ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এ কে আবদুল মোমেন

‘রাইপেন’ কার্যকর হলে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না

প্রকাশিত: ০৬:১১, ৩১ জুলাই ২০১৮

‘রাইপেন’ কার্যকর হলে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। দেশে পেট (পিইটি) বা পলিথিন জাতীয় দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পেট রেজিন থেকে তৈরি হচ্ছে পলিস্টার কাপড়ও। তবে এতদিন ‘পেট’ বোতল ও দ্রব্যসামগ্রীর কাঁচামাল পেট রেজিন আমদানিনির্ভর ছিল। এ আমদানিনির্ভরতা কমাতে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ সঞ্চয়ের লক্ষ্যে এবার দেশেই শুরু হয়েছে পেট রেজিন উৎপাদন প্রক্রিয়া। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পেট রেজিনভিত্তিক কারখানা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বিপিসিএল)। পেট রেজিন দিয়ে খাবার পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল তৈরি করা হয়। এছাড়া অন্য দ্রব্যসামগ্রীও এ পেট রেজিন থেকে তৈরি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ প্রতিবছর ১ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন রেজিন আমদানি করে থাকে, যা চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এই কারখানা নিয়ে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদেম মাহমুদ ইউসুফের বক্তব্য হলো, বিপিসিএল বাংলাদেশের বর্জ্য থেকে পণ্যের নতুন কাঁচামাল বের করার ধারণাকে কাজে লাগাতে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে। এ কারখানায় প্লাস্টিকের ব্যবহৃত বোতলসহ বিভিন্ন সামগ্রী পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হবে। বর্তমানে কারখানাটির উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ৫০০ মেট্রিক টন। কয়েক বছরের মধ্যেই তা ২৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। কারখানায় বর্তমানে দেড় ’শ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশে বর্তমানে তিন লাখ বর্জ্য সংগ্রাহক রয়েছে। খাদেমের লক্ষ্য এই সংগ্রাহকদের জীবনযাত্রা উন্নত করা। যার মাধ্যমে শিশুশ্রমও হয়তোবা উৎখাত করা সম্ভব হবে। যতদূর জানি, এই ভদ্রলোকের ব্যাকগ্রাউন্ড মূলত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। চাকরির শুরুতে তিনি ছিলেন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এএমডিতে। পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান তিনি। সেখানে ন্যাশনাল সেমি-কন্ডাক্টরে কাজ শুরু করেন। এরপর বেশ কয়েকটি স্টার্টআপেও কাজের অভিজ্ঞতা হয় তার। এর কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। এখানে নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আলাপ-কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। শুরুতে তাদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ব্যাংককে একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত করা। একে একে বিভিন্ন ব্যাংক এই সেবাটি গ্রহণ করতেও শুরু করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন খাদেম মাহমুদ ইউসুফ। তাঁর মতো অবশ্য অনেকেই দেশে ফিরে আসেন। বিদেশের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উচ্চশিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন। আমার পরিচিত, চেনা-জানা আরও অনেক উদ্যোক্তা, পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কিন্তু দেশে ফিরে দেশের টানে তাদের শিক্ষা বা দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এখানেও বাণিজ্যিক বা সেবা কার্যক্রম শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান, প্রসারিত হচ্ছে পর্যটন শিল্পও। অনেকেই এখানে আন্তর্জাতিকমানের হোটেল নির্মাণ করছেন। বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। রফতানি আয় বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এটি আমাদের অর্থনীতিকে যেমন সমৃদ্ধ করছে, তেমনি এটি অবশ্যম্ভাবীভাবে দরকারিও। কেননা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতে আমাদের দরকার হবে চার কোটি ৯৮ হাজার ৫০ লাখ কোটি টাকা। এত অর্থ কোথা থেকে আসবে? এর জন্য উদ্ভাবনী পথ খুঁজতে হবে। চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে আমরা দেখেছি সে সব দেশের মানুষ যারা বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হয়েছেন, তারাই কিন্তু দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মাধ্যমেই সে সব দেশে বড় বিনিয়োগ এসেছে। গণচীনে ৬৬% বিনিয়োগ এসেছে তাদের দেশের প্রবাসীদের মাধ্যমে। সাম্প্রতিককালে ভারতেও এটি হচ্ছে। ভারত পরিকল্পিতভাবেই এটি শুরু করেছে। বিদেশে অবস্থানরত নন-রেসিডেন্সিয়াল ভারতীয়দের জন্য সে দেশের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার দ্বার খোলা। বিদেশে তাদের দূতাবাসগুলো নন-রেসিডেন্ট ভারতীয়দের সেবা প্রদানে খুবই আন্তরিক ও পারদর্শী। অর্থাৎ দেশের উন্নয়নেই সে দেশের প্রবাসীরা অবদান রাখছেন। দেরিতে হলেও অবশ্য আমরাও তেমন উদ্যোগ গ্রহণ শুরু করেছি। আমাদের জনসংখ্যার ১ কোটি ১৬ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে কাজ করছেন। এদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছেন যারা দেশে ফিরে আসবেন, অন্য আরেক ধরনের লোক আছেন যারা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন। তবে তাদের বড় অংশই দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে চান, দেশের সাধারণ অসহায় মানুষের উপকারে আসতে চান। এই বিরাট সংখ্যক প্রবাসীকে উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে আসতে প্রতিবছর ৩০ ডিসেম্বর ‘প্রবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রবাসীরা ঢাকাসহ তা বিভিন্ন দেশে পালন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তাতে নীতিগত সম্মতি আছে, তবে সরকার এখনও প্রবাসী দিবস ঘোষণা করেনি। উল্লেখ্য, যদিও বাঙালীরা ৫২ সাল থেকে শহীদ দিবস বা ১৯৭৫ সাল থেকে শোক দিবস পালন করে আসছে। এ সম্পর্কে সরকারী ঘোষণা বহু বছর পরে এসেছে। তবে সুখের বিষয় যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। টাস্কফোর্স কিভাবে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে। কিভাবে প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে পারেন তার দুটো প্রস্তাব এসেছে। এর একটি হচ্ছে ‘পাই’ অন্যটি হচ্ছে ‘রাইপেন’। পাই-এর অর্থ হচ্ছে ফিলানথ্রপি-ইনভেস্টমেন্ট, পি-ফিলানথ্রপি, ই-এক্সচেঞ্জ, আর রাইপেন হচ্ছে আর-রেমিটেন্স, আই-ইনভেস্টমেন্ট, পি-ফিলানথ্রপি, ই-এক্সচেঞ্জ এবং এন-নেটওয়ার্কিং। বস্তুত রাইপেন বিশ্লেষণ করলে যেমনটি দাঁড়ায় তা হলো ‘আর’ এ রেমিটেন্স। প্রতিবছর ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে, কিন্তু সেটি উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না নানা কারণে। আমাদের আছে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, এর একটি বড় অংশ বলতে গেলে অলস পড়ে থাকে। প্রবাসীদের রেমিটেন্স ও রিজার্ভের অর্থ কাজে লাগাতে একটি সেল করার কথা ভাবা হচ্ছে। এসব অর্থ কাজে লাগিয়ে আমরা বড় বড় প্রজেক্ট করতে পারি, গভীর সমুদ্র বন্দরও হতে পারে। এতে করে কারও প্রতি মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। এরপর ‘আই’ অর্থ ইনভেস্টমেন্ট। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অনেক ওকালতি করেছি, দেন-দরবার করতে হয়েছে অনেক। বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ কেউ নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চাইলেন, তখন অনেক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়েছে। পরে তারা দেশের সামগ্রিক অবস্থা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আরেক লেখায় তা তুলে ধরব। যা বলছিলাম যে, আমাদের এখানে ইনভেস্টমেন্ট সেল করার পরামর্শ দেয়া হবে, সবকিছু সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এতে একদিকে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন, দেশ লাভবান হবে। এখানে এনার্জি কষ্ট কম, লেবার কষ্ট কম। মোটের ওপর লাভবান হবে দেশ। প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা হবে এখানে। দেশের বাইরে থাকাকালীন প্রবাসী অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর অনেক প্রবাসী স্বদেশের উন্নয়নের জন্য বহুমুখী বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তবে তার অধিকাংশই কার্যকর হয় না। সুতরাং, তাদের প্রস্তাবগুলো ফেসিলেট করার জন্য বিনিয়োগ সেল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর পি-তে ফিলানথ্রপি। বিদেশীরা দাতব্যমূলক কাজে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু দেখা যায় যে, এখানেও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। সেই জটিলতাগুলোও দূর করতে হবে আমাদের। সাহায্য আসা পদে পদে বাধা পড়ে, এগুলো দূরীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। ই-তে দাঁড়ায় একচেঞ্জ অব এক্সপেরিয়েন্স এ্যান্ড এক্সপারটাইজ। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বিনিময়। বিদেশে আমাদের বহু অভিজ্ঞ প্রবাসী আছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক ডাক্তার বা শিক্ষক। একজন ডাক্তার বা শিক্ষক যখন দেশে আসেন, আমরা যদি তাকে অনুরোধ করি যে, আপনি এক সপ্তাহ বিনামূল্যে সেবা দিন। তিনি কিন্তু সেটি দেবেন। কিন্তু দেখা যায় যে, তিনি কখন আসেন সেই খবরই আমাদের হাতে নেই। বহু বাঙালী আছেন, যারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বিদেশে। তাঁরা সেবা ও ট্রেনিং দিতে পারেন আমাদের। তাদের জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য একটি সেল হতে পারে। এন-এর অর্থ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। এখন অনেক বাঙালী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। এই দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্রাইসিস দেখা দেয়। তা সমাধানেও তারা কাজ করতে পারেন, যা আমাদের জন্য বড় ধরনের সহায়ক হতে পারে। যেমন, ধরা যাক রোহিঙ্গা ইস্যু। আমাদের লোকেরা দেশের হয়ে লবিং করতে পারেন রোহিঙ্গা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার জন্য। তারা সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করেছেন। তারা একটি সুপারিশ করলে সেটি কাজে আসবে। তাছাড়া অনেক বাঙালী এখন বহুজাতিক নানা প্রতিষ্ঠানে শীর্ষপদ বা দায়িত্বশীল পদে আসীন আছেন। তারা যদি দেশে বিনিয়োগ বা সেবামূলক কর্মসূচীতে বিনিয়োগের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করেন তা খুব কাজে দেবে। যা দিবে না দশটি বড় রোড শো করলে বা মন্ত্রী-এমপিদের দশটি সফরেও। সুতরাং, আমাদের এগুলো সংগঠিতরূপে করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, হন্ডুরাসের মতো রাষ্ট্রও করছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। সিলেটের এক ভদ্রলোক জে-আইসি-সুইট-লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ফকরুল ইসলাম চৌধুরী, সেই সেকেন্ডারী লেভেল শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছেন লন্ডনে। এর পর থেকে সেখানেই বসবাস। ভদ্রলোকের পরিবারের সদস্যরাও যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি বড় ব্যবসায়ী। সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, মরক্কো, ইউরোপসহ নানা দেশেই রয়েছে তাঁর ব্যবসায়িক কার্যক্রম। বাংলাদেশেও তিনি ব্যবসা কার্যক্রম শুরু করেন কয়েক বছর হলো। প্রচলিত ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এক্কেবারে গ্রামের মধ্যে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপন করেছেন, যেখানে কাজ করছে ১২শরও বেশি শ্রমিক। বড় সুবিধা হলো, এসব শ্রমিকের জন্য আলাদা থাকার জায়গা দরকার হচ্ছে না। বাড়ি থেকে সকালে এসে কারখানায় কাজ করছে। দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। বাড়তি খরচ ছাড়াই থেকে যাচ্ছে আয়ের পুরোটা। এতে ওই অঞ্চলের নারীদের আয় বাড়ছে, হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। এই ফকরুল সাহেবের ইচ্ছে তিনি সিলেটে ব্যক্তি উদ্যোগে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবেন। যে সময় তিনি উদ্যোগ নিলেন সেই সময় নিয়মানুযায়ী অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ৫০ একর জমির দরকার হয়। সেখানে তাঁর ছিল ৫৪ একর জমি। কিন্তু এরপর শুরু হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। ঠুকে দেয়া হয় তুচ্ছ কিছু অজুহাতে মামলাও। ভদ্রলোক থেমে যান না। পুরো উদ্যোমী হয়ে কাজ করতে থাকেন। নিয়মিত হাজিরা দেন আদালতে, দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত থাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহে। সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি এখনও, তবে কাজ চলছে। এখন অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ন্যূনতম ১০০ একর। তিনি বলেছেন, তাকে অনুমতি দেয়া হলে বাকি জমিও তিনি কিনে ফেলবেন। এই অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে এখানে অন্তত আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। স্বদেশে ফেরার পর থেকে প্রতিদিন অনেক লোক চাকরির জন্য তদবির করতে বলেন। যারা এই ভদ্রলোককে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করেছেন তাদের কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনদের জন্যও যোগাযোগ করেছেন। তবে তারা যদি এই ভদ্রলোককে হয়রানি না করে কাজটি করে দেন তখন একটা-দুটা চাকরি নয়, বহু লোকের চাকরির ব্যবস্থা হবে- এই সামান্য বিষয়টি অনেকে বুঝে আনতে পারে না। মূলত ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নানান অধিদফতরের অনুমতি, ট্রেড লাইসেন্স জোগাড়সহ এসব জটিলতা কমলে ফকরুল সাহেবদের মতো আরও প্রবাসী এদেশে এসে বিনিয়োগ করতে পারতেন। তবে সুখের বিষয় এই যে, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও বহু প্রবাসী ইতোমধ্যে অনেক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছেন। তবে এটাও সত্যি যে, বিদেশ থেকে এসে প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগ করার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়ে গেছে এখনও। উৎপাদক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানির অনুমোদন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি, মূসক নিবন্ধন, বিদেশী বিনিয়োগের বিভিন্ন লাইসেন্স, শিল্পপ্লট ও গ্যাস-বিদ্যুত-পানি সংযোগ নেয়ার প্রক্রিয়া, খাতওয়ারি বিভিন্ন পণ্যের লাইসেন্স, এনভারমেন্ট বিভাগের ছাড়পত্র- এসব কাগজপত্র করতে বহু ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এই অফিস থেকে সেই অফিসে দৌড়াদৌড়ি, কার লবিং, ক্ষমতাবানদের থেকে রেফারেন্স, আবার কোথাওবা বকশিশের নামে অযাচিত অর্থ ব্যয়ের মতো ঝামেলাও রয়ে গেছে। যদিও এসব ঝামেলা মোকাবেলায় সরকারী যথেষ্ট উদ্যোগ রয়েছে, তবে কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারণে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে ইদানীং দুটো উদ্যোগ নেয়া হয়েছেÑ একটি হচ্ছে ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস এবং অন্যটি হচ্ছে প্রবাসী টাস্কফোর্স, যা নিয়ন্ত্রিত হবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে। যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে সেটি ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমি নিজেও এই টাস্কফোর্সের সদস্য। আমি আশাবাদী শিগরিরই আরও ফলপ্রসূ কিছু হবে। আসলে আমাদের দুটো বড় সম্পদ রয়েছেÑ একটি হলো পানি, আর অন্যটি হলো জনসম্পদ। এই ‘রাইপেন’ কর্মসূচী সফল হলে দেশের উন্নয়ন কাজে বরাদ্দের জন্য দাতা দেশসমূহের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হবে না বা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে সত্যিকার অর্থেই সহযোগিতা করতে পারেন। পৃথিবীর দেশে দেশে এটি হয়ে আসছে। যেহেতু বিদেশী সাহায্য দিন দিন কমে আসছে, সেজন্য নব নব উদ্যোগ বা সৃষ্টিশীল উৎস খুঁজতে হবে আমাদের। নিজেদের উন্নয়নে নিজেদের মানুষদের কাজে লাগাতে পারলে অল্প খরচেই আমরা আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হতে পারি। এ ক্ষেত্রে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে আমাদের দায়িত্ব হবে সে উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশে-বিদেশে যারা যেখানেই আছি তাদের দেশের সমৃদ্ধির জন্য নিজ থেকে দায়িত্ব পালন করা উচিত। এটি করতে পারলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারব। এগিয়ে যাবে আমাদের অর্থনীতি, পূরণ হবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ণ রূপ পাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। লেখক : জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এবং চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ
×