ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাহিয়ান দ্বীপ

বিশ্বফুটবলে রাজত্ব ফিরে পেল ফ্রান্স

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১৮ জুলাই ২০১৮

বিশ্বফুটবলে রাজত্ব ফিরে পেল ফ্রান্স

আবারও শিরোপা উঁচিয়ে ধরল ফ্রান্স। দীর্ঘ দুই দশক পর বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল দিদিয়ের দেশমের শিষ্যরা। রবিবার রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে এমবাপে-গ্রিজম্যানরা ৪-২ গোলে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর আবারও শিরোপা জয়ের উল্লাসে মাতে ফ্রান্স। অন্যদিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেয়া ক্রোয়েশিয়াকে রানার্স-আপের তৃপ্তি নিয়েই দেশে ফিরতে হলো। আগামী চার বছরের জন্য ফুটবল সাম্রাজ্যের সিংহাসনটি দখলে নিয়ে নিল জিনেদিন জিদান-দিদিয়ের দেশমের অনুজরা। ফরাসী সৌরভে মুখরিত এখন গোটা ফুটবল দুনিয়া। যে সৌরভে মিশে থাকল ফরাসীদের রাজত্ব। শিরোপা ঘরে তোলার লড়াইয়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে পাত্তাই পেল না ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের হারের প্রতিশোধও নেয়া হলো না ক্রোয়াটদের। একই গল্প লিখে এবার শিরোপা উৎসবে মাতল দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা ফ্রান্স। ২০ বছরের মধ্যে দুটি বিশ্বকাপ জেতা ফ্রান্সের নাম বসে গেল দিয়েগো ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা আর উরুগুয়ের পাশে। এই তিন দলই দুটি করে বিশ্বকাপ জিতেছে। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে শিরোপা উৎসব করেছিলেন জিদান-দেশমরা। এবার বিদেশের মাটিতেও ফরাসীদের বিজয় কেতন উড়ল। যেখানে জিদান-দেশমদের ভূমিকায় থাকলেন এমবাপে, গ্রিজম্যান, পোগবারা। বয়স বিবেচনায় রাশিয়া বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ দল ফ্রান্স। পুরো আসরেই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স উপহার দিয়েছে তারা। শিরোপার লড়াইয়ে ক্রোয়েশিয়াকে বিধ্বস্ত করে নতুন এক ইতিহাস গড়েছে ফ্রান্স। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ দল নিয়ে বিশ্ব জয় করেছে অঁরি-জিদানের উত্তরসূরিরা। তাদের আগে প্রথম দল হিসেবে এই কীর্তি গড়েছিল ব্রাজিল। ১৯৭০ বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ দল নিয়ে বিশ্ব জয় করেছিল সেলেসাওরা। সেবার তাদের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ছিল ২৫ বছর ৯ মাস। ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ দল নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড এখন ফ্রান্সের। ২০১৮ বিশ্বকাপজয়ী ফরাসীদের বয়স ২৫ বছর ১০ মাস। রাশিয়ায় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন তারা। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ডেনমার্কের বিপক্ষে শুধু গোলশূন্য ড্র করেছিল দেশমের দল। ৪৮ বছর আগের সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিল ৪-১ গোলে হারিয়েছিল ইতালিকে। প্রায় পাঁচ দশক পর বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রতিপক্ষের জালে চারবার বল জড়ানোর কীর্তিটাও এখন নিজেদের করে নিল এমবাপে-পোগবারা। মস্কোর লুঝনিকিতেও যে ফ্রান্স ৪-২ ব্যবধানে রীতিমতো উড়িয়ে দেয় মডরিচ-মানদুকিচদের ক্রোয়েশিয়াকে! জøাতকো দালিচের শিষ্যদের হারিয়ে ষষ্ঠ দেশ হিসেবে এক বা তারও বেশি সময় বিশ্বজয়ের রেকর্ড এখন ফ্রান্সের। এই তালিকায় সবার আগে রয়েছে ব্রাজিল। যারা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। চারবার করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কীর্তি রয়েছে ইতালি, জার্মানির। দুবার করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনা। ফরাসীদের দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের সেরা মুকুট পরাতে আলাদা করে ভূমিকা রেখেছেন দিদিয়ের দেশম। খেলোয়াড় ও কোচ হয়ে দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর নতুন নজির গড়লেন এবার। বিশ্বকাপের এ যাবতকালের ইতিহাসে মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে অসামান্য এই কীর্তি গড়েন তিনি। তার আগে এই রেকর্ড গড়েছিলেন মারিও জাগালো এবং ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। দুবারই সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন মারিও জাগালো। খেলোয়াড় হিসেবে সেলেসাওদের দুবার উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসানোর পর ১৯৭০ বিশ্বকাপে কোচ হিসেবেও ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করেন জাগালো। জাগালোর পর এই কীর্তি গড়েন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। ১৯৭৪ সালে জার্মানিকে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতানোর পর ১৯৯০ সালে পশ্চিম জার্মানিকে কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ উপহার দেন দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার বেকেনবাওয়ার। তার প্রায় তিন দশক পর খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ উপহার দেয়ার অসামান্য কীর্তি গড়লেন দিদিয়ের দেশম। এমন কীর্তিতে রোমাঞ্চিত ফরাসী কোচ। ম্যাচ শেষে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দেশম বলেন, ‘এটা সত্যিই সুন্দর। এটা বিস্ময়কর। আমরা হয়ত দুর্দান্ত ম্যাচ খেলিনি ঠিকই, তবে আমরা ঠিকই আমাদের শক্তিশালী মানসিক দিকটা দেখিয়ে দিয়েছি। আমরা চার গোল করেছি। এখানেই আমাদের যোগ্যতা। আমি আমার দল নিয়ে দারুণ খুশি। অনেকটা দূর হাঁটতে হয়েছে আমাদের, যা মোটেও সহজ ছিল না। সবাইকে ধন্যবাদ। আগামী চার বছর ধরে এই দলটাই বিশ্বসেরা হয়ে থাকবে।’ ফরাসী তারকা এ্যান্টোনিও গ্রিজম্যান তো এতটাই আনন্দিত ও আপ্লুত যে, তিনি কোথায় হারিয়েছেন তা-ই জানেন না। বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিক্রিয়ায় গ্রিজম্যান বলেন, ‘আমি নিজেও জানি না আমি এখন কোথায়। এটা খুবই অসাধারণ, দারুণ খুশির। ফাইনালটা খুব কঠিন একটা ম্যাচ ছিল। ক্রোয়েশিয়া দারুণ একটা ম্যাচ খেলেছে। আমাদের শুরুটা ভয়ানক ছিল। আমরা জানতাম এটা বিশ্বকাপের ফাইনাল। এরপর আমরা গুছিয়ে নিলাম, কাউন্টার এ্যাটাক করলাম, পার্থক্য গড়ে দিলাম। শিরোপা উঁচিয়ে ধরে আমরা এখন সামনের দিকে এগোব।’ রাশিয়া বিশ্বকাপে গোলে কোনো শট না নিয়েই বিশ্বকাপ জেতা ফরোয়ার্ড ফ্রান্সের অলিভিয়ের জিরুড। বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিক্রিয়ায় এই ফরাসী ফরোয়ার্ড জানান, ম্যাচ শেষে দেশটির প্রেসিডেন্টও যোগ দেন শিরোপা উদযাপনে। এ নিয়ে জিরুড বলেন, ‘আমরা ড্রেসিং রুমে সবাই মিলে শিরোপা উদযাপন করেছি। এমনকি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্টও আমাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন।’ দলটির বিস্ময় তারকা বলা হচ্ছে কিলিয়ান এমবাপেকে। যিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে গোল করেছেন এবং তৃতীয় কনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে জিতে নিয়েছেন ফুটবল বিশ্বকাপ। শুধু তা-ই নয়, টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে উদীয়মান ফুটবলারের পুরস্কারও বগলদাবা করেছেন তিনি। বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিক্রিয়ায় এমবাপেরভাষ্য, ‘আমি আমার ও দলের সবার উচ্চাকাক্সক্ষা সবাইকে দেখাতে চেয়েছি এবং পেরেছি। তাই আমরা এখন বিশ্বসেরা। লম্বা একটা পথ ছিল। এই জীবনটাই আমরা চেয়েছি। ফ্রান্সের জনগণকে খুশি করতে পেরে আমরাও গর্বিত।’ এই বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে ছোটবেলার স্বপ্নপূরণ হয়েছে পল পোগবার। বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিক্রিয়ায় ফরাসী এই মিডফিল্ডার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বিশ্বকাপ জয়ের। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমার বিশ্বাস সবাইকে আমরা খুশি করতে পেরেছি। খেলার আগে আমি দলের সবাইকে বলেছিলাম স্বপ্নপূরণের থেকে মাত্র ৯০ মিনিট দূরত্বে আছি আমরা। ইতিহাসে নাম লেখাতে আমাদের ৯০ মিনিট খেলতে হবে। বাচ্চা থেকে বুড়ো ফ্রান্সের সবাইকে আনন্দিত করতে আমাদের এই ৯০ মিনিট নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে খেলতে হবে।’ স্বাধীনতা পাওয়ার সপ্তম বছরে বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালের টিকেট কেটে ফুটবল-বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। অবশ্য সেবার ফাইনাল খেলা হয়নি তাদের। তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। স্বাধীনতার ২৭তম বছরে আবারও ফুটবল-বিশ্বকে চমকে দিয়েছে এই ক্রোয়েশিয়া। এবার আর সেমিফাইনাল নয়, একেবারে ফাইনালেরই টিকেট কেটেছে ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বের দেশটি। স্বপ্ন ছিল ফাইনাল জিতেই তবে দেশে ফিরবে মডরিচ-মানদুকিচ-রাকিটিচরা। কিন্তু ফাইনালের মহারণে ফরাসী সৌরভের কাছে হার মানতে হয়েছে ক্রোয়াট যোদ্ধাদের। ফাইনাল শেষে তাই ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা যখন বাঁধভাঙা উল্লাসে মত্ত, তখন ক্রোয়েশিয়ার খেলোয়াড়দের চোখে নেমে এসেছিল রাজ্যের অন্ধকার। কেউ কেউ তো অশ্রুসিক্ত চোখে আবেগের দমকে মাঠেই শুয়ে পড়লেন। ফুটবলবোদ্ধাদের মতে, ফাইনাল ফ্রান্স জিতলেও হৃদয় জিতে নিয়েছে ক্রোয়েশিয়াই। দলটির অধিনায়ক লুকা মডরিচের কণ্ঠেও যেন সেই কথারই প্রতিচ্ছবি। দল হারলেও গোল্ডেন বল জেতা এই অধিনায়ক ফাইনাল শেষে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘দুঃখ প্রকাশ করছি না, আমাদের মাথা উঁচুতেই রয়েছে। ফাইনালে দুটি উদ্ভট গোলের কারণে জয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তবে এতে দুঃখ প্রকাশ করার কিছু নেই। বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে আমরা প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই সেরাটা দিয়েই এ পর্যন্ত এসেছি। আমাদের ছোট হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মাথা উঁচুতেই রয়েছে। আমরা বিশ্বকাপের মতো বড় আসরের রানার্সআপ। আমাদের দেশের জন্য এ অর্জন কম নয়। আমরা ভাল খেলেছি। শেষ পর্যন্ত এসেছি। যদি আমরা আসরের শুরুতেই বিদায় নিতাম তবে হয়তো দুঃখ পেতাম।’ বিশ্বকাপের মাত্র ৯ মাস আগে দলের দায়িত্ব নেয়া কোচ জ্লাতকো দালিচও জানালেন, দুঃখভারাক্রান্ত হলেও তার শিষ্যদের নিয়ে তিনি গর্বিত। দালিচের ভাষ্য, ‘আমরা বিশ্বকাপ জিততেই এসেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা লড়েছি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ভাগ্য ছিল না। আমরা দুটো সহজ গোল হজম করেছি। একটু আগে-পরে আত্মঘাতী গোল আর পেনাল্টি। বিশ্বকাপের ফাইনালের মতো ম্যাচে কখনোই আমাদের পেনাল্টির সুযোগ দেয়া উচিত হয়নি। ফ্রান্স সেটা ব্যবহার করেছে যথার্থই। আমরা পেনাল্টির পরই খেলা থেকে ছিটকে গেছি। ফাইনাল ম্যাচে চার গোল হজম করার পর আর সেটা জেতা যায় না। তবে যা হয়েছে তাতে দুঃখভারাক্রান্ত হলেও আমরা গর্বিত। ছেলেরা সবধরনের চেষ্টা করেছে।’ দলের তারকা মিডফিল্ডার ইভান রাকিটিচও মেনে নেন কোচের কথা। বার্সিলোনার এই মিডফিল্ডার বলেন, ‘আমরা হয়ত বলে বোঝাতে পারব না আমরা আসলে কত ভাল ফুটবল খেলেছি। তবে ছোট ছোট কিছু ভুল, যে কারণে ফ্রান্স আজ চ্যাম্পিয়ন।’ ফাইনাল হারের পর অবশ্য ক্রোয়াটরা পাশে পেয়েছেন তাদের প্রধানমন্ত্রী কলিনদা গ্রাবার কিতারোভিচকে। তিনি সব খেলোয়াড়কে আলিঙ্গন করে ফাইনাল হারের সান্ত¡না দেন।
×