ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : কোরি রবিন;###;রূপান্তর : এনামুল হক

আমেরিকার নব্য সোশ্যালিস্টরা

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আমেরিকার নব্য সোশ্যালিস্টরা

আমেরিকার ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে সমাজতন্ত্রের ধারণাটি এক আশাহীন, অর্থহীন এবং প্রায়শই এক অস্পষ্টরূপে বর্ণিত স্বপ্ন হিসেবে থেকে গেছে। বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি এর সম্ভাবনা এতই সুদূরপরাহত ছিল যে সমাজতান্ত্রিক সাময়িকী ‘ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত)-এর দুই সম্পাদক ইরভিং হাউ ও লুই কোজের ১৯৫৪ সালে সমাজতন্ত্রের সর্বোত্তম এই সংজ্ঞাটুকুই উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন যে ‘সমাজতন্ত্র হচ্ছে আমাদের আকাক্সক্ষার নাম।’ সেই অবস্থাটা হয়ত বদলে যাচ্ছে। সমাজতন্ত্রের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে। বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ ও রাশিদা টিলাইবের মতো সুচিহ্নিত সমাজতন্ত্রীরা ডেমোক্র্যাটিকু পার্টির ভেতরে প্রবেশ করে ভাল অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। অথচ এই দলটিকেই একদা কেভিন ফিলিপস্্ নামে এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক উৎসাহী পুঁজিবাদী দল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমেরিকার সবচেয়ে বড় সমাজতান্ত্রিক সংগঠন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সদস্য সংখ্যা বিশেষ করে তখন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। এই আকস্মিক উত্থানের কারণ কি? আর ২০১৮ সালে আমরা যখন ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে কথা বলে থাকি তখন এই শব্দটির দ্বারা কি বুঝাই? এ কাহিনীর কতকাংশ নিতান্তই আপতিক বা ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া। ২০১৬ সালে মি. স্যান্ডার্স প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থিতা লাভের জন্য ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন লাভে জোর চেষ্টা করেছিলেন। ‘সমাজতন্ত্রের’ তকমাটা তাঁর প্রার্থিতা লাভের চেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা তো দূরের কথা বরং সাহায্যই করেছিল। মি. স্যান্ডার্স উদারপন্থী ছিলেন না, প্রগতিশীল ছিলেন না কিংবা ডেমোক্র্যাটও ছিলেন না। যত রকম শব্দ আছে সবগুলোর বিচারে তিনি ছিলেন নির্ভেজাল একজন সমাজতন্ত্রী এবং তার রাজনীতির ধারাও ছিল তদ্রƒপ। ভাগ্যের পরিহাস হলো, যে সমাজতন্ত্র এতদিন নির্বাসিত ছিল সেই সমাজতন্ত্রই এখন মার্কিন রাজনীতির অভিন্ন বিষবৎ বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলেছে। কাহিনীর আরেকটি অংশ ততটা আপতিক নয়। ১৯৭০ এর দশক থেকে মার্কিন উদারপন্থীরা অর্থনৈতিক প্রশ্নে ডানদিকে মোড় নিয়েছে। তাঁরা আগে শ্রমিকদের স্বার্থ, ইউনিয়নের স্বার্থের কথা বলত। ধনীদের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ, সম্পদের পুনর্বন্টন ও জনসার্ভিসের কথা বলত। এখন তারা বিল গেটস ও মার্ক জাকারবার্গের মতো বিলিয়নিয়ারদের তোষণ করে, যেখানেই সম্ভব সরকারের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়। নির্বাচনের সময়টা ছাড়া ইউনিয়নগুলোর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে এবং বেশিরভাগ মানুষের কর কতটা কমানো যায় সে ব্যাপারে অন্ততপক্ষে এই সেদিন পর্যন্ত বিরোধিতা করেছে। উদারপন্থীরা অবশ্য যুক্তি দেখায় যে তাঁরা সুষম প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য পরিচর্যার সম্প্রসারণ ও সামাজকি ন্যায় বিচারের মতো লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কর হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রত্যাহারের মতো বাজারবান্ধব উপায়গুলোকে কাজে লাগাছে মাত্র। এই একই লক্ষ্যগুলো তারা বরাবরই অনুসরণ করেছে। দশকের পর দশক ধরে বাম ঘেঁষা ভোটাররা সেই জবাবকে সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছে যদিও তারা এর ফলাফলকে পছন্দ করেনি। কারণ তাদের সামনে বিকল্প কোন পথ ছিল না। স্যান্ডার্সকে এই মানুষদের মনে এই প্রত্যয় জন্মাতে হয়েছে যে, পণ্যমূল্যের যেখানে উর্ধগতি ঘটে চলছে এবং ঋণের অংশ যেখানে কখনই শেষ হচ্ছে না সেখানে এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকা মজুরি দিয়ে সেই পণ্যমূল্য ও ঋণ পরিশোধ করতে যথেষ্ট বেগ পেয়ে চলা নারী ও পুরুষদের উদারপন্থীদের পক্ষ থেকে দেয়ার মতো সর্বোত্তম জিনিস যদি ট্যাক্স ক্রেডিট আর ইনসিওরেন্স এক্সচেঞ্জই হয়ে থাকে তাহলে সমাজতন্ত্রের ব্যাপারটি চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। পুঁজিবাদ মানুষকে শৃঙ্খলিত করে সমাজতন্ত্রের অর্থ এক এক মানুষের কাছে এক এক রকম। কারও কারও কাছে সমাজতন্ত্র বলতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সাইবেরীয় বন্দী শিবিরের কথা মনে পড়ে যায়। অন্যদের মনে পড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও সেখানকার সুরক্ষিত আয়ের কথা। কিন্তু এর কোনটাই সমাজতন্ত্রের প্রকৃত চিত্র নয়। সোশ্যালিস্টরা যা চায় তা হলো স্বাধীনতা। পুঁজিবাদের অধীনে আমরা স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য বাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হই। লিবার্টারিয়ানরা বা উদারবাদীরা বাজারকে স্বাধীনতার সমর্থক হিসেবে দেখে। তবে সোশ্যালিস্টরা বাজারের কথা শুনে তাদের উদ্বিগ্ন মায়ের কথা মনে করে যিনি বীমা প্রতিনিধিকে কোনভাবেই টেলিফোনে চটিয়ে দিতে চান না, পাছে সেই প্রতিনিধি এমন ঘোষণা দিয়ে বসেন, সে বীমার জন্য তিনি অর্থ দেন তাতে তার শিশু সন্তানের এ্যাপেনডিক্স অপারেশনের খরচ বহনের ব্যবস্থা নেই। পুঁজিবাদের অধীনে আমরা আমাদের উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য। তাঁর বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে আমরা তার কাছে মাথা নোয়াই, তাঁর সুরে সুর মিলাই, তাঁর স্তাবকতা করি, তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করি কিংবা আরও খারাপ ভাষায় বললে ওসব করি এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে আমাদের যেন চাকরিচ্যুত না করা হয়। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের যুক্তিটা এই নয় যেÑ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আমাদের দরিদ্র করে তোলে। বরং তাদের বক্তব্য হচ্ছে পুঁজিবাদ আমাদের স্বাধীনতা বঞ্চিত করে। আমার ভাল-মন্দ যখন আপনার খেয়াল খুশির ওপর নির্ভর করে, জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো যখন আমাদের বাজারের কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য করে, কর্মস্থলে অধীনতা পাশে আবদ্ধ করে তখন আমরা স্বাধীনতায় নয় বরং পরাধীনতায় আবদ্ধ করে। সোশ্যালিস্টরা এই পরাধীনতার অবসান চান। বড় কর্তার শাসন থেকে, পণ্য বিক্রির স্বার্থে স্মিত হাসি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে, বেঁচে থাকার স্বার্থে বিক্রির দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আজকের সোশ্যালিস্টরা কি বলে শুনুন। ক্ষমতার ভাষার তুলনায় দাবিদার কথার ব্যবহার কম শুনবেন। মি স্যান্ডার্স বিত্তহীন ১ শতাংশ মানুষকে আরোহণ করেছেন। মিজ ওকাসিও কর্টেজ কর্মজীবী মানুষ’ বা কর্মজীবী পরিবারগুলোর জন্য নয় বরং শ্রমিক শ্রেণীর উদ্দেশ্যে ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে কথা বলছেন। এই ঘরোয়া শব্দগুলোর ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিষয়টিকে নমনীয় ও স্বস্তিদায়ক করা। বিত্তহীন ১ শতাংশ মানুষ ও শ্রমিক শ্রেণী দিয়ে অর্থনীতির কিছু বর্ণনা করা যায় না। তবে তারা রাজনৈতিক অভিযোগের মূর্তরূপ। তবে এই শব্দগুলো সমাজকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলে। একটি পক্ষকে অন্যের ওপর অবৈধ শাসনকারী বলে ঘোষণা করে। আরেক পক্ষকে বলে তারা অন্যের স্বাধীনতা ক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতি হরণকারী। শ্রেণীই আসল পরিচয় নিউইয়র্ক রাজ্য সিনেটে নর্থ ব্রুকলিনর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দাঁড়ানো সোশ্যালিস্ট প্রার্থী জুলিয়া সালাজারের একজন ক্যানভাসারের সঙ্গে বুশউইকের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। যা শুনতে পাবেন তা হলো মিজ সালাজার রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের কাছ কোন টাকা পয়সা নেন না যেমনটা করে থাকেন তার প্রতিপক্ষ। ব্যাপারটা এমন নয় যে তিনি ধনী দাতাদের থেকে স্বাধীন এই ঘোষণাটি দিতে চান। বরং আসল ব্যাপারটা হলো অর্থ সঙ্কটগ্রস্ত ভাড়াটিয়া অধ্যুষিত তার এই জেলায় বাড়িওয়ালারাই শত্রু। ২০০৮ সালে ওবামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ডেমোক্র্যাটিক দলের তহবিল সংগ্রাহক সৌমিক দত্ত যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তার সঙ্গে এর তুলনা করে দেখুন। তিনি বলেছিলেন, ক্লিনটন নেটওয়ার্ক এস্টাবলিশমেন্টের সকল ডোনারকে নিয়ে নিচ্ছে। এই প্রচারাভিযানে এমন একজনকে প্রয়োজন যিনি স্বল্প প্রতিষ্ঠিত ডোনারদের, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার গোষ্ঠীকে বুঝতে পারেন। তাদের উত্তরটা যদি হয়ে থাকে হ্যাঁ আমরা বুঝতে পারি তাহলে সোশ্যালিস্টদের জবাব হচ্ছে না, আমরা পারব না। মিজ ওকাসিও কর্টেজ ও মিজ সালাজার শ্রেণীর ভাষায় এত স্বাচ্ছন্দ্য ও অবলীলায় কথা বলে থাকেন যে, এটাই তাদের পরিচিতির মুখ্য বিষয়। আলগোর, জন কেরি ও হিলারী ক্লিনটনকে বছরের পর বছর ধরে তাদের উপস্থাপিত বহুবিধ সত্তাগুলোকে একত্রে জোড়াতালি মেরে একটা বিশ্বাসযোগ্য সত্তায় পরিণত করে রাজনৈতিক মুহূর্তটির উপযোগী ব্যক্তিগত কাহিনী খুঁজে বের করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। আজকের তরুণ বামপন্থী প্রার্র্থীরা ব্যক্তিগত সংগ্রামের এমন কাহিনী বলে যা তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃশ্যকল্পের সঙ্গে একত্রে মিশে যায়। ওবামা সেই কাজটাই করেছিলেন। কিন্তু সেখানে তার কাহিনী জাতীয় সত্তার একটা মিথ্ জোরদার করে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। সেখানে সোশ্যালিস্টদের কাহিনী হলো পুঁজিবাদের কাহিনী এবং তাতে পুঁজিপতি ও তাদের দোসরদের বাদ দেয়া হয়েছে। সে কাহিনীতে বলা হচ্ছে কিভাবে কম মজুরি ও চড়া বাড়ি ভাড়া দিয়েও ঋণের উঁকি মারা ছায়া সঙ্গে নিয়ে জীবনযুদ্ধে সংগ্রামরত তাদেরও এই প্রজন্মের মানুষদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই প্রার্থীদের কাহিনীগুলো আরেক কারণেও সমাজতান্ত্রিক। তারা জাতিরাষ্ট্র থেকে ছিন্ন হয়ে আসে। মিজ ওকাসিও কর্টেজ কিংবা কংগ্রেসে মিশিগানের ১৩তম জেলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ে দাঁড়ানো মিজ তুলাইব যে ভৌগোলিক প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন সেগুলো জাতীয় নয় স্থানীয় এবং তা আমেরিকায় স্বপ্নের প্রতিশ্রুতির কথা নয় বরং মার্কিন ও ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের স্মৃতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। মিজ তুলাইব ডেট্রয়েট আফ্রিকান আমেরিকানদের নাগরিক অধিকারের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তার নিজের ফিলিস্তিনী ঐতিহ্য এবং ফিলিস্তিনের সংগ্রামের কথা বলেন। অন্যদিকে মিজ ওকাসিও কর্টেজ বলেন, তার মা যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পুয়ের্টো রিকো এবং তিনি যেখানে বাস করেন সেই ব্রোনস্কের কাছে তিনি ঋণী। ওবামার কাহিনীর মধ্যেও তাঁর হাওয়াই, ইন্দোনেশীয় ও কেনীয় অন্যতম ছিল। কিন্তু তার বক্তব্য শেষ হয়েছিল এই বলে যে তিনি যেন এক কসমোপলিটান ভবঘুরে যিনি আমেরিকায় নিজ ভূমে ফিরে এসে এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে মিজ তুলাইব ও মিজ ওকাসিও কর্টেজ এ জাতীয় সমাধানে আগ্রহী নন। এই না করতে চাওয়াই তাদের সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্যর অংশ। যুক্তি সহকারে বলা যায় যে, আজকের সোশ্যালিস্টরা সবচেয়ে বড় যে সীমানাটি অতিক্রম করতে চান তা হলো দ্বিদলীয় ব্যবস্থা। তাদের নিজেদের প্রচারাভিযানেও এই বার্তাটি পরিষ্কার। সেটা হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প বা রিপাবলিকানদের সমালোচনা করাই যথেষ্ট নয়। আমেরিকান জীবনে যে পচন ধরেছে তাতে ডেমোক্র্যাটদের যোগসাজশ আছে। আর এখানেই আমাদের এই সময়কার সমাজতন্ত্র আমেরিকার অতীতের গভীরতম স্রোতের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। মার্কিন সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরের অধ্যায়ের মহান প্রেসিডেন্টদের মতো আজকের সোশ্যালিস্ট প্রার্থীরা পার্টির গ-িকে অতিক্রম করে সমাজের একটি দুষ্টক্ষত রূপকে টার্গেট করছে। আব্রাহাম লিঙ্কনের ক্ষেত্রে সমাজের সেই দুষ্টক্ষতটি ছিল দাস প্রথা; ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বেলায় সেই দুষ্টক্ষতটি ছিল অর্থনৈতিক রাজতন্ত্রবাদীরা। পরিবর্তনের এসব মহান ধারক-বাহকরা বুঝতে পেরেছিলেন সে সমাজের যে কোন ধরনের রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন শুধু বিরোধী দলের সঙ্গে সংঘাত নয় উপরন্তু উভয় দলের অন্তর্নিহিত ভিত্তি যে রাজনৈতিক অর্থনীতি সেটির সঙ্গেও সংঘাত দরকার। সে জন্যই পরিবর্তনের এসব ধারক-বাহকরা প্রায়শই এমন সব ভাষা বেছে নিতেন যা দুটি দলের কোনটাই বলে না। ১৮৫০ এর দশকে হুয়েগ পার্টি ও ডেমোক্র্যাটদের মোকাবেলা করার সময় লিঙ্কনের বেছে নেয়া সেই ভাষাটি ছিল মুক্ত শ্রমিক। ২০১০ এর দশকে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মোকাবেলা করতে গিয়ে বামপন্থীদের বেছে নেয়া সেই ভাষাটি হচ্ছে সমাজতন্ত্র। মূলধারার সমালোচক এবং আরও অধিকমাত্রায় যারা বামপন্থী তাদের কাছে এই ভাষা বা শব্দটি পিচ্ছিল বা ফাঁকিবাজি মনে হতে পারে। এসব সোশ্যালিস্ট প্রার্র্থী সবার জন্য চিকিৎসাসেবা বা মজুরি বৃদ্ধির কথা যেভাবে বলে তাতে তাদের নিউ ডিলের সমর্থন বা গ্রেট সোসাইটি লিবারেলদের মতোই মনে হয়। তথাপি উৎপাদনের উপায়গুলোর ওপর শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ বা সামষ্টিক মালিকানার মতো চিরায়ত সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা নিয়ে খুব বেশি কিছু আলোচনা হয় না। আর অবশ্যই বলতে হয় যে উদারপন্থী ও সোশ্যালিস্টদের বক্তব্যের মধ্যে ওভারল্যাপিং অধিক্রমণ আছে। তবে উদারপন্থীরা একক বীমার অর্থ দাতার স্বাস্থ্যসেবা, বিনামূল্যে কলেজ শিক্ষা, আরও বেশি ইউনিয়নের অধিকার ও অধিক মজুরির দাবিকে সমর্থন করলেও এই দুই শিবিরের মধ্যে বিভাজন থাকবেই। উদারপন্থীদের কাছে এসব নীতির লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক দুর্দশা লাঘব। সোশ্যালিস্টদের কাছে এগুলো হলো মুক্তির অর্থাৎ বাজারের স্বৈরাচার ও কর্মস্থলের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে নারী ও পুরুষদের মুক্তির ব্যবস্থা। সেই ১৯৩০ এর দশকে বলা হতো যে উদারতাবাদ হলো স্বাধীনতা যোগ মুদিখানার পণ্য। পক্ষান্তরে সোশ্যালিস্টরা বিশ্বাস করে যে পণ্যসামগ্রী বিনামূল্যে প্রাপ্তিযোগ্য করলে মানুষকে মুক্ত করা হয়। লেখক : আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×