ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

রশীদ হায়দারের জন্মদিন, শুভেচ্ছা

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৫ জুলাই ২০১৮

 রশীদ হায়দারের  জন্মদিন, শুভেচ্ছা

বছর ২৫ আগে, বয়স যখন ৫২, ‘ও বেলা এ বেলা’ শিরোনামে জীবনকথা লিখেছেন, ‘ভোরের কাগজ’-এ ধারাবাহিক, পরে গ্রন্থাকারে সচিত্র সন্ধানী থেকে প্রকাশিত (১৯৯৪)। ১২৫ পৃষ্ঠায় কথা কাহিনী শেষ। জীবন কী শেষ? এখনও দিব্যি বেঁচে বতে। তার মানে, জীবনের বাকি কথা আর নেই। ফুরিয়ে গিয়েছে কিংবা বলা ভালো, ‘সুখমস্তি যো বৈভূমা তৎ সুখম্।’ জন্ম তারিখ নিয়ে ধাঁধা আছে, জিজ্ঞেস করেছিলেন মাকে, ‘মা, আমার সঠিক জন্ম তারিখ কবে? মার জবাব : ‘তোর জন্মের সময় ফজলি আম ছিল।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল বিভাগে একজন অধ্যাপক ছিলেন, পার ঢাকাইয়া (কুট্টি)- সত্তর দশকের প্রথমার্ধের কথা বলছি। ছাত্রছাত্রীকে কোন প্রশ্ন করলে, সঠিক উত্তরে উল্টোপাল্টা হলে অম্লান বদনে বলতেন, ‘অ্যালায় বোজো’ (এখন বোঝো)। আমরা নিশ্চয় এমন কথা কবো না। গ্রন্থের ক্লাবে রশীদ হায়দার নিজেই জানাচ্ছেন তাঁর জন্ম তারিখ, সাল। ১৫ জুলাই ১৯৪১। মঙ্গলবার। গ্রাম : দোহারপাড়া। পোঃ থানা ও জেলা পাবনা। পিতা : মোহাম্মদ হাকিমউদ্দিন শেখ। মাতা : রহিমা খাতুন। ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। বংশপরিচয় বিশদ নয়। এমনকি নয় কতজন ভাইবোনের মধ্যে কত নম্বর। বোনরা অনুল্লেখিত (পরে অবশ্য, কাহিনীর বিস্তারে বলা আছে।) জানা আছে আমাদের, ৮ বোন। ভাইয়ের সংখ্যাও আট। তিনি পঞ্চম। শিবরাম চক্রবর্তীর একটি লেখায় পড়েছিলাম, হর্ষবর্ধন বলছেন, ‘পঞ্চম সন্তান পাঠশালার প-িত হয়, না হলে মন্দিরের পুরোহিত হয়। ভালো ভালো ভোগ খেয়ে অলস হয়, ভুঁড়ি বানায়। নাক ডেকে ঘুমায়।’ হর্ষবর্ধনের রসিকতা খুব ফ্যালনা নয়। কেন? পরে বলছি। বয়স্ক আত্মীয়কুলের মুখে শুনেছি, বলতেন (দুলাল যখন কিশোর। রশীদ হায়দারের ডাকনাম) : ‘দুলাল বড়ো হলি পাকা মোলবি হবি। হুজুর হবি। নাম করবি।’- কেন? ‘দুলাল খুব ভালো আজান দেয়।’ আজান দিলেই মৌলবি বা হুজুর হওয়া নিশ্চিত, এই বিধান কেন ফলেনি, অজানা। উল্টো, লেখক হয়েছেন। নাটক লিখেছেন। নাটকে অভিনয় করেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ, পাকবাহিনী, তথাকথিত মোল্লা, জামায়াত, ধর্মীয় নেতাদের কেচ্ছাকলাপ, ভ-ামির চিত্র এঁকেছেন বহু লেখায়। পরে রোষেও পড়েছেন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাবিরোধীদের। তোয়াক্কা করেননি। মাথা উঁচু করে এখনও বহাল তবিয়তে। আমাদের পারিবারিক ‘ব্যারাম’ পদ্য লেখা। অগ্রজ থেকে অনুজ। বাদ কেবল রশীদ। আমরা বলি ‘দাদুভাই।’ কারণ বোধ হয় এই, সবসময়ই দাদু-দাদু, মুরুব্বি ভাব। চপল, হালকা নন। স্বভাবত ভারিক্কি। লেখেন গদ্য। গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ। বাংলা নয়, শুরু করেছিলেন ইংরেজীতে, গল্প লেখা। মধুসূদন, বক্সিম বুঝেছিলেন ইংরেজী ভাষায় লিখে কল্কে পাওয়া যাবে না (বিশেষত ১৮ শতকে)। বাদ দেন। মাতৃভাষাই আসল। আপন। মাতৃভাষার পাঠকই স্বদেশি। স্বদেশে পাত্তা যদি পেতে হয়, পাঠকের হেঁসেলে ঢুকতে হয়, বটি-খুন্তি, ঘুটুনিই পয়লা। ‘পাছা পেড়ে শাড়ি,’ ‘বগা ফান্দে পড়িয়া কান্দে,’ ‘সাধের লাউ বানাইল মোরে ডুগডুগি,‘ ইত্যাদি, মাতৃভাষায় যে ব্যাঞ্জনা, মজা, পারিপার্শ্বিক চিত্র-সমাজ, ইংরেজী অনুবাদে অসম্ভব, মূল ইংরেজীতেও এই দ্যোতনা কল্পনাতীত। প্রত্যেক ভাষায় নিজস্ব, আঞ্চলিক, কুলিন ঐতিহ্য, আছে। পাবনার দোহারপাড়ায় বলি, ‘খাবু লয় তো মাহালু কি কামে (যদি না খাবি, মাখিয়েছিস কেন)। ইংরেজী ফরাসি জার্মান স্প্যানিশ যে ভাষাতেই অনুবাদ করুন, মজা, স্বাদ গল্প পাওয়া যাবে কী? মাটির গন্ধ থাকবে?- ভাগ্যিস, রশীদ ইংরেজী ভাষায় মকসো করেননি আর। আমরা সুখী। ভাগ্যবান। বলছিলুম একবার, আমাদের বংশের পূর্বাপর, উত্থান-পতন, ঘাত প্রতিঘাতের ক্রমিক কথামালা গাঁথুন উপন্যাসে। রাজি হন না ভেবে। পরে, ভেবে অরাজি। কারণ বুঝি। রবীন্দ্রনাথও পিছপা। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস লিখতে শুরু করেন ধারাবাহিক, পত্রিকায়। উপন্যাসে বংশ-পরিবার নানা কেচ্ছায় ক্রমশ জমজমাট, পরিবার থেকেই ঘোরতর আপত্তি। কুমুকে বন্ধনে রেখে, কেন ক্ষান্ত হন রবীন্দ্রনাথ, সহজেই অনুমেয়। মহৎ উপন্যাস থেকে আমরা বঞ্চিত। বাংলা সাহিত্যও। বাংলা উপন্যাসও। ‘কুমুর বন্ধন’ নামে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বইটি দেখিয়েছে লেখকেরও বন্ধন। কোথায় কীভাবে বন্ধন। কুমু উপলক্ষ। দাদুভাইকে (রশীদ) আরও একটি উপন্যাসের প্লট বলেছিলুম। মনে হয় ওঁর, ‘দারুণ।’ সপ্তাহখানেক পরে, টেলিফোনে, ‘মাছের কাঁটা পায়ে ফুটলো গোছের কথা, ‘আমার হাতে ব্যতা (ব্যথা)। আমার দারা (দ্বারা) হবি না নে। অত গবেষণা-টবেষণা করার ইচ্ছে নেই। ভাত খাবো আর ঘুমাবো। বললেন। আরও কথা, ‘তুই ল্যাক।’ বলি, উপন্যাস-গল্প লিখতে শিখিনি। গদ্য-পদ্যও নয়। বাংলাও অশুদ্ধ। লিখলে পাঠক ঠ্যাঙ্গাবে। বলেন, ‘আচ্ছা লিখিস নে।’ হর্ষবর্ধনের কথায় ফিরি। ভালো ভালো খেয়ে অলস হয়।’ অগ্রজ রশীদ কতটা ভেজাল খান, অজানা। খেয়ে ঘুমান, এইটুকু জানি। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখায় নির্ঘুম। আর্জেন্টিনার পরাজয়ে বিমর্ষ। স্ত্রী ঝরা (আনিসা) কে বলেন, ‘বারান্দা থেকে আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে এসো, চোকির নিচে রাখো। রাতুল-রায়া, সহন-সারন (নাতি-নাতনি) যেন না দ্যাখে।’ হেমা-ক্ষমা (কন্যাদ্বয়)র কথা, ‘আগামী বিশ্বকাপের জন্যে রেখে দাও।’- বেঁচে থাকলে রাখবেন হয়তো। আমরা জানি, অলস ৫ শ্রেণীর। অফিসের কাজকর্ম থেকে রিটায়ারের পরে, অলস কয়, ‘ওগো (বৌকে) গেঞ্জি খুলে দাও।’ - কোনো লেখকও কী এরকম? লেখক শিল্পীর অবসর আছে কি? ‘লেখকের অবসর? ছবি আঁকিয়ের অবসর?‘ না, নেই। ‘ছবি আঁকা থেকে অবসর নেবেন,’ গল্পকথায় বলছিলেন পিকাসো, ঝাঁঝালো কণ্ঠে জ্য ককঁতো, ধ্যেৎ। শিল্পীর অবসর নেই। লেখকের অবসর নেই। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ কাজ। অবসর নিতে দেবে না শিল্পীর দর্শক। লেখকের পাঠক। অবসর মানেই মৃত্যু। বার্ধক্য অজুহাত নয়। তুলি, কলম তারুণ্য, জীবন।’ - রশীদ হায়দার কী লেখা রিটায়ার্ড? ‘জীবনধারা’ শুকিয়ে গেছে? না। রশীদ হায়দার তাঁর জন্মদিনে, আরও বেশি উদ্দীপ্ত, জাগরুক, এমত বিশ্বাস অনুজের। বাবা-মায়ের আদরের, আত্মীয়কুলের, অনুজ অগ্রজ-অগ্রজার প্রিয়, পাঠকের নিবিড় হৃদয়স্পশী জন্মদিন মানব হৃদয়ের সংগঠন। -অনুজের শুভেচ্ছা, অগ্রজকে, জন্মদিনে। বার্লিন, ১৪ জুলাই ২০১৮
×