ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

টিনেজদের সঙ্গে কেমন হবে আপনার ব্যবহার

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২ জুলাই ২০১৮

  টিনেজদের সঙ্গে কেমন হবে  আপনার  ব্যবহার

তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, কি কর তুমি সারাদিন? ভাল স্কুল, কোচিং, হাউস টিউটর- কিছুই তো বাদ রাখিনি, তারপরও তোমার পড়ায় মনোযোগ নেই। গানের ক্লাসেও যাও না। ছবি আঁকা তো মনে হয় ভুলেই গেছ। তোমার রফিক আঙ্কেলের ছেলে এবারও ক্লাসে প্রথম হয়েছে, আর তুমি দিন দিন গোল্লায় যাচ্ছ। আর রোকেয়া ভাবীর মেয়ে গান গেয়ে কত প্রাইজ পায়, তুমি কি করলে গান শিখে?’ কী? কথাগুলো খুব পরিচিত লাগছে? প্রিয় পাঠক, এই কথাগুলো জীবনে কোন না কোন পর্যায়ে হয় নিজে শুনেছেন অথবা পরিচিত কোন টিনেজকে শুনতে দেখেছেন। অবশ্যই অভিভাবক সন্তানের ভাল চান, কিন্তু তাঁদের চাওয়াটা যখন সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অথবা অভিভাবকের চাওয়াটা যখন সন্তানকে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করে, ঠিক তখনই হিতে-বিপরীত হয়। টিনেজার বলতে আমরা ১৩-১৯ বছরের বাচ্চাদের বুঝি। ৬-৭ ঘণ্টা একটা টিনেজার স্কুল/ কলেজে থাকছে এবং এখানে বিভিন্ন পরিবেশ-পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশছে। আবার এই বাচ্চাটিই যাচ্ছে গানের, নাচের, ছবি আঁকার অথবা ক্যারাটে ক্লাসে। এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার সন্তানটি কিছু না কিছু শিখছে। যাদের সঙ্গে মিশছে তাদের কাছ থেকেও কিছু না কিছু শিখছে। বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা যা শিখছে সব যে ভাল তা কিন্তু নয়, আবার সব যে খারাপ শিখছে তাও কিন্তু নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে সঠিক শিক্ষা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু সব বাচ্চা কিন্তু এক রকম নয়, কেউ হয়তো খুব সাবলীলভাবে সব উপদেশ গ্রহণ করছে ও কাজে লাগাচ্ছে। কেউ বা পারছে না, কারও বা ইচ্ছে করছে না করতে। কখনও কি ভেবে দেখেছেন কেন এমন হচ্ছে আপনার সন্তানটির সঙ্গে? কেন সে পরীক্ষায় খারাপ করছে অথবা আগে যেই কাজটি করতে ভালবাসত, আপনার সন্তানটি এখন কেন আর সেই কাজে আগ্রহ পাচ্ছে না? আদৌ কি কাছে বসিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছেন, কোথাও কি কোন সমস্যা হচ্ছে তার? হয়তো করেছেন উত্তর পাননি, হয়তো ভেবেছেন করবেন কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি জিজ্ঞেস করার। আমার আজকের লেখাটি সেইসব বাবা-মায়ের জন্য যারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, কিভাবে আপনার টিনেজ সন্তানের সঙ্গে দৃঢ় করবেন মানসিক সম্পর্ক। সাধারণত বয়ঃসন্ধির সময় হরমোন এবং শারীরিক পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তির ব্যবহারেও বেশ পরিবর্তন আসে। বয়ঃসন্ধির সময় যেসব শারীরিক পরিবর্তন ঘটে তাও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটায়। চলমান শারীরিক পরিপূরক প্রক্রিয়া শিশুদের চাহিদা, আগ্রহ এবং মেজাজ পরিবর্তন করার জন্য সরাসরি শরীর ও মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। চিন্তা করে দেখুন আপনার ছেলেটি, যার ত্বক ছিল কোমল, গলার স্বর ছিল স্বাভাবিক। হঠাৎ তার গলার স্বর হয়ে গিয়েছে ভারি, মুখে দাড়ি অথবা আসলো আরও কিছু শারীরিক পরিবর্তন। ঠিক তেমনি শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে আপনার মেয়ে সন্তানটিরও। যেই মেয়েটি আগে হয়তো খুব হই-হুল্লোড় করে বেড়াত, সেই মেয়েটি তার নিজের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। শারীরিক পরিবর্তনটি আপনি চোখে দেখছেন, মানসিক পরিবর্তন কি দেখতে পারছেন? আপনি হয়তো দেখছেন আপনার সন্তানটি হঠাৎ করে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছে, আপনার বেশিরভাগ কথাতে রিঅ্যাক্ট করছে, অনেক সময় মিথ্যা বলছে কিছু নিয়ে, লুকাচ্ছে কোন বিষয়, যেই বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আপনি বলছেন কম মিশতে তাদের সঙ্গেই বেশি মিশছে, তর্ক করছে কারণে অকারণে। একি বাড়িতে থেকে মানসিকভাবে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সন্তানের সঙ্গে। পরিবার এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আপনার সন্তানের সম্পর্ক নাটকীয় পরিবর্তন এবং বদল আপনাকে হয়ত ভাবাচ্ছে কিন্তু আপনিও হয়ত বুঝতে পারছেন না কি করবেন। আপনি হয়তো লক্ষ্য করবেন যে আপনার সন্তান তার পরিবারের সঙ্গে কম সময় ব্যয় করতে চায় এবং তার বন্ধু এবং সহকর্মীদের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে চায়। কিশোর বয়সে বাবা-মায়েদের এবং তাদের সন্তানদের মধ্যে কিছু দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক, কারণ শিশুরা তখন আরও স্বাধীনতা চায়। কিশোর বয়সে অতিরিক্ত মেজাজ দেখানোর অন্যতম একটি কারণ হলো যে, তাদের মস্তিষ্ক ও শারীরিক পরিপক্বতা। শিশুদের ২০ বছরের মধ্যে যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়, এই অসম্পূর্ণ মস্তিষ্কের উন্নয়নগুলো অনেক জ্ঞানীয় এবং মানসিক অস্পষ্টতার জন্য দায়ী। যার জন্য বাবা-মা সহজে হতাশ হতে পারেন। মাতাপিতাকে তাদের সন্তানদের এই অপ্রাপ্ত মস্তিষ্কের গঠন, ঘুম পরিবর্তন এবং পরিবর্তিত হরমোন এবং মানসিক ও জ্ঞানীয় অপরিচ্ছন্নতা বুঝতে হবে। আপনার হয়ত মনে হতে পারে যে আপনার সন্তান এখন আপনার থেকে ভিন্নভাবে কিছু দেখতে শিখছে। একটা ১৪/১৫ বছরের ছেলে বা মেয়ের কাছ থেকে আপনি কিন্তু পরিপূর্ণ বয়সের মানুষের ব্যবহার আশা করতে পারেন না। যে ছেলে/মেয়েটি নিজেই সন্দিহান তার পরিবর্তনগুলো নিয়ে, তার কাছ থেকে পরিপক্ব ব্যবহার আশা করাটা কি বোকামি না? পরিবার, মা-বাবা কিন্তু সন্তানের সবচেয়ে আস্থার জায়গা। এই কথাটি আপনার কিশোর বয়সের সন্তানের কাছে বোধগম্য হবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুধু কথায় না বরং কথায় এবং কাজের সংমিশ্রণে সন্তানকে বুঝান এই ব্যাপারটি। আপনার কিছু বন্ধু সুলভ আচরণই পারে আপনার প্রিয় সন্তানটির জীবনের এই কঠিন সময়টিকে সুন্দর করে তুলতে। আসুন দেখে নেই অভিভাবক হিসেবে, আপনার দিক থেকে কী কী করা উচিত। একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক তৈরি করুন সম্পর্কের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি আপনার কিশোর সন্তানকে আপনার কথা শুনাতে চান, তাহলে আপনাকেও কিন্তু তার কথা শোনার সময় ও ধৈর্য থাকতে হবে। আপনাকে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। একটি খোলা সম্পর্ক রাখুন সন্তানের সঙ্গে, যেখানে আপনারা একে অপরের সঙ্গে কিছু ভাগ করতে পারেন। যখন আপনি আপনার জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো আপনার কিশোর সন্তানের সঙ্গে ভাগ করেন, তখন আপনার সন্তান জানবে যে আপনি তাকে গুরুত্ব দেন এবং তার জীবনের বিষয়ে আপনার কাছে খোলাখুলি হতে পারে। সহানুভূতিশীল হন মনে রাখবেন, আপনিও কোন একসময় কিশোর ছিলেন। আপনার কিশোর আচরণের অনুভূতির অভাবনীয় ব্যাপারগুলো কল্পনা করুন এবং ভাবুন যে আপনার কিশোর সন্তানটি কেমন অনুভব করছে, তাদের দৃষ্টিকোণ বুঝতে চেষ্টা করুন। যখন আপনি সন্তানদের অনুভূতি প্রতিফলন করেন, তারা মনে করে যে তাদের অনুভূতি, ধারণা এবং মতামতকে স্বাধীনভাবে আপনি ভাগ করতে ইচ্ছুক। কিশোর সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন আপনি কি চান আপনার কিশোর সন্তান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোক এবং সেই শ্রদ্ধা হোক ভালবাসার। তাদের নিজে সম্মান করে এই বিষয়টি তাদের শেখান। শুধু ভয়, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, সব শখ পূরণের ব্যবস্থা- কখনো সম্মান এনে দিতে পারে না। সন্তানের ব্যক্তিত্ব, ধারণা, মতামত এবং আবেগ অনুভব করুন এবং সম্মান দিন। তাদের বন্ধুদের সামনে বা এমনকি প্রাইভেটে তাদের নিন্দা করবেন না এবং সবচেয?ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাদের মতামতকে তুচ্ছ বা সমালোচনা করবেন না যা তাদেরকে বয?স্কদের মতো অসুরক্ষিত করতে পারে। যখন আপনি আপনার সন্তানদের অসম্মান করে গুরুত্বের সঙ্গে নিবেন না, তারাও আপনার প্রতি একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করুন বেশিরভাগ কিশোররাই নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে পছন্দ করে এবং মনে করে কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তাদের জানা প্রয়োজন যে আপনি তাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক। তাদের যে কোন প্রয়োজনে আপনি পাশে আছেন বন্ধুর মতো। সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আপনি কখনও কঠোর হতে পারেন কিন্তু কঠোরতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সন্তান ভুল বুঝবে আপনাকে। আপনার অতিরিক্ত শৃঙ্খলা এবং কঠোরতা দেখে তারা বিশ্বাস করতে পারে যে আপনি শুধুমাত্র তাদের জন্য জীবনকে কঠিনই করতে চান। তাদের বলুন আপনি তাদের ভালবাসেন এবং জীবনে শৃঙ্খলা থাকা দরকার সবারই। পরিশেষে এটাই বলতে চাই, টিনেজ সন্তানদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে এবং অনুশীলনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তাদের যথেষ্ট সংখ্যক সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। আপনার টিনএজ সন্তানটির আচরণ এবং মেজাজ সম্পর্কে আপনার যদি উদ্বেগ থাকে, তাহলে তার সঙ্গে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট উদ্বেগ শনাক্ত করে এভাবে বলতে চেষ্টা করুন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি যে তুমি আসলে খুব বেশি সময় দিচ্ছ না পরিবারকে এবং যখন তোমার বন্ধুরা কল করে তখন অনেকক্ষণ কথা বলছ, কোন সমস্যা হলে আমাদের বলতে পার, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’ আপনার কিশোর সন্তানটি সম্ভবত এটি সম্পর্কে কথা বলতে চায় না, তবে তাকে পর্যাপ্ত সুযোগ এবং উত্তর দেওয়ার জন্য সময় দিন। সন্তানকে এটুকু আস্থা দিন যে আপনি সাহায্য করার জন্য আছেন এবং আপনারা একসঙ্গে অসুবিধাগুলো বের করতে পারেন। মানসিক টানাপড়েন বেশি হলে, অবশ্যই একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
×