ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নৌবাহিনীর সোহাগীর স্বর্ণপদক

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২৯ জুলাই ২০১৮

নৌবাহিনীর সোহাগীর স্বর্ণপদক

রুমেল খান ॥ এ্যাথলেটিক্সকে বলা হয় ‘মাদার অব গেমস’। আর সেই গেমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ডিসিপ্লিনগুলোর অন্যতম হচ্ছে ২০০ মিটার স্প্রিন্ট। রুদ্ধশ্বাস দৌড়ে কে হন বিজয়ী বা বিজয়িনী, সেটা জানার জন্য শনিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক। তাদের সামনে বিজয়ের বরমাল্য পরলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সোহাগী আক্তার এবং বিকেএসপির জহির রায়হান। ‘ঢাকা সিটি এফসি লিঃ ১৪তম জাতীয় সামার এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা’র দ্বিতীয় এবং সমাপনী দিনে দিনের সবচেয়ে ‘হট ইভেন্ট’ ২০০ মিটার স্প্রিন্টে মহিলা ও পুরুষ বিভাগে স্বর্ণপদক করায়ত্ত করেন তারা। এই ইভেন্টে সোহাগী গত আসরেও সোনা জিতেছিলেন। আর সার্বিকভাবে এ নিয়ে এ ইভেন্টে তিনবার স্বর্ণজয় করলেন। আর জহির রায়হান এই ইভেন্টে প্রথমবারের মতো জিতলেন সোনা। আগের আসরে এই ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন সাইফুল ইসলাম খান সানি। প্রথমে সোহাগীর কথায় আসা যাক। বিজেএমসি থেকে নৌবাহিনীতে যোগ দেন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০০ মিটারে এ নিয়ে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি। ন্যাশনাল মিটে একবার (২০১৬), আর সামার মিটে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে। মজার ব্যাপারÑ ২০০ মিটারে জিতলেও এটা তার আসল ইভেন্ট নয়। তার আসল ইভেন্ট হচ্ছে ৪০০ মিটার! ২০১৪ সাল থেকেই এই ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতে আসছেন তিনি। যদিও এই ইভেন্টে এবার তিনি সোনা জিততে পারেননি। জিতেছেন রূপা। ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিততে সোহাগী সময় নেন ২৫.১০ সেকেন্ড। রূপা জেতেন একই দলের শিরিন আক্তার (২৫.২০ সেকেন্ড), যিনি গত আসরের স্বর্ণজয়ী ছিলেন। মজার ব্যাপারÑ সেবার তিনি যে টাইমিং করেছিলেন, এবার সেই একই টাইমিং করেছেন সোহাগীও। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শরীফা খাতুন জেতেন তাম্রপদক (২৫.৪০ সেকেন্ড)। সোহাগীর বয়স ২২। শেরপুরের নখলায় গ্রামের বাড়ি। আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন ৪০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে। সেখান থেকে বিকেএসপির ট্রেনিং নিয়েছেন মাসখানেক। তারপর সেখান থেকে বিজেএমসিতে যোগ দেন। পড়াশুনা করেন শেরপুরের চৌধুরী সদরুন্নেসা মহিলা ডিগ্রী কলেজে। চাকরির কারণে গ্রামের বাড়িতে যাবার খুব একটা সময়-সুযোগ পান না সোহাগী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লক্ষ্য? ‘নিজের টাইমিংয়ের উন্নতি ঘটানো। তাহলে সাফ গেমসে নিশ্চয়ই কোন পদক জিততে পারব। তবে এ জন্য ক্যাম্পে থেকে দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ-অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই।’ জবাব নাজমুন নাহার সোহাগী আক্তার বিউটিকে আদর্শ স্প্রিন্টার মানা সোহাগীর। আরও যোগ করেন, ‘আজ শুরুর দিকে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও পরে একটু গতি কমে যাওয়ার কারণ ক্লান্তি হতে পারে। গতকাল ৪০০ ও ১০০ মিটারে দৌড়েছিলাম। ১০০ মিটারে দ্বিতীয় হলাম। তবে ২০০ মিটারে টাইমিং আরেকটু উন্নতি হলে ভাল হতো।’ মা মোটামুটি উৎসাহ দিলেও বাবা-চাচা-ফুফুরা একটু রক্ষণশীল। এ জন্য ক্যারিয়ারের শুরুতে একটু সমস্যায় পড়তে হয়েছে সোহাগীকে। পরে ট্রাউজার্স পরে খেলার আশ্বাস দিয়ে অনুমতি আদায় করে নেন দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় সোহাগী। জহির রায়হান সোনা জিততে টাইমিং করেন ২১.৭০ সেকেন্ড। সেনাবাহিনীর শরীফুল ইসলাম জেতেন রৌপ্যপদক (২২.২০ সেকেন্ড)। তাম্রপ্রদক জেতেন নৌবাহিনীর আবদুর রউফ (২২.৬০ সেকেন্ড)। জহির বলেন, ‘৪০০ মিটারে পর ২০০ মিটারেও সেরা হলাম। দীর্ঘদিন ইনজুরিতে ছিলাম বলে দুর্ভাবনা ছিল না পারব কি-না। কোচ সাহায্য করছেন। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল ভাল করতে পারব। অনুশীলনও ভাল হয়েছিল। হাল ছাড়িনি। আজকে লক্ষ্য ছিল ২০০ মিটারে ভাল দৌড়াব।’ ৪০০ ও ২০০ মিটার জহিরের প্রিয় ইভেন্ট। তবে ৪০০ মিটারই বেশি পছন্দ। মার্চে এসএ গেমসে ভাল করা সম্ভব। যদি পর্যাপ্ত অনুশীলন ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে ভাল ফল হবে। সব সুবিধা পেলে পদক আনতে পারব।’ গত বছর আইএএএফ ওয়ার্ল্ড অনুর্ধ-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের ৪০০ মিটার দৌড়ের সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিলেন জহির। ১৯৯৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ গেমসে ১০০ মিটারে আব্দুল্লাহ হেল কাফি সেমিফাইনালে ওঠার পর স্প্রিন্টে বাংলাদেশের তেমন কোন সাফল্য আসছিল না। এতদিন বাদে এসে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের কোন প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে ওঠার কৃতিত্ব দেখান সম্ভাবনাময় এই তরুণ এ্যাথলেট। কেনিয়ার নাইরোবিতে সেমিতে দুই নম্বর হিটে আট প্রতিযোগীর মধ্যে পঞ্চম হন জহির। তিনি সময় নেন ৪৮.২২ সেকেন্ড। ফাইনালের টিকেট পাওয়া আট প্রতিযোগীর শেষজন তারচেয়ে ৪৬ সেকেন্ড কম সময় নিয়েছেন, অর্থাৎ তার লাগে ৪৭.৪৬ সেকেন্ড। রাতে শেরপুর-জামালপুর রোডে যিনি দৌড়ে অনুশীলন করতেন, একসময় মোবাইল ফোন বিক্রি করে কেডস কিনেছিলেন, এবার যিনি বঙ্গবন্ধুতে গতির ঝড় তুললেন, সেই জহির নিজের উন্নতির জন্য বাড়তি অনুশীলনও করেছেন রাতে নিজের রুমে। এই সাফল্যের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। ছোটবেলায় স্কুলে সবসময় দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন জহির। এছাড়া প্রত্যেকদিন বিকেল বেলা গোল্লাছুট খেলতেন। বন্ধুরা কখনও ধরতে পারতো না তাকে। ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে যোগ দেন জহির। তারপর পরিপূর্ণ এ্যাথলেট হিসেবে বেড়ে ওঠার পর্ব। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ জহিরের বাব-মা দু’জনেই শিক্ষক। মা অবশ্য শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে এখন গৃহিণী। প্রখ্যাত এ্যাথলেট কোচ আবদুল্লাহ হেল কাফি বলেন, ‘জহিরের শারীরিক গঠন, উচ্চতা ও ওজন সবই ভাল। ওর যে এনার্জি আছে সেটা কিভাবে ডিস্ট্রিবিউট করতে হবে, সেটা ভালভাবে বোঝে।’
×