ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় মাধ্যম

বাগেরহাটের নারকেলের ছোবড়ার তৈরি পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 বাগেরহাটের নারকেলের ছোবড়ার তৈরি  পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে

বাবুল সরদার, বাগেরহাট ॥ বাগেরহাটের নারকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এখানে একের পর এক গড়ে উঠছে ন্যাচারাল ফাইবার থেকে রফতানি পণ্য তৈরির কারখানা। বৈদেশিক রফতানি পণ্যের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত নারকেলের ছোবড়া মেশিনের সাহায্যে গুঁড়া ও আঁশ পৃথক করে সেই আঁশ দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হচ্ছে তোশকের (ম্যাট্রেস) ভেতরের অংশ, যা ‘কয়ার ফেল্ট’ নামে পরিচিত। নারকেলের ছোবড়ার পাশাপাশি ছোবড়ার গুঁড়াকে প্রক্রিয়াজাত করে রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। শুরুতেই রফতানি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। বাগেরহাটের বিসিক শিল্পনগরীতে এবং রাখালগাছি ইউনিয়নের করুরীতে এই কারখানা গড়ে উঠেছে। যেখানে বহু শ্রমিক এখন মহাব্যস্ত। উৎপাদন কারখানায় গিয়ে কথা হয় পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) জোবায়ের হোসেন ও এক্সিকিউটিভ অফিসার (উৎপাদন) নাজমুল কবিরের সঙ্গে। তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সাল থেকে ‘কয়ার ফেল্ট’ (ম্যাট্রেস তৈরির কাঁচামাল) তৈরি করে আসছে। এই কাঁচামাল সোয়ান, আখতার, অটোবিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ম্যাট্রেস উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে । আর নারকেলের আঁশ থেকে উৎপাদিত গুঁড়া রোদে শুকিয়ে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে চাপ দিয়ে ‘কয়ার পিট’, ব্লক এবং গ্রো ব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। দেশের বাজারে কয়ার ফেল্টের চাহিদা মেটানোর পর এখন নতুন পণ্য কয়ার পিট র‌্যাপিং পেপারে মুড়ে রফতানি করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে গবাদিপশু পালন ফার্মে ও কৃষিকাজে মাটির বিকল্প হিসেবেও কয়ার পিটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গার্ডেনিঙের সয়েল কন্ডিশনার, জৈবসারসহ বিভিন্ন কাজে বিশে^র বিভিন্ন দেশে এর চাহিদা রয়েছে। কারখানার স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজ আহমেদ জানান, তিনি ১৯৮৪ সালে আইএসসি পাস করে ব্যবসায় নেমে পড়েন। নারকেল তেল তৈরির কারখানায় উৎপাদিত ছোবড়া শুধু জালানি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। লাভজনকভাবে এই ছোবড়াকে ব্যবহার করতে তিনি ভারতের হরিয়ানা, দিল্লী, কেরালা, তামিলনাড়ু ও ওড়িশাসহ ভারতের বিভিন্নস্থানে ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কারখানায় ছোবড়া দিয়ে কয়ার ফেল্ট তৈরির কৌশল দেখে উদ্বুদ্ধ হন। পশ্চিমবঙ্গের কয়ার ফেল্ট তৈরির এক কারখানার সঙ্গে চুক্তি হয়ে বাগেরহাটের শ্রমিক নিয়ে প্রশিক্ষিত করে ২০০৫ সালে তিনি কারখানার উৎপাদন কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএআইডির এ্যাগ্রিকালচার ভ্যালু চেন (এভিসি) প্রজেক্টের আওতায় জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেয়ারে অংশ নিয়ে তিনি বিশ্ববাজারে কয়ার পিটের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা পান। ১৪-১৫টি দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসের সঙ্গে ই-মেইল আদান-প্রদানের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের সহযোগিতায় গত অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ার ডায়াপিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিন সুক কিম একজন ক্রেতা হিসেবে এ কারখানা পরিদর্শনে এসে এসব উৎপাদিত পণ্যের পছন্দ করে ক্রয়াদেশ দেন। তিনি আরও জানান, আমাদের দেশে কয়ার পিটের চাহিদা প্রচুর। পণ্যটির পানি শোষণক্ষমতা ব্যাপক, তাই শূকর, ভেড়া, ঘোড়া ও গরু পালনের খামারের মেঝেতে ব্যবহৃত হয়, যাতে মলমূত্র শুঁষে নিতে পারে। পরে ব্যবহৃত কয়ার পিট জৈবসার হিসেবে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া ফসলের চারা উৎপাদনেও এটি ব্যবহার করা হয়। ভারতের কয়ার বোর্ডের হিসাব মতে, সারা বিশ্বে নারকেলের আঁশের উৎপাদন বছরে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। এর ৯০ ভাগই জোগান দেয় ভারত ও শ্রীলঙ্কা। প্রচলিত পদ্ধতিতে গুঁড়া শুকাতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে কারখানাটি। তাই নিজেরাই কারখানায় ড্রায়ার যন্ত্র সংযোজিত করে আধুনিকায়ন করেছে কারখানাটি। নারকেলের ছোবড়া থেকে উৎপাদিক আঁশ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার সম্ভাবনার কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ গেজেটে ৩.৫.২ (১৪) ধারায় নারকেলের ছোবড়াকে বিশেষ উন্নয়নমূলক খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গত ২৩ জানুয়ারি ২০১৮ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নীতি শাখায় সিনিয়র সহকারী সচিব সলিম উল্লাহ নারকেলের ছোবড়ার আঁশনির্ভর শিল্পকে জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ এর অগ্রাধিকার খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্তি করে প্রজ্ঞাপন জারি করেন, যা ৮ মার্চ, ২০১৮ তারিখে গেজেটের ১০নং ধারায় প্রকাশিত হয়। কারখানার উৎপাদিত পণ্য তিনি বিদেশে রফতানি করছেন। কারখানার সফলতার কারণে নারকেলের ছোবড়ার আরও কিছু পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি এ প্রতিনিধিকে জানান। নারকেল শিল্পের ভবিষ্যত সম্ভাবনার কারণে নারকেল চাষীরা নারকেলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। ভারতের মতো এ শিল্পে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সার্বিক সহযোগিতা পেলে এই শিল্পের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বাগেরহাট চেম্বারের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, সামান্য নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে এটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনবে। তেমনি আমাদের দেশের শিল্পউদ্যোক্তদের আকর্ষণ বেড়ে যাবে এ দেশের অবহেলিত পণ্যসামগ্রীকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে অর্থ উপর্জন করার।
×