ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কঠিন সময়ে স্পেশাল ওয়ান’

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

‘কঠিন সময়ে স্পেশাল ওয়ান’

ক্যারিয়ারের অন্যতম কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন জোশে মরিনহো। তারকা এই কোচ ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে কিছুতেই সফল হতে পারছেন না। গেল মৌসুমে ব্যর্থতা এবার সদ্য শুরু হওয়া নতুন মৌসুমেও রেড ডেভিলসদের অচেনা লাগছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে প্রথম তিন ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে ম্যানইউ। প্রথম ম্যাচ জিতে শুভসূচনা করলেও পরের দুটি ম্যাচেই হেরেছে আসরের রেকর্ড সর্বাধিক ২০ বারের চ্যাম্পিয়নরা। স্বাভাবিকভাবেই নিদারুণ চাপে ছিলেন কোচ মরিনহো। এখন আশপাশ থেকে শোনা যাচ্ছে যে কোন মুহূর্তে ছাঁটাই হয়ে যেতে পারেন পর্তুগীজ লৌহমানব। এমন অবস্থার মধ্যেও অবশ্য নিজের ঢাক নিজেই পিটিয়ে চলেছেন স্পেশাল ওয়ান। এমন সময়ে ইপিএলে বার্নলির বিরুদ্ধে ২-০ গোলে জিতে কিছুটা হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন তিনি। গত ২৬ বছরে প্রিমিয়ার লীগে সবচেয়ে বাজে শুরু করেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। টটেনহ্যামের কাছে হারের পর দর্শকদের দিক থেকে কটূক্তির শিকার হয়েছেন মরিনহো। তবে পাত্তা দিচ্ছেণ না তিনি; আস্থা রাখছেন নিজের ওপর, ‘আমি পাল্টাই না। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই জানেন আমি একজন অসাধারণ মানুষ। আশা করছি সবকিছু ঠিকঠাক হবে।’ মরিনহোর অর্জনের অবশ্য কমতি নেই। কিন্তু ম্যানইউর হয়ে সেটা করতে পারছেন না। ইংল্যান্ড, ইতালি আর স্পেনে লীগ জেতানোর সঙ্গে তার ঝুলিতে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতানোর গৌরবও। কিন্তু রেড ডেভিলদের হয়ে সফল হতে না পেরে আবারও আগের মতো নিজের সাফাই গাইতে শুরু করেছেন। এখন সবখানে মরিনহোকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইউনাইটেড কোচ যেন নিজেই তা উসকে দিয়েছেন। প্রিমিয়ার লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্লাবটির কোচের দায়িত্বটা তার কাছে কেমন সাংবাদিকরা ছুড়ে দেন এমন প্রশ্ন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই জবাব দেন মরিনহো। বলেন, আমি বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবের কোচ, কিন্তু এর পাশাপাশি আমি বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচও। ইউনাইটেডকে লীগ জেতাতে না পারলে এই শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, অবশ্যই। আপনারা কেউ দার্শনিক হেগেলকে পড়েননি? তিনি বলেছেন, সবকিছু মিলিয়েই সত্যটা দাঁড়ায়। তাই সবকিছু মিলিয়েই সত্যের দেখা পাবেন। এখানেই থেমে থাকেননি তারকা এই কোচ। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ঢাক পেটাতে গিয়ে তিনি খোঁচা মেরেছেন জার্গেন ক্লপ ও মাউরিচিও পচেত্তিনোকে। এ প্রসঙ্গে মরিনহো বলেন, প্রিমিয়ার লীগে তৃতীয়, চতুর্থ কিংবা পঞ্চম হওয়া কোচকে কী আপনার এই প্রশ্ন করেছেন? লীগে গত মৌসুমে টটেনহ্যামকে তিনে ও লিভারপুলকে চারে তুলেছিলেন যথাক্রমে দুটি দলের কোচ পচেত্তিনো ও ক্লপ। মরিনহো এই প্রশ্নের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন, তিনি সেরা বলেই এই প্রশ্নটা তাকে করা হয়েছে। চরম বাজে শুরুর পরও কোচ হিসেবে মরিনহোকেই সমর্থন করছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, কর্মকর্তাদের বিশ্বাস মরিনহোই পারবেন দলকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে। গত জানুয়ারিতে ম্যানইউর সঙ্গে নতুন চুক্তি করেন মরিনহো। ৫৫ বছর বয়সী এই কোচের ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকার কথা। ম্যানইউতে গত দুই বছরে মরিনহো ইউরোপা লীগ এবং লীগ কাপ (২০১৬-১৭) জিতেছেন। প্রিমিয়ার লীগে ছিলেন দ্বিতীয়। এছাড়া এফএ কাপ ফাইনালে (২০১৭-১৮) হেরেছেন। এ বছর বাজে শুরুর পর অনেকেই তাকে বরখাস্তের দাবি তোলেন। তবে আপাতত বার্নলি ম্যাচ জিতে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন তিনি। ম্যাচ জেতার পর হঠাৎ করেই নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে নিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে ম্যানইউতেই নাকি ফিরতে চেয়েছিলেন সি আর সেভেন। কিন্তু মরিনহোর বাধার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। একদিন আগেই এ নিয়ে সরগরম হয়েছিল ইংলিশ মিডিয়া। তবে একদিন যেতে না যেতেই এই অভিযোগের জবাব দিলেন ম্যানইউর পর্তুগীজ কোচ। ইংলিশ মিডিয়ার দাবিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। মরিনহোর জোরালো দাবি, ‘রোনাল্ডোর ম্যানইউতে আসা ছিল অসম্ভব। কারণ, ম্যানইউই চায়নি তাকে নিয়ে আসতে।’ উল্টো হোসে মরিনহো দাবি করেন, তিনি নিজেই চেয়েছিলেন রোনাল্ডোকে ওল্ডট্রাফোর্ডে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু বিষয়টা পুরোপুরি অসম্ভব ছিল। কারণ ম্যানইউ রোনাল্ডোকে ফিরিযে আনার কথা ভাবেইনি। সাবেক রিয়াল কোচ আরও বলেণ, রোনাল্ডোর বিষয়টা ম্যানইউর ট্রান্সফার টেবিলেই উঠেনি যে এ ব্যাপারে হ্যাঁ কিংবা না বলব। সুতরাং, তার তো ম্যানইউতে আসার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদে রোনাল্ডোর কোচ ছিলেন মরিনহো। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লীগে গ্রুপ পর্বেই মুখোমুখি রোনাল্ডোর নতুন ক্লাব জুভেন্টাস এবং পুরনো ক্লাব ম্যানইউ। ২৩ অক্টোবর ওল্ডট্রাফোর্ডে এবং ৭ নবেম্বর জুভেন্টাসের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচ দুটি। এর আগে আরেক ইংলিশ ক্লাব চেলসিতে প্রথম মেয়াদে ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দারুণ সাফল্য পেয়েছিলেন মরিনহো। লন্ডনের ক্লাবটিকে জিতিয়েছিলেন দুটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ ও একটি এফএ কাপের শিরোপা। ২০১৩ সালে দ্বিতীয় দফা দায়িত্ব নিয়েও চেলসিকে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। তাঁর অধীনে সেই সময় পঞ্চমবারের মতো প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা জিতেছিল ব্লুজরা। কিন্তু পরের মৌসুমে ভীষণ দুরবস্থা হয় মরিনহোর দলের। মরিনহো প্রথমবার দায়িত্ব নেয়ার আগে দীর্ঘদিন লীগ শিরোপা বঞ্চিত ছিল চেলসি। ২০০৪-০৫ মৌসুমে ৫০ বছর পর চেলসি সমর্থকদের শিরোপা জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছিলেন স্বঘোষিত ‘স্পেশাল ওয়ান’। পরের মৌসুমেও প্রিমিয়ার লীগের শিরোপা গিয়েছিল স্টামফোর্ড ব্রিজে। ২০০৬-০৭ মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে না পারলেও চেলসিকে লীগ কাপ ও এফএ কাপের শিরোপা জিতিয়েছিলেন। ২০১৪ সালেও চেলসি ভেসেছিল প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জয়ের আনন্দে। ২০১৩ সালে প্রত্যাশিতভাবেই দ্বিতীয় মেয়াদে চেলসির কোচ হন মরিনহো। ওই সময় ইংলিশ ক্লাবটির সঙ্গে চার বছরের জন্য চুক্তি হন পর্তুগীজ লৌহমানব। ইংলিশভূমি সবসময় প্রিয় স্পেশাল ওয়ানের। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত স্টামফোর্ড ব্রিজে কাটান। সেই সুখস্মৃতি নিয়েই রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে চেলসিতে ফিরে এসেছিলেন মরিনহো। তারকা এই কোচ যেখানেই গিয়েছেন সাফল্য ধরা দিয়েছে। এ কারণেই তকমা পেয়েছেন ‘স্পেশাল ওয়ান’। এফসি পোর্তো, চেলসি, ইন্টার মিলানে দুর্দান্ত সফলতা পেলেও ব্যতিক্রম রিয়াল মািদ্রদে। তিন বছরে এই ক্লাবে মরিনহোর সাফল্য মাত্র তিনটি শিরোপা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ লা লীগা ও কোপা ডেল রে। বাার্নবুতে বিদায়ী মৌসুমে বড় ধরনের হতাশাই সঙ্গী হয় তার। লা লীগা ধরে রাখতে পারেননি। একমাত্র অবলম্বন মৌসুমের শুরুতে কম গুরুত্বপূর্ণ স্প্যানিশ সুপার কাপ। চ্যাম্পিযন্স লীগে আশা জাগালেও সেমিফাইনালে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের সঙ্গে হার মরিনহোর বিদায়টা ত্বরান্বিত করে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়। বার্নাব্যুকে সমঝোতার মাধ্যমে বিদায় জানান মরিনহো। মরিনহো মানেই শিরোপা। পরিসংখ্যানও তাই বলে। কোচ হিসাবে স্বদেশী ক্লাব এফসি পোর্তোর হয়ে দুই মৌসুমে মরিনহো শিরোপা জিতেছিলেন ছোট বড় ছয়টি। চেলসির হয়ে তিন মৌসুমে ছয়টি। ইন্টার মিলানের হয়ে দুই মৌসুমে পাঁচটি। এর মধ্যে পোর্তো ও ইন্টার মিলানের হয়ে জিতেছিলেন চ্যাম্পিযন্স লীগের শিরোপা। চেলসির হয়ে টানা দুটি লীগ শিরোপা। কিন্তু রিয়ালের মতো ম্যানইউর হয়েও তিনি সফল হতে পারছেন না। অতিবাহিত করছেন কঠিন সময়।
×