ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ দিনে ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা ঋণ

সরকার ঋণ গ্রহণের চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ২৪ জুলাই ২০১৮

সরকার ঋণ গ্রহণের চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং খাতের তারল্য (নগদ টাকা) সঙ্কট চলছে। এ সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া শুরু করেছে। গত অর্থবছরের শেষ সময়ে এ প্রবণতা দেখা যায়। চলতি অর্থবছরেও সে ধারা অব্যাহত আছে। সর্বশেষ হিসাবে, চলতি মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ১৫ কার্যদিবসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিট ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি। গত অর্থবছরের শেষ দুই মাসেও গড়ে দৈনিক প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের বছরে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বেশি হারে বাস্তবায়ন হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হলে ও কাক্সিক্ষত হারে বিদেশী ঋণ না এলে ব্যাংকঋণ বেশি হারে নিতে হবে। যদিও কয়েক বছর ধরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে ফেরত দিয়েছে। এতে কমে গিয়েছিল সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি। তবে বিপরীতে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ রেকর্ড হারে বেড়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বেশি হারে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানান, কয়েক বছর ধরে ব্যাংকে বিনিয়োগের চাপ ছিল না। শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে কাক্সিক্ষত হারে নতুন উদ্যোক্তা আসেনি। ফলে সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া আমানত এক সময় ব্যাংকের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়ে ব্যাংকগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে আমানতের সুদহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে মুনাফার হার সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। ফলে ব্যাংকে আমানত রাখতে সাধারণ গ্রাহক নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। ফলে বেশি মুনাফার আশায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে থাকেন। এভাবেই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয় ৪৩ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে কিছুটা তারল্য সঙ্কট রয়েছে। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদহার উর্ধমুখী রয়েছে। যদিও নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করার বিষয়ে ব্যাংকগুলো বিবেচনা করছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়ে গেলে তারল্যের ওপর আরও কিছুটা চাপ বেড়ে যাবে। এতে বেসরকারী খাতের ঋণের ওপরও প্রভাব পড়বে। এদিকে স্থানীয় বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়নে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন নীতি নির্ধারকেরা। সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নির্বাচনী বছরে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে। কিন্তু সেই সঙ্গে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির চাপ। ফলে টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মূল্যস্ফীতির উর্ধমুখী চাপ ঠেকানো যাবে না। এটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারকেরা। এদিকে ব্যয় নির্বাহের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার ঋণ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গত জুন শেষে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২৩ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরে শুরুর কয়দিনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করলেও সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের কাছে সরকারের ঋণ স্থিতি ৯০ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯২ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা বলছেন, বেসরকারী খাতের ঋণের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে পড়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক। এ সঙ্কটের কারণে সুদহার হু হু করে বাড়তে থাকে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বাড়তে থাকা সুদহারে লাগাম টানেন ব্যাংকের মালিকরা। চলতি মাসের শুরু থেকে আমানতে সর্বোচ্চ ৬ এবং ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ কার্যকরের ঘোষণা হয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অর্থ ছাড় করতে সময় লাগে, দৈনন্দিন কাজে অর্থের প্রয়োজন হয়; কিন্তু শুরুতেই আয় হয় না। তাই সব সময় অর্থবছরের শুরুর দিকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়ে। বিভিন্ন প্রকল্প ও বরাদ্দের অর্থ পাওয়ার পর সেখান থেকে প্রয়োজন মেটানো ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হয়, যার ফলে শুরুতে বাড়লেও পরবর্তী সময়ে তা কমে যায়। তারা জানান, মূলত নির্বাচনের বছরে পদ্মা সেতু, এলএনজি টার্মিনাল, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে ব্যাপক অগ্রগতির ফলে সরকারের প্রচুর নগদ অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে।
×