শীতের হিমেল নিশিতে অপেক্ষা করতে করতে একরাশ ক্লান্তি আর বিরক্তিতে ছেঁয়ে যায় মেহেবুবের হৃদয় মন। এখানে চাইনিজ তো বহুবার ওরা খেয়েছে, দেখা করেছে, তবে আজ এত দেরি কেন মেহেরিমার। ওর মোবাইলটার সুইচ অফ। রেগে উঠে যাচ্ছিল মেহেবুব। ঠিক তখনই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো মেহেরিমা।
— এই কি পেয়েছ আমাকে বলতো?
মেহেরিমা ওর হাত ধরে বসিয়ে শান্ত গলায় বলল, এই সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গলার স্বর নিচে নামাও। আমার দিকে তাকাও, প্লিজ।
— কেন পরীর মতো পাখা গজিয়েছে নাকি তোমার? রাগত স্বরে বলল মেহেবুব। তারপর রেস্টুরেন্টের কোমল আলোতে মেহেরিমাকে দেখে বলল,
— এ কি তোমার জামদানি শাড়ি ছিঁড়ে গেছে বেশ খানিকটা। গলার কাছে কাটার দাগ, কি হয়েছে বলতো?
মেহেরিমার কিন্তু কোন উৎকণ্ঠা নেই। বরং রসিয়ে রসিয়ে বলল,
— এবার পায়ের দিকে তাকান স্যার।
মেহবুব এবার সত্যি সত্যি পায়ের দিকে তাকালো,
— আরে দু’পায়ে তো রাজ্যের মাটি। হালচাষ করতে গিয়েছিলে নাকি?
মেহেরিমা বুকের ওপর শাড়ির ছেঁড়া অংশটা সামলাতে সামলাতে বলল,
— তাহলে তো ভালই হতো, নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ছোট বেলায় পড়নি, ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা’। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আই স্যালুট দেম।
মেহবুব এবার একটু শান্ত হয়ে বলল, সব ঠিক আছে, এবার কী হয়েছে বলতো?
— আরে বলছি এত অধৈর্য হচ্ছো কেন ? মেহেরিমা উত্তর দিল।
— অধৈর্য হচ্ছি এ জন্যই যে দারুণ ক্ষিধে পেয়েছে, আগে পেট পুজো করে নেই। কী খাবে? মেহেরিমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মেহেবুব।
— তুমি যা খাওয়াবে। ওই সব চিকেন বল, ঝালকারী যা আছে তাড়াতাড়ি অর্ডার দাও।
ওয়েটার আগেই মেনুকার্ড টেবিলে রেখে গেছে। ইশারায় ওয়েটারকে ডেকে স্যুপসহ একগাদা খাবারের অর্ডার দিল মেহবুব।
-খাবার এলে মেহেরিমা তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করল। খাওয়া তো নয় যেন গোগ্রাসে গিলছে। যে ধস্তাধস্তি করে এসেছে, ভীষণ ক্ষুধা লেগে গেছে।
-আরে আস্তে আস্তে খাও। সবাই কী ভাবছে বলতো?
-খাবার সময় নো কথা।
-আচ্ছা বেশ।
কাঁটা চামচে ফ্রাইড চিকেনের টুকরাটা তুলতে তুলতে বলল মেহেরিমা, যে কষ্ট করে এসেছি কোন লেখক শুনলে একটা কবিতা বা গল্প লিখে ফেলবে।
-কেন, আমি যে বলেছিলাম মোড়ে গাড়ি নিয়ে আসি, তা তোমার ইগোতে লাগলো।
মেহেরিমার খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রসিয়ে রসিয়ে বলল, তোমাদের বড়লোকের ছেলেদের না ওই এক ফুটানি, কথায় কথায় গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক। আরে মোড় পর্যন্ত আসতে পারলে তো কথাই ছিল না।
— তাহলে? কৌতুহল আরও বেড়ে গেল মেহবুবের। আবার একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল, ঠিক সন্ধ্যার পর বেরিয়েছ বাড়ি থেকে?
-তাতে বুঝি পাকা রাস্তায় পায়ে কাদামাটিতে ভরে যায়? পাল্টা প্রশ্ন করে মেহেরিমা।
-নিশ্চয় ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। তোমাদের পাড়ায় মারামারি হয়েছে নিশ্চয়। তোমাকে কেউ এ্যাটাক করেনি তো?
এবারে সত্যি মেহেরিমার ফর্সা গাল রাগে লাল হয়ে গেল। দাঁড়াও দাঁড়াও, গুলশান বনানী ছাড়া কি ঢাকা শহরে লোক বাস করে না?
-না, না তা বলছি না। দেখ না কোথাও সিকিউরিটি নেই। পত্রিকার পাতা খুললেই তো দেখতে পাবে। আর মুºার ওদিকটাতে আরও বেশি।
-মোটেই না মেহেবুব। যখন তখন যেখানে সেখানেই ঘটতে পারে।
বিল মিটিয়ে দিয়ে ওরা যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো, জোড়া জোড়া চোখ মেহেরিমার দিকে তাকিয়ে। অবশ্য তার আগেই ওয়াশরুমে ঢুকে হাত-পা ভাল করে ধুয়ে নিয়েছে মেহেরিমা। পা ধুতে যেয়ে আর এক বিপত্তি, পায়ের দিকে শাড়ির অনেকটাই ভিজিয়ে ফেলেছে।
নিচে নেমে মেহেরিমা বলল, এবার আমি যাই।
— আরে যাবে মানে! এত রাত্রিতে তোমাকে একা ছাড়ব নাকি? তাছাড়া গলায় ছড়ে যাওয়া আর পায়ের ওই বেহাল অবস্থা কেন সে উত্তর তো এখনও পাইনি।
-আরে মোহাম্মদ রফির ওই গানটা শোননি, ‘ইয়ে একেলে চলা কি সওয়াল হ্যায়, আজিব পা’কি হাল হ্যায়।’
-এই থামতো। ইয়ার্কি মারার একটা সীমা আছে। গাড়িতে ওঠো।
-ঠিক আছে জনাব, উঠছি। এবার বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই জেনে যাবে কারণ। আমার কিছু বলতে হবে না।
-গাড়িতে এসি চলছে, বাইরে গাড়ির জ্যাম।
-মেহেরিমার হাতে হাত রেখে মেহেবুব বলল, এই তো আর কয়েকটা দিন। তারপরই তো প্রতীক্ষার শেষ। উহঃ, ড্যাডকে রাজি করাতে যা বেগ পেতে হয়েছে।
-আফটার অল অতবড় বিজনেস ম্যাগনেট! মেহেরিমা টিপ্পনি কাটলো।
এরই মধ্যে তারা প্রায় গন্তব্যে এসে গেছে। ড্রাইভার বলল, সামনের গলিতে গাড়ি যাবে না।
-এই যাবে না কেন? ধমকে উঠল মেহেবুব।
মেহেরিমা বলল, ওকে না ধমকিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখ। গাড়ি থেকে নেমে আসলো ওরা দুজনেই।
-ওহ মাই গড! এখন কী হবে? সারা রাস্তা দেখি মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রেখেছে।
গলির মাঝামাঝি জায়গায় মেহেরিমাদের বাসা। অতদূর যেতে হবে মেহেরিমাকে। এসেছেও ওখান থেকেই।
-একজন বৃদ্ধ বা অসুস্থ মানুষকে নিতে হলে বা আগুন লাগলে কী হবে। এ্যাম্বুলেন্সও আসতে পারবে না, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িও নয়। এটা কোন ধরনের সিদ্ধান্ত? এ দেশে কি মানুষ থাকে! রাগে গজ গজ করতে করতে বলল মেহেবুব।
-ওসব নীতিবাক্য এ দেশে অচল। এখন আমার হাত ধর, পরে কথা হবে।
মেহেরিমার হাত ধরলো মেহবুব। মোটা মোটা পাইপ তো আছেই। রাস্তার মাঝ দিয়ে বিশাল গর্ত করে দুপাশে পাহাড় সমান উঁচু, সারা রাস্তা জুড়ে মাটির ঢিবি। শুধু মাটিই নয়, পানি মিশে কাদায় একাকার জায়গায় জায়গায়। আর তার পাশ দিয়ে মানুষ হেঁটে চলছে ঝুঁকি নিয়ে। বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষদের পক্ষে হেঁটে চলা প্রায় অসম্ভব। শাড়ি পরা মহিলাদের জন্য হেঁটে যাওয়া আরও অস্বস্তিকর। নোংরা পানি, পাশে ফেলে রাখা পুরানো পাইপ, সব মিলিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এ কোন ধরনের আচরণ! অন্তত উচিত ছিল মাইকিং করে বা পত্রিকান্তরে এলাকার মানুষকে জানান যাতে তারা পরীক্ষার্থী বা রুগ্ন ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য নিরাপদ স্থানে পূর্বেই সরিয়ে নিতে পারে বা কাছাকাছি আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় নিতে পারে। আর এ দুর্ভোগের জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়া। এ যেন রবি বাবুর সেই কবিতার মতো, ‘হেরে রে রে রে, রাত দুপুরে ডাকাত এলো তেড়ে।’
জনগণের কথা কেউ ভাবে না, ভাবে না তাদের দুর্ভোগের কথা। ক্ষমতা দখল করা আর নিজেদের আখের গুছানোর কথা ছাড়া তারা আর কিছুই ভাবেন না। ভোটের সময় এলেই বড় বড় কথার ফুলঝুরি, স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য গড়ে দেবার প্রতিশ্রুতিতে ভাসিয়ে দেন। জনগণ এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করে না। কারণ তাদের বাঁচা-মরার লড়াইয়ে নেতাদের কিছু এসে যায় না। তবুও মানুষ এগিয়ে যায়, যেতেই হবে তাদের। বাঁচতে হবে তাদের, বাঁচাতে হবে দেশ ও মাটি। কারণ, এ মাটিতে তাদের জন্ম আর এ দেশ তাদেরই উত্তরাধিকার। উত্তরসূরিদের কাছে নিতে হবে এ দেশকে। সাধারণ জনগণের এ দেশ। তাই তারা সংগ্রাম করে, হেরে যায় না জীবন যুদ্ধে।
মেহেরিমার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়ে চলছে মেহেবুব। উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি। এ যেন ছোটখাটো পাহাড়ের চড়াই-উতরাই। মেহেবুব একটু ওপরে আর টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচে হেঁটে চলা মেহেরিমাকে। হঠাৎ হাত ফসকে মেহেরিমা পড়ে গেল মাটির ঢিবির ওপর আর মেহেবুব পাশের নর্দামাতে। কয়েকজন শ্রমিক যাচ্ছিলেন ওই পথ দিয়ে। তারা এ দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে মেহেবুবকে টেনে তুললো। ইতোমধ্যে মেহেরিমা নিজে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিকদের মধ্যে একজন মানুষ বলে উঠল, বড়লোক মানুষ, আমাদের মতো এ রকম রাস্তায় চলা অভ্যেস নেই। মেহেরিমা হাসবে না কাঁদবে। বিড়বিড় করে বলল, আলালের ঘরের দুলাল! মেহেরিমার কথা শুনে তেড়ে আসলো মেহেবুব।
— আপনারা আমাকে গাড়ি পর্যন্ত একটু দিয়ে আসবেন প্লিজ।
তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, সার কাদাপানিতে নাইয়া উঠিছেন, গাড়িতে কেমনে বসতেন? তার চাইতে আফার সঙ্গে যাইতে লাগেন। ভাল হইলে পরে গাড়িতে যাইবেন।
একেবারে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল লোকগুলো তাদেরকে।
মেহেরিমাদের একতলা বাসা। মেহেরিমার বাবা রিটায়ার করেছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে তার। মেহেরিমা ছোট। ছেলের বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক। এরই মধ্যে বাসা থেকে ফোন এসেছে, মেহেরিমা রিসিভ করেনি। ভেবেছে, একেবারে বাসায় যেয়ে বানিয়ে-ছানিয়ে কিছু বলবে। বাড়িতে ঢুকতেই সবাই চমকে উঠল, ভূত দেখছে না তো! বিয়ের দিনক্ষণ পর্যন্ত ধার্য হয়ে আছে আর হবু জামাইয়ের এ কী দশা!
— বৌমা দাঁড়িয়ে কী দেখছ? মিলনের কাপড়-চোপড় বের করে দাও আর তাড়াতাড়ি বাথরুমটা দেখিয়ে দাও। বলে মেহেরিমার মা মেহেরিমার বাবার দিকে তাকালেন।
—এমন মেয়েকে বের করে দাও বাড়ি থেকে।
মা বললেন, বিয়ের দিন-তারিখ তো ঠিক হয়েই আছে, দুটো দিন সহ্য হলো না।
মেহেরিমার ভাবি এগিয়ে এসে থামিয়ে দিলেন শ্বশুর-শাশুড়িকে।
— আহা থামুন তো মা। আপনাদের হবু জামাই চলে যাবার পর মেয়েকে শাসন করবেন।
পরের দিন মেহেবুবের খোঁজ নেবার জন্য ফোন করল মেহেরিমা। বেচারার জ্বর এসে গেছে। বিছানাতে শুয়ে আছে। আজ রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ।
ওপাশ থেকে মেহেবুব জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছো?
— ভাল।
মেহেবুব বলল, তুমি তো জানো ড্যাড এর কথা। পি জি পি। সব সময়ই তাই। এটা উনার ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য। উনার নির্দিষ্ট কোন দল নেই। বাবাকে এসব কিছু বলব না। কিন্তু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি আর কোন ভোটই দেব না। কাউকেই না। জাতীয় বা সিটি কর্পোরেশন বা কোনটার জন্যেই নয়।
— মেহেরিমা বলল, ফোনে এসব আলোচনা করা যায় না। তবুও বলছি ভোট আমরা নিশ্চয়ই দেব। তবে ভেবে-চিন্তে যার যার পছন্দমতো। যদি সুযোগ পাও, বুঝিয়ে দাও, জনগণ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে।
আর একমাসও নেই মেহেরিমার বিয়ের। রাস্তার এই বেহাল অবস্থা বেড়েই চলেছে। খোঁড়াখুঁড়ি আর খোঁড়াখুঁড়ি। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ, ভোগান্তির আর শেষ নেই। সিটি কর্পোরেশন তার খোঁজ রাখে কী। তাদের কি কোন দায়-দায়িত্ব নেই। সমস্ত কেনা-কাটার ভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মেহেরিমার বান্ধবী সামিরার ওপর। ওদের এলাকাতেও খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভোজবাজির মতো একমাসের মধ্যে রাস্তা ঠিক হয়ে গেছে। শুধু কার্পেটিং বাকি। মানুষ গাড়ি-ঘোড়া সবই চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ওই এলাকায় এক প্রভাবশালী নেতা বাস করেন যার ভাইয়ের বিয়ে অচিরেই। তিনি থ্রেট করেছেন, একমাসের মধ্যে রাস্তা ঠিক চাই। তা না হলে কীভাবে কন্ট্রাক্টরি করে দেখে নেব। কন্ট্রাক্টর সাহেবের ঘুম হারাম হয়ে গেছে এতেই।
মেহেরিমার পিতা ভেবেছিলেন বাসায়ই হলুদের অনুষ্ঠানটি করবেন, তাতে খরচ বেঁচে যাবে। কিন্তু এখন তা হবার নয়। হলুদের জন্য কোন রেস্টুরেন্ট অথবা কমিউনিটি সেন্টার খুঁজে বের করতে হবে আর তার দায়িত্ব পড়ল মেহেরিমারই ওপর। তবে নির্ধারিত বাজেটের মধ্যেই করতে হবে। সামিরাকে ফোন করে মেহেরিমা বের হলো সেন্টার খুঁজতে। গলি পার হয়ে মেহেরিমা দেখে সামিরা দাঁড়িয়ে আছে ওর কথামতো। একটা রিক্সা নিয়ে দুজন উঠে বসলো। লালমাটিয়া, ধানম-ি মোহাম্মদপুর যেখানেই পছন্দ হয়, বাজেটে কুলায় না। অবশেষে শ্যামলীর এক গলির মধ্যে এক সেন্টার খুঁজে পাওয়া গেল। সেন্টারটির নামই ‘গায়ে হলুদ’। বুকিং মানি জমা দিয়ে এক রকম খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরল মেহেরিমা। কিন্তু কে জানতো এক চরম বিপদ অপেক্ষা করছে তাদের গোটা পরিবারের জন্য।
ঢুকেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আব্বু দেখ, তুমি যে বাজেট দিয়েছিলে তার থেকেও আট হাজার টাকা কমে পেয়েছি। খুশি মজিদ সাহেবও, তিনিও ভাবতে পারেননি এত সহজে কম টাকার মধ্যে হলুদের জন্য সেন্টার পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফোন করলেন মেহেবুবের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মাহমুদ সাহেবকে। পেয়েও গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।
-হ্যালো, আস্্সালামু আলাইকুম। আমি মেহেরিমার বাবা মজিদ বলছি।
ওপাশ থেকে রাশভারি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, বলুন।
—আমাদের বাসার সামনে রাস্তার কথা তো শুনেছেন।
-হ্যাঁ শুনেছি। আমি তো আগেই বলেছিলাম বাইরে কোথাও ব্যবস্থা করেন।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো করেছি বেয়াই সাহেব।
-কোথায়? ওপাশ থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো।
-শ্যামলীতে। ওই সেন্টারটির নামই ‘গায়ে হলুদ’।
ভারি কণ্ঠে মাহমুদ সাহেব বললেন, দেখেন আমার সোসাইটির লোকজন তো আপনাদের স্ট্যান্ডার্ডের নয়। সোসাইটিতে আমার একটা সম্মান আছে। মেয়েকে আমার ঘরের বউ করতে চাইলে গুলশান বা বনানীর কোন নামী-দামী সেন্টারের ব্যবস্থা করেন। শুধু ছেলের জন্য রাজি হয়েছি। বুঝতে পেরেছেন তো?
মজিদ সাহেব কোন উত্তর দিতে পারলেন না। মোবাইল ফোনটি তার হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। আর তিনিও নিচে লুটিয়ে পড়লেন সংজ্ঞা হারিয়ে। খবর দেয়া হলো এ্যাম্বুলেন্স। এ্যাম্বুলেন্স তো বাড়ির সামনে আসতে পারবে না। মজিদ সাহেবদের মতো ছা-পোষা মানুষদের কথা কি কখনও ভেবেছে সিটি কর্পোরেশন! কেন আগাম নোটিস দেয়নি এখানে রাস্তার কাজ হবে? এখন এসব ভাববার কথা নয়। আশপাশে বাসার যুবক ছেলেরা এগিয়ে এলো, তারা সবাই মিলে ধরাধরি করে মজিদ সাহেবকে এ্যাম্বুলেন্সে তুলল।
হাসপাতালের ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, বারো ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। যথারীতি অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে, ইনজেকশনসহ অন্যান্য ওষুধও যথারীতি চলছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তাকে রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে মেহেরিমা মেহবুবকে জানিয়ে দিয়েছে মেহেবুবকে সে বিবাহ করবে না। কারণ মেহেরুমা আব্বুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে তখনকার ফোনালাপ শুনেছিল। খুব ভোরের দিকে জ্ঞান ফিরে এলো মজিদ সাহেবের। আপাতত বিপদ কেটে গেছে। দুপুরের পরে তাকে কেবিনে দিয়ে দেয়া হবে।
মেহেরিমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে ওর ভাই মিলনের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিল মেহেবুব।
কেবিনে মজিদ সাহেবের বিছানায় তার হাত ধরে বসে আছে একমাত্র আদরের কন্যা মেহেরিমা আর ভাবছে তার জন্যই তার বাবার এ অবস্থা।
— আব্বু আমি মেহেবুবকে জানিয়ে দিয়েছি আমি আর তাকে বিয়ে করব না।
— না, না, মা তা হয় না, ক্ষীণ গলায় বললেন মজিদ সাহেব।
এমন সময় দরজা খুলে মেহেবুব ঢুকল ঘরের ভিতর।
-তুমি কেন এখানে? চেঁচিয়ে উঠল মেহেরিমা। মজিদ সাহেব ইশারা করে থামিয়ে দিলেন মেহেরিমাকে। ইশারায় কাছে ডাকলেন মেহেবুবকে।
মেহেবুব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। নিজ থেকেই মজিদ সাহেবের মাথায় হাত রেখে বলল, আঙ্কেল আপনি কোন চিন্তা করবেন না। ড্যাডকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এ বিয়ে হবেই। আপনার সামর্থের বাইরে আপনি একটুও এগোবেন না। শুধু আপনার আশীর্বাদই চাই। মজিদ সাহেবের চোখের কোণে আনন্দাশ্রু। আলতো করে মেহেবুবের হাতে হাত রাখল মেহেরিমা।
শীর্ষ সংবাদ: