ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইলসা ক্রেগ প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ইলসা ক্রেগ প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি

ইলসা ক্রেগ স্কটল্যান্ডের অতি ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ। ইলসা ক্রেগে বেড়াতে যাইনি। গিয়েছিলাম মাছ ধরতে। যদিও বুকিংয়ের সময় তেমনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানা হয়নি। তবে বোট ট্রিপে গিয়ে জানতে পারলাম যে, এটা শুধুই বোট ফিশিং নয়, এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অবলোকন করারও ব্যবস্থা আছে। ব্যবস্থা না থাকলেও চোখ তো কেউ আর বেঁধে রাখতে পারবে না। তেমনই একটা ঘটনা ঘটে গেল ২৬ মে ২০১৮ গিরভানে মাছ ধরতে গিয়ে। গ্লাসগো শহরের উপকণ্ঠে যেখানে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি সেখান থেকে গিরভান শহরের দূরত্ব মাত্র ৫০ মাইল। পরিচিত জনের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন এ নিবাস অস্থায়ী হলো কি করে? তাদের বলি, দুনিয়ায় কোন নিবাসই স্থায়ী নয়। যা হোক, প্রত্যেকবার মাছ ধরতে যাওয়ার আগে একটা বাড়তি উত্তেজনা কাজ করে এই ভেবে যে, যদি কোন বড় শিকার জুটে যায় তা হলে কেমন হবে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সাতসকালে মাছ ধরার উপকরণাদিসহ হাল্কা কিছু স্ল্যাক্স ও পানীয় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ। যদিও ড্রাইভ করা আমি উপভোগ করি না, তবে স্কটল্যান্ডে এসে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বে পাহাড়, টিলা, লেক, বন জঙ্গলসহ সবুজের সমারোহ সমৃদ্ধ আঁকাবাঁকা রাস্তায় ড্রাইভ করতে মন্দ লাগে না। গিরভান শহরে এবারই প্রথম পদার্পণ। এর আগে কয়েকবার সাগর উপকূলীয় শহর আয়ারশায়ার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। আয়ার থেকে আরো কুড়ি মাইল ড্রাইভ করতে হবে। বছরের এ সময়টাতে মাঠ, ঘাট, গাছপালা নতুন জীবন ফিরে পায়। চারদিকে সবুজের সমারোহ। তার সঙ্গে দেখা মেলে রাস্তার দু’পাশে গরু ভেড়ার অলস বিচরণ। ভেড়ারা এই কয়েকদিন মাত্র হলো জন্ম দিয়েছে আর এক প্রজন্ম। যদিও এ প্রজন্ম বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। মাত্র তিন চার মাসের মাথায় তাদের পাঠানো হয় কসাই খানায় মানব কল্যাণের রসনা তৃপ্তির বাসনায়। তবে ভেড়ারা যখন দল বেঁধে বাচ্চাদের নিয়ে সবুজ ঘাসের মাঠে বিচরণ করে তখন দেখতে ভালই লাগে। আসলে সব শিশুকেই মায়ের কোলে সুন্দর দেখায়। চলন্ত গাড়িতে চালকের আসনে বসে নিরন্তর এ দৃশ্য দেখার অবকাশ নেই। একবারেই অপ্রশস্ত রাস্তা, তারপর বিপরীত দিক থেকে এত দ্রুত গাড়িগুলো ছুটে আসে যে, একটু এদিক ওদিক হলেই মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে। এ সময়ে হঠাৎ আমার একটা গল্প মনে পড়ে গেল। প্রিয় পাঠকদেও সেই গল্পটা শোনাবার লোভ সামলাতে পারছি না। এক বাংলাদেশি ট্রাক ড্রাইভার মদ্যপ অবস্থায় ট্রাক চালাতে গিয়ে রাস্তার পাশে এক গভীর খাদে পড়ে গেছে, কিন্তু প্রাণে মরে নি। দুর্ঘটনার পর সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে জানতে চাইলেন কেমন করে তিনি খাদে পড়লেন? উত্তরে ড্রাইভার সাহেব বললেন, তিনি খুব দ্রুতবেগেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন সামনের দিক থেকে একটা বাস তার দিকে ছুটে আসছে তাকে তিনি পাশ দিলেন। একটু পরেই একটা কার, তার কিছুক্ষণ পর একটা ট্রাক সকলকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে পাশ দিয়ে নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। সেই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সে দেখে অপেক্ষাকৃত কম গতি সম্পন্ন একটা বড় সেতু তার দিকে ছুটে আসছে, তখন আরো দক্ষতায় সেতুটাকে পাশ দিতে গিয়েই খাদে পড়ে গেছেন তিনি। ভাবছিলাম আমার অবস্থা তেমনটি না হয়। সাত সকালের যাত্রাপথটা মনে রাখার মতো। নিয়ন্ত্রিত গতির সরু রাস্তার দু’পাশে কত কিছুই না উপভোগ করার আছে। প্রকৃতিকে যতটা পারা যায় বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। এক সময় দেখা মিলল সাগরের। সাগর দেখলেই যেন একটা অন্য রকম ভাল লাগার অনুভূতি চলে আসে। যাকে আমরা মেরিন ড্রাইভ বলি, ঠিক তাই। স্কটল্যান্ড এসে প্রথম সাগর উপকূলে চাষাবাসের গন্ধ পেলাম। সর্বত্র বিশাল আকারের খামার, সবুজ ঘাসে ঢেকে আছে। আর আছে গরু, ভেড়া। কিন্তু চাষাবাদের চিহ্ন তেমন একটা চোখে পড়ে না। সাগরের মোহনায় বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আলুর চাষ করা হয়েছে। আর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাঠ জুড়ে চক্রাকার ঝরণার সাহায্যে বৃষ্টির আদলে আলুক্ষেতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য। এই দৃশ্য আর সাগরের বিশাল জলরাশির নয়নাভিরাম মোহনা পেরিয়ে চলে এলাম গিরভান হারবারে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু হবে মাছ ধরার। গিরভান হারবারে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে মনে হলো যেন কোথায়ও হারিয়ে যেতে নেই মানা। তখন সবে সকাল ন’টা বেজে তিরিশ মিনিট। সাগরে জোয়ারের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়ার পালা। নিজের মনটাও যেন কোন এক অজানাকে জানতে পারার আনন্দে ভরে উঠল। সামনেই দেখা যাচ্ছে দিগন্ত প্রসারিত শান্ত সৌম্য নয়নাভিরাম জলরাশি। যে কোন মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কূল। এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে একেবারে তীরে, যেখানে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য লম্বা সারি দিয়ে স্থায়ী বসার আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ডাক এসে গেল বোটে আহরণের। সৌখিন মাছ শিকারিদের প্রায় সকলেই বোটে নিজ নিজ আসন অলঙ্কৃত করে ফেলেছে। আমিও গিয়ে আমার আসনে বসে পড়লাম। হারবারে নোঙর করা আছে অগণিত বোট। কিন্তু তারা যে সমুদ্র যাত্রায় আপাতত শামিল হচ্ছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ঠিক দশটায় বোট নোঙর তুলল। ক্যাপ্টেন ও তার সহকারীসহ আমরা এগারোজন। মাত্র একজন মহিলা তার পার্টনারকে নিয়ে চলছে মাছ ধরতে। প্রথমে অনুমান করতে পারিনি, ঠিক সমুদ্রের কতটা ভেতরে মাছ ধরার উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা হবে। যদিও এই স্থানটা নির্ভর করে মাছদের বিচরণ ক্ষেত্রের ওপর। সাধারণত সেটা খুব গভীর সমুদ্রে হয় না। ইংল্যান্ডের ডোভার, সাউথ এ্যান্ড, কোলেস্টেরের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা বলা। তবে এ সব বোটে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার একটা বাড়তি সুবিধা হলো এক ধরনের রাডার যা কিনা মাছের অবস্থানকে নিশ্চিত করে, জলের গভীরতা ও কত গভীরে তাদের বিচরণ সেটাও মনিটরে দেখা যায়। প্রায় তিরিশ মিনিট সর্বোচ্চ গতিতে বোট চলার পর বুঝতে পারলাম যে আমরা গভীর সমুদ্র অভিমুখে যাত্রা করছি। সকলেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আর ঢেউয়ের সঙ্গে বোটের সংঘর্ষে জলের ঝাপ্টা থেকে নিজেকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার কাজে ব্যস্ত। ঢেউয়ের তালে নাচতে গিয়ে মাঝে মাঝে বেতালে পড়ে মনে হচ্ছে এই বুঝি বোটটা উল্টে গেল। আট ফুট, দশ ফুট উঁচু ঢেউয়ের মাথা থেকে এমনভাবে বোটটা লাফিয়ে পড়ছে যে আসনে বসে থাকাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনের দিকে তাকানোর সময়ই পাইনি। হঠাৎ চোখে পড়ল বহুদূরে এক খ- বিশাল আকৃতির পাথরের গম্বুজ সাগরের বক্ষ ভেদ করে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তখনও সে পাথর খ-ের দূরত্ব নেহায়েত কম নয়। এই ভাবেই ঢেউয়ের সঙ্গে মোকাবেলা করে এগিয়ে চলা, আর নীল সমুদ্রের অথৈ জলে গাঙচিলদের উড়ন্ত ও ভাসমান নৃত্য দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম। অনতিদূরে যে দৃশ্য দেখা গেল, তা দেখতে গিয়ে মাছ ধরার কথা ভুলে গিয়ে মনে হলো যেন, নৌবিহারে এসেছি সাগরের বক্ষ থেকে ছোট্ট দ্বীপ ইলসা গ্রেগের প্রকৃতির অকৃপণ দানে গড়ে তোলা যে নিরেট পাথরের মাঝে রহস্যাবৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তাকে প্রাণ ভরে দেখতেই যেন এ আয়োজন। শিকারিরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে যার মত করে দৃশ্যটাকে মোবাইল বন্দী করতে। আমিও বা বাদ যাই কেন? সত্যি পাথরের এমন অপরূপ সৌন্দর্য কমই চোখে পড়ে। ছোট্ট এই জীবনে পাথরের পাহাড় তো কম দেখা হল না। কিন্তু এ পাহাড় যেন সকলকে হার মানিয়ে অনন্য উচ্চতায় শির উঁচু করে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তার শিখরে উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার পাখি। এটা যে পাখিদেরও অভয়ারণ্য তারও সন্ধান মিলল এখানে এসে। একটু পরেই দেখা মিলল জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে একদল ছোট-বড় ওঠার অর্থাৎ আমরা যাদের ভোদড় বলি। আর ঝাঁকে ঝাঁকে শত শত পাখিকে সাগরবক্ষে বিচরণ ও উড্ডয়ন এক অন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। এক যাত্রায় কত কিছুর যে প্রাপ্তি ঘটল, তাই আমারও গুন গুন করে গাইতে মন চাইল - ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’- দিনশেষে সে ধন যেন হারিয়ে না ফেলি। তাই এ প্রচেষ্টা। গ্রানাইড পাথরের খাড়া উঁচু এ পাহাড় যে শৈল্পিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটা দেখলে যে কোন মানুষের ভাল লাগার কথা। যারা এ্যাডভেঞ্চার করতে চান, তাদের জন্য সত্যি দিনভর দ্বীপটিতে ঘুরে বেড়ানোর উপযুক্ত একটা স্থান, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাহাড়ে চড়া, চারদিকের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি, বন্যদের সঙ্গে সময় কাটানো কোনটাই বৃথা যাওয়ার কথা নয়। অনেক সংস্থা এ ধরনের ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১১৪ ফুট উচ্চতা আর মাত্র ১.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ০.৮ কিলোমিটার প্রস্থসম্পন্ন এই দ্বীপটি ফিরথ্ অব ক্লাইড এবং আয়ারশায়ারের উপকণ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরত্বে গ্লাসগো আর বেলফাস্টের মাঝামাঝি সাগরের মাঝে, সেই কবে থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার খবর কেইবা রাখে। তবে এখন অনেকেই অপরূপ সুন্দর এ দ্বীপের খবর রাখেন। কেউ বা পর্র্যটন বাণিজ্যের কারণে আর কেউ বা সেখানে বেড়াতে যাওয়ার অভিলাষে। আর আমি গিয়ে হাজির হলাম কোন কিছু না জেনে, না বুঝে মাছ ধরার অভিপ্রায়ে। তবে পাওনাটা বাড়তি হয়ে গেল। ভাল লাগল হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ও তাদের জীবনের ব্যস্ততায় ভরে থাকা দ্বীপটিকে। জনমানববিহীন নির্জন ছোট্ট এ ভূখ-ে যেমন আছে সত্তর হাজারেও অধিক গানেট (মধহহবঃ) ও অন্যান্য সী-বার্ড, তেমনি খরগোশ আর সমুদ্রের জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে দল বেঁধে ওটার বা ভোঁদড়। তবে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো পাথরের মনোমুগ্ধকর ফরমেশন। পরিশেষে বলি, যে গল্প শুরু করেছিলাম মাছ ধরা নিয়ে, শেষটাও মাছ নিয়েই করি। প্রথম দিন অবশ্য একটা মাছ ধরেই খুশি থাকতে হয়েছিল। কারণ হয়ত সেদিন অরুচি ছিল প্লাস্টিকের আধার গিলতে, কিংবা বুঝে গিয়েছিল যে ওটা আসলে খাবার নয়, ধোঁকা দেয়া হচ্ছে তাদের। তবে পরের বার আমাকে আর মাছেরা বোকা বানাতে পারেনি। সেদিন ২৬টা মাছ ধরে খুব খুশি মনে বাড়ি ফিরেছিলাম।
×