ মুজিবের ‘ছায়াসঙ্গী’। তাই সেসব গোয়েন্দার প্রতিবেদনেই বিশ্বস্ততার সঙ্গে ধরে রাখা আছে জননায়কের পদচিহ্ন। যথাযথভাবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রস্তুত যে কোন গোয়েন্দা প্রতিবেদনই নিশ্চিতভাবে হয়ে থাকে বস্তুনিষ্ঠ। বিশেষ অভিপ্রায় নিয়ে তৎপরতা চালালে প্রশিক্ষিত গোয়েন্দার কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের স্বরূপ, অভিপ্সা এবং তাঁর সক্রিয়তা। সাংবাদিকের প্রতিবেদনও বস্তুনিষ্ঠ, তাতেও ধরা পড়ে সময়ের চালচিত্র। কিন্তু অভিন্ন সময়ের বয়ানে গোয়েন্দা রিপোর্ট হতে পারে সত্যোচ্চারণের আরেকটি ভিন্নধর্মী সংকেত ও সম্ভার। তা হয়ে থাকে বিশদ, বিস্তৃত ও গভীর অনুসন্ধানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন লিখতে হতো পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের। প্রতিপক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে এই কাজ করা হতো বলে তাতে থাকত গভীর ও ব্যাপক মনোযোগ। জননায়ক কাজ করবেন জনতার জন্য, আর শাসক সেই কাজের গোপন নজরদারি করবে; এই যখন পরিস্থিতি তখন ব্যক্তির জনসম্পৃক্ত সক্রিয়তার একটিও গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনক্রমেই উপেক্ষিত থাকতে পারে না। তা হয়ওনি। ১৪ খন্ডে সেই গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশের প্রক্রিয়া এখন চলমান। গত শুক্রবার মোড়ক উন্মোচন হলো ওই গ্রন্থমালার প্রথম খ-টির। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তানী আমলের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সংকলিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই গ্রন্থমালার মূল পরিকল্পনাকারী ও উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নেপথ্যের কিছু কথা তুলে ধরেন। শত্রুপক্ষের লেখা হলেও সেই রচনাস্তূপের সন্ধান লাভ বাস্তবিকই কয়লার খনির ভেতর থেকে হীরক প্রাপ্তির সমতুল্য। ৪৬টি ফাইলের প্রায় চল্লিশ হাজার পাতা থেকে সত্যের হীরকখ-গুলো সুসম্পাদিত হয়ে গ্রন্থাকারে আলোর মুখ দেখল। যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাসেরই অনন্য দলিল। দ্যুতিময় এই দুর্লভ দলিল বিশ্বের এক অভিনব ও ব্যতিক্রমী প্রকাশনাও বটে। বইটির প্রথম খণ্ড ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে সংকলিত হলেও এ খণ্ডে ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা ও মানবদরদী মনের পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়েছে। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামী জীবনের প্রথম দিকের জানা-অজানা অনেক তথ্যের সন্নিবেশ এ খণ্ডে। তথ্যগুলো তৎকালীন গোয়েন্দা পুলিশ আইবির রুটিন কাজের অংশ হিসেবে সংগ্রহ ও সংরক্ষিত হয়েছিল। এসব রিপোর্টের মধ্যে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ওই সময়ের নাজিম উদ্দিন সরকারের বাঙালী বিরোধী অপশাসনের বিরদ্ধে আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন ও জমিদারি প্রথা বিলুপ্তকরণ ইত্যাদিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সচিবালয়ের গেটের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী চলাকালে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবির সমর্থনে ভিসির বাংলোয় অবস্থানকালীন ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল গ্রেফতার হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপে কোনরূপ আপোস রফায় না গিয়ে তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব বাতিল করে। এমনি সব জানা-অজানা তথ্যে আকীর্ণ এই গ্রন্থমালার পরবর্তী খ-গুলোর জন্য জাতির আগ্রহী ও সহিষ্ণু প্রতীক্ষা থাকবে, সেকথা বলাই বাহুল্য।
×