ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন জাহিদ হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ২০ জুন ২০১৮

সুমন জাহিদ হত্যা

একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র পুত্র ব্যাংকার ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ মামলার অন্যতম সাক্ষী সুমন জাহিদের দ্বিখন্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি যেমন দুঃখজনক তেমনি মর্মান্তিক। ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশ ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ এটাকে ‘ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু’ বলে জানালেও নিহতের পরিবার এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবি, সুমনের মৃত্যু একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। উল্লেখ্য, নিহত সুমন জাহিদ ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত ও ফাঁসিতে দন্ডপ্রাপ্ত একাত্তরের কুখ্যাত ঘাতক রাজাকার-আলবদর চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম সাক্ষী। এরপর থেকেই তাকে নানাভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। এ বিষয়ে পুলিশকে জানালে তাকে সাক্ষী সুরুক্ষা আইনে আদৌ কোন নিরাপত্তা না দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাফেরার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে। নিঃসন্দেহে এটি একটি হাস্যকর ও অযৌক্তিক পরামর্শ। সেক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত পলাতক আসামিরাই যে ক্ষুব্ধ হয়ে সুপরিকল্পিতভাবে সুমন জাহিদকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অতঃপর থানা পুলিশকে উদ্যোগী হয়ে এই হত্যাকান্ডের যথাযথ কারণ খুঁজে বের করে গ্রেফতার করতে হবে হত্যাকারীদের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও এক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলাও দায়ের করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এর আগে যুদ্ধাপরাধ মামলার আরেক সাক্ষী সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাইয়ের লাশও পাওয়া গিয়েছিল সড়কের ওপরে। সাক্ষী সুরক্ষা আইন ও যথাযথ নিরাপত্তার অভাবে এটিও একটি পরিকল্পিত হত্যাকা- ছিল বলে মনে করেন বিখ্যাত গায়ক-সুরকার বুলবুল। দেখা যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের ঘাতক রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে যে বা যারাই সাক্ষী দিয়েছেন তারা সবাই রয়েছেন সমূহ নিরাপত্তার ঝুঁকিতে। কয়েকদিন আগে মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক ও ব্লগারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে নির্মম-নৃশংসভাবে। নিহত শাহজাহান বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মুন্সীগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বিশাখা প্রকাশনীর মালিক। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চাসহ নিয়মিত যুক্তিসিদ্ধ লেখালেখির কারণে মৌলবাদীরা তাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে হত্যার হুমকি-ধমকি দিত। হত্যা মামলা ও পুলিশী তদন্তে বিষয়টি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হবে। অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রায় তিন বছর আগে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দীপনের অপরাধ তিনি মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করেছিলেন। এরপর একে একে ব্লগার নিলাদ্রি নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। এর অর্থ জঙ্গী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি অদ্যাবধি। অনেক ক্ষেত্রে এসব হত্যা মামলার চার্জশিট প্রদানে বিলম্বসহ ধীরগতির বিচারের অভিযোগ আছে। এসব হত্যাকান্ডের আগে-পরে দেশে আরও হত্যাকান্ড ও হামলার ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সঙ্গে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যেমন, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বিশিষ্ট লেখক অভিজিৎ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আখতারুজ্জামান প্রমুখ। এসব হামলা-মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হওয়া বাঞ্ছনীয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে উদ্যোগী ও তৎপর হতে হবে। পুলিশ-র‌্যাব-কাউন্টার টেররিজম ইউনিট-সোয়াটসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত নজরদারির ফলে জঙ্গী তৎপরতা কমে এসেছিল। কিন্তু আবার বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। জঙ্গীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে রাজধানীসহ সারাদেশে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলাসহ উত্তরায় দুই ভাইকে জঙ্গী সন্দেহে গ্রেফতারের খবর আছে। যে কোন মূল্যে এদের নির্মূল করতে হবে। আমরা লেখক ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু, সুমন জাহিদসহ সকল হত্যার তীব্র নিন্দা জানাই এবং তাদের পরিবার ও স্বজনদের জানাই সমবেদনা। পুলিশ এসব নির্মম হত্যাকান্ডের দ্রুত তদন্ত ও বিচার সম্পন্ন করবে বলেই প্রত্যাশা।
×