ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

আমরাও জানতে চাই?

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ১৩ আগস্ট ২০১৮

 আমরাও জানতে চাই?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। পেশায় কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক। দীর্ঘদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন প্রথমে লেখাপড়া ও পরে চাকরির সুবাদে। সেখানে চাকরির মেয়াদ শেষে তিনি দেশে ফিরে সস্ত্রীক সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নানারকম প্রকল্প, সাহিত্য রচনা ও সামাজিক কর্মকা-ে যুক্ত আছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিয়মিত কলাম লেখেন। এক সময় ‘প্রথম আলো’র তিনি একনিষ্ঠ কলামিস্ট হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। পরে একমাত্র পত্রিকায় লেখা ছেড়ে এখন একসঙ্গে অনেক পত্রিকায় একই কলাম প্রকাশ করেন। প্রথম আলো পত্রিকায় লিখবো না, এটা ঘোষণা দিয়েই অন্যান্য পত্রিকায় লেখা পাঠাচ্ছেন। সংবাদপত্রে এ রকম কলাম লেখাকে ‘সিন্ডিকেট কলাম’ বলা হয়। তার একজন একান্ত সচিব তার হয়ে সংবাদপত্রে এসব কলাম পাঠান ও তদারকি করেন। সে রকম এক সিন্ডিকেট কলামে তিনি সম্প্রতি সহিংসতায় উস্কানির অভিযোগে গ্রেফতার একজন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম সম্পর্কে তার সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন ও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ব্যঙ্গ করেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিজেই লিখেছেন তিনি শহিদুল আলমের কী অপরাধ জানেন না। শহিদুল আলম আল জাজিরা নামের একটি মধ্যপ্রাচ্য টিভির সঙ্গে সাক্ষাতকারে কী বলেছেন তা তিনি দেখেননি এমনকি এও বলেছেন ফেসবুক লাইভ কী তা তিনি জানেন না ও শহিদুল আলম ফেসবুক লাইভে কী বলেছেন তাও তিনি জ্ঞাত নন! যেন ‘শুনিলাম না, দেখিলাম না, পড়িলাম না’ অবস্থা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখার সঙ্গে পরিচয়টা সেই সত্তর দশক হতেই। স্মরণ করতে পারি, ১৯৭৪ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তিনি এঁকেছিলেন ছবিতা। কবিতার বিপরীতে ছবি এঁকে তিনি এক নতুন বৈশিষ্ট্য এনে নামকরণ করেছিলেন ‘ছবিতা’। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। কলেজ ক্যান্টিনে তার এই ছবিতা নিয়ে আমাদের মধ্যে বেশ গবেষণামূলক আলোচনা হয়েছিল। সেই আড্ডায় ছিলেন সহপাঠী রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আলী রীয়াজ, কামাল চৌধুরী, মঈনুল আহসান সাবের, আবদুল মোমেন, চঞ্চল খান, খালেদ খান প্রমুখ। যারা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন খ্যাতিমান। আমরা নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছিলাম। এই বিচিত্রাতেই পর পর ছাপা হয়েছিল তার ‘ছেলেমানুষী’, ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’সহ অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। আমাদের কাছে তার আবেদনটি ভিন্ন রকম ছিল এই কারণে যে, ওই রকম কল্পকাহিনী পাঠের অভিজ্ঞতাটি ছিল একেবারেই নতুন। আমাদের ভাবনায় জাগরিত হয়েছিল গল্পের নতুন ধারা। এই গল্পগুলো নিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার গ্রন্থ ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’। এই বইটি অনেক কপিই কেনা হয়েছিল কিশোর স্বজনদের জন্মদিনে উপহার হিসেবে প্রদানে। আমাদের কৈশোরোত্তীর্ণকালে আমাদের মনোভূমে তিনি ঠাঁই নিয়েছিলেন। মাঝখানে বেশ বিরতির পর তাকে আবার পেলাম আশির দশকে। একুশ শতকে এসে দেখি তার গ্রন্থের একনিষ্ঠ পাঠক আমার সন্তানরা। সম্ভবত তার প্রকাশিত সব গ্রন্থই তাদের সংগ্রহশালায় সাজানো দেখতে পাই। সায়েন্স ফিকশনে আগ্রহ তেমন জমেনি বলে আমার ওসব পড়া হয়নি। আমি তার কলামের পাঠক বনে গেছি ততদিনে। তার অনেক মতামতের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কিন্তু তার লেখায় যে এক ধরনের জাদু আছে তা টেনে নেয় বলা যায়। সে সুবাদে তার সর্বশেষ লেখাটিও পাঠ করতে হয়েছে। আর তা পাঠকালে হতভম্ব হয়েছি বলা যায়। অজানা অজ্ঞাত বিষয়েও যে তিনি মনগড়া বাক্য নির্মাণ করতে পারেন, তা এই প্রথম উপলব্ধি হলো। একজন আধুনিক শিক্ষায় দীক্ষিত ও মার্কিন মুল্লুকে লেখাপড়া করে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক হিসেবে তিনি ফেসবুক লাইভ কী জিনিস যদি না জানেন তাতে তার আধুনিকমনস্ক বিজ্ঞানীর পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি প্রায়ই একটা ভাব নিয়ে লেখেন বা বলেন, আমার বাসায় কোন টিভি নেই তাই আমি জানি না কখন কোথায় কী প্রচার হয়! বলেনও তিনি, আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। কিন্তু সবাই জানেন তার ফেসবুক ভেরিফাইয়েড এ্যাকাউন্ট আছে যেখানে তিনি স্ট্যাটাস দেন বা দেয়ান। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব লেখালেখি করে খ্যাতিমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্পর্শকাতর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে, বলে দেশে পরিচিতি অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই খ্যাতির আড়ালে যদি একটি দুর্বল রাষ্ট্র চিন্তা তার ব্যক্তিগত দর্শনে থেকেও থাকে তাতে সরকারকে বিব্রত করার কোন অধিকার তার নেই। একই সঙ্গে তিনি দেশের অগণিত পাঠকের কাছে একটি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন যে, সরকার শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করে দেশের সম্মান নষ্ট করেছেন। কারণ, তার ভাষায় শহিদুল একজন ‘আন্তর্জাতিক মানুষ’! এমনকি তিনি লিখেছেন শহিদুল ‘খ্যাতিমান সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলোকচিত্রশিল্পী’! জাফর ইকবাল সাহেব জানতে চেয়েছেন কেন তাকে রিমান্ডে নেয়া হলো? কলাম শেষে মন্তব্য লিখেছেন, ‘শেষবার সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের অনেক শিক্ষককে ধরে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। মনে আছে, আমরা তখন আমাদের সহকর্মীদের জন্যে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছি কিন্তু কেউ সেই লেখা ছাপানোর সাহস পাচ্ছে না। আমরা, শিক্ষকেরা তখন খুব অসহায় বোধ করেছিলাম। এখন অনেক দিন পর আবার কেমন যেন অসহায় বোধ করছি। নিজ দেশে কেন আমরা অসহায় অনুভব করব? কী হচ্ছে, আমরা কি জানতে চাইতে পারি?’ খ্যাতির বিড়ম্বনা এই যে, এসব খ্যাতিমানেরা ‘যখনই যাহার তখনই তাহার’ এ রকম একটি চরিত্র নিজেদের বিবেকের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন ও সুযোগ পেলে তার সদ্ব্যবহার করেন। যিনি বাসায় টিভি রাখেন না, ফেসবুক লাইভ জানেন না তিনি এই ডিজিটাল বাংলাদেশের তরুণদের কি জানেন? হর-হামেশাই তিনি টিভি চ্যানেলে টক শো করেন (এমনকি সস্ত্রীকও) অথচ বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের সমালোচনা করেন ‘বাক্স’ বলে! সংবাদপত্রের সমালোচনা করেন, সংবাদকর্মীদের নিয়ে বিষোদ্গার করেন। ক্লাসে লেখাপড়া করানো ছাড়া গণিত অলিম্পিয়াড আর শিক্ষক সমিতির নেতৃত্ব, ভিসি-বিরোধী আন্দোলন আর গণজাগরণ মঞ্চে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুবিধা নেয়া ছাড়া মুহম্মদ জাফর ইকবালের আর কী ভূমিকা এই দেশের তরুণদের চোখে পড়েছে? সরকারের নানা কমিটিতে নিজের নাম জড়িয়ে নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু সরকারের দেয়া কোন সুবিধা কি তিনি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন? এই মানুষটির উচিত ছিল শহিদুল আলমের বিষয়ে ভাল করে খোঁজখবর করে লেখাটি লেখা। শহিদুল আলম আন্তর্জাতিক মানুষ নন (রবীন্দ্রনাথ আর বঙ্গবন্ধুর পরে এই বঙ্গ ভূ-খন্ডে এখনও সে মাপের কোন আন্তর্জাতিক মানুষ আমরা এখনও পাইনি, এটা ইতিহাসে সৃষ্টি করে দেয় সময়)। শহিদুল আলম একজন ফটোগ্রাফার মাত্র, প্রথম জীবনে কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও পরে একটি স্টুডিও স্থাপন করেন ও ‘পাঠশালা’ নামে একটি ফটোগ্রাফি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাদের সহায়তা করেছেন মর্মে তার মায়ের ভূমিকা নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে উল্লেখ আছে। এছাড়াও আছে নানা গুঞ্জন। সে কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তিনি ফটোগ্রাফি নিয়ে একটি স্কুল পরিচালনা করেন যা তার ব্যবসা কেন্দ্র আর পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ফটো বিক্রি করেন। জনশ্রুতি আছে অনেক অধীনস্থ কর্মী তাকে ছেড়ে গেছেন নিজেদের ছবির স্বীকৃতিহরণের অভিযোগ করে। সে যাই-ই হোক, যে প্রক্রিয়ায় শহিদুল আলম দুনিয়ার নানা দেশে পরিচিত হয়েছেন তা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে নয়। তিনি তার ক্যারিয়ার পরিচিতিতে নানা রকম ট্যাগ লাগান। তার মানে এই নয় যে, তিনি সে পরিচিতির সুবাদে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকার ও দেশের জন্য সম্মানহানি হয় এমন মিথ্যা প্রচারের অধিকার পেয়ে গেছেন। ডক্টর ইকবাল যদি সাক্ষাতকারটি শ্রবণ করতেন, তবে বিস্মিত হতেন। এক জায়গায় শহিদুল আলম বলেছেন, ‘তারা যত কাছাকাছি যাবে নির্বাচনের, তত বেশি বেপরোয়া আচরণ করবে। কারণ তারা জানে একটা সুষ্ঠু মুক্ত নির্বাচনে তারা হারবে। অথচ তাদের কোন পালাবার পথ নেই। কেননা তারা এতকাল ধরে নোংরা নেতৃত্ব দিয়ে আসছে যে- যদি তারা হারে, তাদেরকেই সবাই ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলবে।’ কী ভয়াবহ উচ্চারণ। একাত্তরে আলবদর বাহিনী যে ভাষায় কথা বলত, এ তারই প্রতিধ্বনি। এটা কোন গণতন্ত্রের ভাষা নয়। বরং ঘাতকের কণ্ঠস্বরই যেন শোনা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে খুবলে খাবার এই অপমানজনক উক্তি যদি শুনতেন ডক্টর ইকবাল, আমি হলফ করে বলতে পারিÑ তিনি এমনভাবে লিখতে পারতেন না। বরং তিনি শহিদুল আলমের কাছে জানতে চাই বলে ক্ষুরধার একটি লেখা নামাতেন। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান এবং নারী ও আদিবাসীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চালু কোটা প্রথা সম্পর্কে শহিদুল আলম যা বলেছেন, ডক্টর ইকবাল তা কস্মিনকালেও সমর্থন করতে পারেন না। বরং এর বিরুদ্ধেই তিনি সোচ্চার হতেন। শহিদুল বলেছেন, ‘কোটা প্রথাটি এমনভাবে তৈরি করা যেন সরকারের পা-চাটা কাছের লোকরাই সরকারী চাকরি ও সুযোগ-সুবিধাগুলো পায়।’ এমন বক্তব্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবেরই অভিব্যক্তি বলা যায়, অতি সাধারণভাবে হলেও। কিন্তু ডক্টর ইকবাল এই ভাষ্য শ্রবণ করে স্থির থাকতে পারতেন কি-না, সন্দেহ জাগে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সময় করে একবার শহিদুল আলমের সঙ্গে আল জাজিরার কথা ও তার ভিডিও বক্তব্যগুলো দেখে নেবেন এই আশা করি। না দেখলেও এ দেশের ক্ষতি নেই কারণ এসব কলাম মহাকালের বিচারে বিশ্বাসঘাতকদের পাতায় ঠাঁই নেবে। তবে জাফর ইকবাল সাহেবকে বলে রাখি কেউ-ই আইনের উর্ধে নয়, যতক্ষণ দেশটি আইনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই কলামটি লেখার নেপথ্যে কী বোধ তাড়া করেছে আপনার, সেকথা লিখেছেন। দেশ নিন্দা মাতৃনিন্দার মতোই পাপ, সেটা নিশ্চয়ই ড. জাফর ইকবাল জানেন। বিদেশী মাধ্যমে দেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার যখন করা হয়, তাকে অপরাধ গণ্য না-ও করতে পারেন তিনি। কিন্তু আইনতো চলে তার নিজস্ব গতিতে। ড. ইকবাল আমরা জানতে চাই, না দেখা, না শোনা, না বোঝা বিষয় নিয়ে একজন শিক্ষক কতদূর যেতে পারেন?
×