ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঈদের আবহ

প্রকাশিত: ০৭:৪১, ১০ জুন ২০১৮

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঈদের আবহ

ঈদ বাংলাদেশের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদ কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে আমাদের অর্থনীতি এবং তা শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়। গ্রামীণ জীবনেও এর প্রভাব পড়ে। গাঁয়ের খেটে খাওয়া কৃষক থেকে শুরু করে শ্রমিক, দিনমজুর, খেয়াঘাটের মাঝি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কিংবা সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী। প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকে ঈদ নানাভাবে রাঙিয়ে দেয়। আলো ঝলমলে দোকান, হাটবাজার, চায়ের দোকান, ফুটপাথ সবই নতুন করে সেজে ওঠে। মানুষের কলকাকলিতে সজিব হয় গাঁয়ের মেঠোপথ। ৬৪ জেলা, ৪৯১ উপজেলা আর ৮৭ হাজারের বেশি গ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ। বিভাগীয় শহর কিংবা সিটি কর্পোরেশনের মতো বড় শহরগুলো বাদ দিলে পুরো বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে একটি বড় গ্রাম। আর ঈদের মতো সার্বজনীন উৎসব ঘিরে গ্রামীণ জীবন আন্দোলিত হবে, এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। এর প্রমাণ মেলে ঈদের ছুটির দিনগুলোতে শহরের দিকে তাকালে। গোটা শহর ফাঁকা পড়ে থাকে। মানুষ নাড়ির টানে স্বজনদের সান্নিধ্যের আশায় ছুটে যায় গাঁয়ে। ঈদ কেন্দ্র করে গ্রামীণ সমাজে কি পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়, এর সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব নেই। এ নিয়ে বড় ধরনের কোন গবেষণাও নেই। তবে স্বাভাবিকভাবে ধারণা করা যায়, শহুরে অর্থের বড় অংশ চলে আসে পল্লী অঞ্চলে। তা যেমনি পণ্যে, তেমনি নগদে। এর উল্লেখযোগ্য ভাগ আসে সরকারী-বেসরকারী চাকরি থেকে। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে আসে প্রচুর অর্থ। আসে অন্যান্য চাকরি থেকেও। দেশে এমন গ্রাম খুব কমই আছে, যে গাঁয়ের দশ-বিশজন গার্মেন্টস কিংবা অন্য কোন সেক্টরে কর্মরত নেই। এবং এ সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। বৈদেশিক রেমিটেন্সও আজকাল বহু গাঁয়ের অন্যতম হয়ে উঠছে। এ সংখ্যাও ক্রমে উর্ধগামী। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকেও গ্রামাঞ্চলে প্রচুর অর্থ আসে। এমন প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা খাত থেকে অর্থ আসে। গাঁয়ের নিজস্ব আয়ও দিন দিন বাড়ছে। এক ফসলি জমি দিন দিন দুই-তিন ফসলি হয়ে উঠছে। বাড়ছে উৎপাদন। প্রতি হেক্টর জমিতে কয়েক বছর আগে যেখানে এক-দেড় টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, সেখানে এখন তা তিন টনে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে রবিশস্যের আবাদ। শাকসবজি চাষাবাদেও পিছিয়ে নেই। পরিত্যক্ত জমি শূন্যের কোঠায় চলে আসছে। মৎস্যচাষেও অসংখ্য গ্রাম রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গাঁয়ের সব খানেই ছড়িয়ে পড়েছে। গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। পোল্ট্রি এবং প্রাণী সম্পদেও গ্রামগুলো স্বনির্ভরতার সোপানে উঠে এসেছে। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে এসেছে পরিবর্তন। অর্থনৈতিক স্বচ্ছন্দের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের রুচিবোধ। উৎপাদনের ন্যায় অবকাঠামোগত যোগাযোগ ও বিদ্যুত ব্যবস্থা গ্রাম জীবনের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমন নানা কর্মকা-ে গ্রামগুলো ক্রমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। মানুষের হাতে নানাভাবে আসছে নগদ অর্থ। এবং সে অর্থের প্রবাহ ক্রমাগত উর্ধমুখী হচ্ছে। ফলে দুই-তিন-চার দশক কিংবা তারও আগের দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত গ্রামগুলোর চেহারা আর আগের মতো নেই। বিজলী বাতির চমকের মতোই পাল্টে যাচ্ছে গ্রামের মানুষ ও তাদের জীবন। এর সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া গ্রামগুলোকে যেন অদৃশ্য জাদুর কাঠির স্পর্শে রূপকথার রাজ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। এমন বাস্তবতায় ঈদ কেন্দ্র করে গ্রামজীবন নতুন সাজে সেজে উঠবে, এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। আর এর প্রতিফলন মেলে রোজা শুরুর প্রথম দিন থেকে। ঈদ অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে পোশাক। হোক তা শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ কিংবা হিজাব। জেলা-উপজেলা শহরের পোশাকের দোকানগুলোতে শুরু থেকে নামে মানুষের ঢল। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটা। ঈদ যত ঘনিয়ে আসে, তত বাড়ে মানুষের ভিড়। ঈদের শেষ তিন-চারদিন সারারাত ধরে চলে কেনাবেচা। ফ্যাশন সচেতনরা কেনাকাটার জন্য গাড়ি নিয়ে ছোটে বড় শহরে। বহু মানুষ রাজধানীতেও পৌঁছে যায়। অনলাইন শপিংয়ে গাঁয়ের মানুষও এখন আর পিছিয়ে নেই। কুরিয়ার সার্ভিসের বদৌলতে প্রত্যন্ত গাঁয়ে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে পছন্দের পোশাক থেকে শুরু করে নানা সামগ্রী। অনলাইনের সুবাদেই সর্বশেষ বাজারে আসা পোশাকের নামও তাই সবার মুখস্থ হয়ে ওঠে। এছাড়া, আজকাল অনেক প্রত্যন্ত গ্রামেও বড় বড় দোকান গড়ে উঠেছে। বাহারি পণ্যে সেসব দোকান ঈদে সেজে ওঠে অনন্য সাজে। পোশাকের পাশাপাশি ঈদের মার্কেটিংয়ে কি নেই গাঁয়ের মানুষের চাহিদার তালিকায়? কসমেটিকস, জুতা, মুদি-মনোহারি, ইলেক্ট্রনিক্স থেকে জুয়েলারি পর্যন্ত। সবই আছে। এমনকি বাড়ির গিন্নির সংসারের টুকিটাকি জিনিসও উঠে আসে কেনাকাটার তালিকায়। গত কয়েক বছরে ঈদের অর্থনীতিতে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে এসেছে, তা হচ্ছে ভ্রমণ। কক্সবাজার, কুয়াকাটা কিংবা উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় ট্যুরিস্ট স্পটে হয়ত সবার যাওয়া হয়ে উঠে না। তাই বলে গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর তীরে ছুটে যাওয়ায় মানুষের আদৌ কমতি নেই। অনেকেই দল বেঁধে ছোট্ট মফস্বল শহরে খোলা হুডের রিক্সায় বেরিয়ে পড়ে। ভ্রমণও তাই ঈদের অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে নতুন সংযোজন। পছন্দের মোবাইল সেট, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, টিভি, ফ্রিজ, মটর সাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য এখন গাঁয়ের মানুষ ঈদের কেনাকাটায় অগ্রাধীকার দিচ্ছে। এভাবেই গ্রামীণ অর্থনৈতিক জীবনে নানাভাবে ঈদের আবহ ছড়িয়ে পড়েছে।
×