ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহিউদ্দীন কাদের

অর্থনীতির গতিপ্রবাহে প্রবাসী রেমিটেন্স

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ৮ জুলাই ২০১৮

অর্থনীতির গতিপ্রবাহে প্রবাসী রেমিটেন্স

বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও তার অর্থনীতির গতিপ্রবাহ দিন দিন বিশ্বকে হতবাক করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে কয়টি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তার একটি রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে বাংলাদেশ, এটা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। আর এই সমৃদ্ধির অর্থনীতি গড়তে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করছে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স। সরকারী হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বের ১৬২ দেশে আামদের প্রবাসী বাংলাদেশীরা রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৮৯ লাখেরও বেশি। তবে বেসরকারী হিসাবে এই সংখ্যা এক কোটি বিশ লাখের কিছু বেশি। প্রতি বছর লাখেরও বেশি বাংলাদেশী নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সেখানের ভিন্ন পরিবেশে কষ্টকর জীবনযাপনের মাধ্যমে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। শুধু এই নয়, বিদেশে নির্মাণ শিল্প থেকে শুরু“করে কৃষি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে দিন-রাত পরিশ্রম করে হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে তারা। আর এই রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে। প্রবাসে কর্মরত নাগরিকদের স্বদেশে প্রেরিত অর্থকে রেমিটেন্স বলে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার ক্ষেত্রে রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস হিসাবে কাজ করে। রেমিটেন্স আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ আয় বা জিডিপির ৩০ ভাগ। জাতীয় অর্থনীতির তাই অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিটেন্স। সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন ও বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা (্্ইউএনসিটিএডি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় যে হারে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২৭ সালের মধ্যে এদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। আর এজন্য প্রতিবেদনটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি কৃষি, রফতানি আয় এবং রেমিটেন্স প্রবাহের বর্তমান ধারা ধরে রাখার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জনসংখ্যা সমস্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রেও জনসংখ্যা রফতানির অভাবনীয় অবদান রয়েছে। বিশ্ব মন্দা এবং স্থানীয় নানা সমস্যা সত্ত্বেও অর্থনীতির যে সেক্টর নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি তা হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে স্বল্পসংখ্যক খাত অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তার মধ্যে জনশক্তি রফতানি সবার আগে উল্লেখযোগ্য। এখনও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পণ্য রফতানি খাত সবার শীর্ষে রয়েছে। তবে সার্বিক বিচারে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান তথা মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কারণ পণ্য রফতানি বাবদ যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানিতে চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রফতানি খাত এমনই এক অর্থনৈতিক খাত যার উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। একই সঙ্গে জনশক্তি রফতানি খাত দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা নিরসনের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখছে। এরা যদি বিদেশে কর্মসংস্থান না করতে পারত তাহলে দেশের বেকার সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করত। বিশ্ব শ্রমবাজারে আজ আমাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপিন্স এবং শ্রীলঙ্কা। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের দেশের তুলনায় বেশি দক্ষ, কর্মঠ এবং কাজে নিষ্ঠাবান। আর এ কারণেই জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো বাংলাদেশের বদলে উল্লেখিত দেশগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। এ জন্যই শ্রমবাজারে আমাদের পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সঙ্গে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে সরকারের শক্তিশালী ভূমিকাই জনশক্তি রফতানিখাতকে আরও গতিশীল করতে পারে। জনসংখ্যা রফতানি কিভাবে বাড়ানো যায়, বৈদেশিক কমসংস্থান মন্ত্রণালয়কে নতুন করে ভাবতে হবে এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, মেকানিক কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্ত ও কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তিকে কিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশি হারে রফতানি করা যায়, সেভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি বিদেশে জনসংখ্যা রফতানি বৃদ্ধি করতে না পারি, তাহলে জনসংখ্যা সমস্যার বিরূপ প্রভাব পড়বে আমাদের অর্থনীতিসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এ ছাড়া বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি সামান্য কয়েকটি দেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জনশক্তি রফতানি করা হয়। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, এবং সিঙ্গাপুরে জনশক্তি রফতানি করা হয়। অবশিষ্ট জনশক্তি রফতানি করা হয় অন্যান্য দেশে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি বাড়ানো গেলে এ খাতের আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানির সুযোগ রয়েছে। আগামীতে বিশেষ করে মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে লাখ লাখ শ্রমিকের দরকার হবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২৬ মিলিয়ন দক্ষ শ্রমশক্তির প্রয়োজন হবে। পশ্চিম ইউরোপে ৪৬ মিলিয়ন দক্ষ জনশক্তির আবশ্যকতা দেখা দেবে। বর্তমান বিশ্বে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট আন্তর্জাতিকমানের চাকরি করার যোগ্যতা রাখে। ফলে আগামীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষিত জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। সেই চাহিদা পূরণে এখনই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা রফতানি নিশ্চিত বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচিত। শুধু নিশ্চিত বিনিয়োগ নয়, নিরাপদ বিনিয়োগ হিসাবেও জনসংখ্যা রফতানিকে বিবেচনা করা যায়। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা রফতানির যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পারিশ্রমিক যাতে কাজ ও দক্ষতা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, সে জন্যও সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জনসংখ্যা রফতানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যদি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে, তাহলে জনসংখ্যা রফতানির সুফল ও রেমিটেন্স প্রবাহ আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক খাতের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হবে। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে রেমিটেন্স আয় আরও বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। বর্তমানে মোট উপার্জিত রেমিটেন্সের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও কোরিয়ার রেমিটেন্সের ২৩.৩০ শতাংশই হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে নানা ঝামেলা থাকায় প্রবাসীদের অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে তাদের টাকা দেশে প্রেরণ করছে। জনশক্তি রফতানি খাতটি এখনও বলতে গেলে পুরোপুরি বেসরকারী উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এতে বিদেশ গমনকারীদের যেমন বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে তেমনি নানাভাবে প্রতারিত হতে হচ্ছে। সরকারী উদ্যোগে বিদেশে জনশক্তি রফতানি করা গেলে এ সমস্যা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জনশক্তি রফতানি খাত ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে এক মহীরুহু। কিন্তু এ খাতের সম্ভাবনাকে এখনও পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অর্থ উপার্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি সমান তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে সেই অর্থের উৎপাদনমুখী ব্যবহার এবং তা নিশ্চিত করা। পরিকল্পিতভাবে জনশক্তি রফতানি খাতের সমস্যা সমাধান এবং পেশাজীবী ও দক্ষ জনশক্তি বিদেশে প্রেরণের পাশাপাশি তাদের পাঠানো অর্থ সঠিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা গেলে এ খাত দেশের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে দিতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা মাত্র ৮৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। রেমিটেন্স প্রবাহের মাস হিসেবে গত ছয় বছরের মধ্যে এটিই ছিল সর্বনিম্ন। শুধু সেপ্টেম্বরই নয়, বিগত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আশার বাণী হচ্ছে রেমিটেন্সের খরা ইতোমধ্যে কাটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, ২০১৮ সালে রেমিটেন্স খরা পুরোপুরি কেটে যাবে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক এই রেমিটেন্স বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধে অবৈধ মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। চলতি জুন (২০১৮) নাগাদ অর্থাৎ এই অর্থবছর শেষে রেমিটেন্স প্রবাহ এক হাজার ৫০০ কোটি বা ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ, বর্তমানে এর প্রবৃদ্ধি ভাল। অচিরেই প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের ওপরে থাকবে। বর্তমানে ডলারের দাম কিছুটা বেড়েছে। এর প্রভাবেও রেমিটেন্স বাড়ছে। ডলারের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক তার নিজের স্বার্থেই ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিটেন্স আনার চেষ্টা করছে। সে কারণেও রেমিটেন্স বাড়বে। এছাড়া, শ্রমশক্তি রফতানিও বেড়েছে। এরও একটা প্রভাব পড়বে ২০১৮ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা আগের বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম। তারপরেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্নমুখী উদ্যোগের কারণে গত অক্টোবর মাস থেকে এই রেমিটেন্স ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। অক্টোবর মাসে ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে। যা গত সেপ্টেম্বর মাসের চেয়ে ৩০ কোটি ৩০ লাখ ডলার বেশি। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের চেয়ে এটি ১৪ কোটি ৮১ লাখ ডলার বেশি। প্রবাসীরা গত নবেম্বর মাসে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১২১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। এর আগে অক্টোবরে পাঠিয়েছিলেন ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এই হিসাবে নবেম্বর মাসে বেড়েছে পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এদিকে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বরে) রেমিটেন্স আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এই পাঁচ মাসে দেশে ৫৭৬ কোটি ৮৫ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে জনগণও বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এরই প্রভাব পড়েছে সার্বিক রেমিটেন্সে।
×