ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

প্রযুক্তির উদ্ভাবনী গবেষণা ও আমাদের ভাবনার বিষয়

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

প্রযুক্তির উদ্ভাবনী গবেষণা ও আমাদের ভাবনার বিষয়

বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশে মোবাইল ফোনের অপারেটরগুলো দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষের সঙ্গে ব্যবসা করে; কিন্তু কোন গবেষণা কাজ করে না। এমনকি অন্যকে দিয়েও করায় না। কিসে ভোক্তা গ্রাহকের অধিকার নিশ্চিত হবে লাইসেন্সের আইনে তা দেখা স্বতঃসিদ্ধ হলেও এরা তার ধারে-কাছেও যায় না। মাঝপথে ফোন কেটে গেলে আইনে আছে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আর তা প্রকাশ্য হতে হবে। কত টাকা সে চার্জ করবে তাও প্রকাশ্য হবে। কিন্তু ইংরেজী ‘হিডেন কস্ট’ কথাটি আমাদের দেশে ব্যাপক চালু হয়েছে মোবাইল ফোনের গোপন চার্জের কা--কারখানা দেখেই। নেটওয়ার্ক ঠিকমতো না থাকলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে দেশের নিয়মের কাছে। কিন্তু ঢাকা শহরের ধানম-ি এলাকাতেই এ ঘর থেকে ওই ঘরে গেলে সেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। গ্রাম-গঞ্জের কথা বাদই দিলাম। আর কখন টাকা ফুরিয়ে যায় তার দিশা পেয়েছে এমন প্রি-পেইড মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা একজনও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশে মোবাইল ফোনের গবেষণা আয়োজন করেছে এই দেশেরই এক তরুণ উদ্ভাবক। সরকার তার স্বীকৃতি ও পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে জনগণের কাছে কম দামে সেবা পৌঁছে দিতে। অথচ এসবের বাহাদুরি নেয় মোবাইল কোম্পানিগুলো। এ দেশের মানুষ আবেগপ্রবণ, পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল। তাই বাড়িতে বা পাড়ায় একটা ফোন থাকা এক সময় ছিল অতি জরুরী এক আবেগের বিষয়। এককালের সোনার হরিণ টিএন্ডটির (এখন যেটা বিটিসিএল) পিএসটিএন বা ল্যান্ড ফোনের দুর্ভোগের কথা এখন প্রায় অতীত হয়ে গেলেও এর না পাওয়া যন্ত্রণার কথা এ দেশের মানুষ এখনও ভুলে যায়নি। আশির দশকের শেষের দিকে যখন দুনিয়াজুড়ে তারবিহীন মোবাইল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে থাকল, যখন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক শতাংশ মানুষ মাত্র মোবাইল ফোন ব্যবহার করত, তখন সে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশেরই এক তরুণ গবেষক ইকবাল কাদির চিন্তা করলেন কেমন করে নিজের দেশে মোবাইল ফোনের সেবা কম দামে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। ‘গণফোন’ নামে নিউইয়র্কে এক কোম্পানি গঠন করে বাংলাদেশে তার গবেষণা সেবা নিয়ে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন নানা দেশের বিনিয়োগ। তখন আমাদের দেশে সিমকার্ড ছাড়া (সিডিএমএ পদ্ধতির) একটি মোবাইল ফোন চলছিল, যার দাম ছিল আকাশছোঁয়া! ইকবাল কাদির ১৯৯৩ থেকে ৯৬ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে নানারকম গবেষণা ও প্রচেষ্টার পর দারিদ্র্য বিমোচনে প্রযুক্তি ব্যবহারের অঙ্গীকার নিয়ে দেশে একটি জিএসএম পদ্ধতির সর্বজন ব্যবহারযোগ্য মোবাইল ফোনের সেবা চালু করতে সক্ষম হন, যা ‘পল্লী ফোন’ নামে সেবা দিতে শুরু করে ও ‘গ্রামীণ ফোন’ নামে ৯৬ সালের নবেম্বরে লাইসেন্স পায়। ইকবাল কাদিরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রামীণ ফোনের লক্ষ্যে আকৃষ্ট হয়ে এর সেবায় তখন বিনিয়োগ করে জাপানের মারুবিনি কর্পোরেশন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ব্রিটেনের কমনওয়েলথ ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ, নরওয়ের টেলিকম কোম্পানি টেলিনর ও বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএফসি। লাল-সবুজের লোগো নিয়ে গ্রামীণ ফোনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে। শুরুতে ইকবাল কাদিরের যে উদ্যোগ তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘সংযোগ মানে উৎপাদনশীলতা।’ মাত্র ৫ বছরের মধ্যে গ্রামীণ ফোন দেশব্যাপী ব্যাপক বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয় ও ধীরে ধীরে টেলিনরের বিনিয়োগ কৌশলের ফাঁদে পড়ে তার সেই জনবান্ধবের মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ বাণিজ্যে মনোনিবেশ করে। বাংলাদেশের এই লাভজনক, জনপ্রিয়, জনবান্ধব কোম্পানির মূলধনের প্রধান যোগানদাতা হয়ে ওঠে টেলিনর। কালের নির্মম পরিহাসে টেলিনর গ্রামীণ ফোনের লাল-সবুজের লোগো পর্যন্ত পরিবর্তন করে নিজেদের লোগো বসিয়ে নেয়। দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ফোন তার বাণিজ্যিক মূল্য হারায়, যা রবি ঠাকুরের কবিতার কথাই মনে করিয়ে দেয়- সেদিন এ বঙ্গপ্রান্তে পণ্যবিপণীর এক ধারে নিঃশব্দচরণ আনিল বণিকলক্ষ্মী সুরঙ্গপথের অন্ধকারে রাজসিংহাসন। বঙ্গ তারে আপনার গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করি নিল চুপে চুপে- বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে। বাণিজ্যের পূর্ণ রাজদ- হাতে নিয়ে এখন গ্রামীণ ফোন (টেলিনর) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোনের অপারেটর, যার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি, বার্ষিক নিট মুনাফা দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে (২০১৬ সালের হিসাব মতে)। তিন হাজারেরও বেশি কর্মী এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ও প্রায় প্রতিবছর এদের অনেকে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়। মুনাফার লক্ষ্য অর্জন ছাড়া বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে সামান্য দু-একটি উদাহরণ ব্যতীত এই কোম্পানির কোন দায় নেই। এমনকি যে প্রযুক্তির ওপর ভর করে এই কোম্পানির ব্যবসা চলে তারও উন্নয়নে কোন দায় নেই। অথচ এই কোম্পানির ব্যবসা শুরু হয়েছিল গ্রামের মানুষকে লক্ষ্য করে। দারিদ্র্য বিমোচনে প্রযুক্তি ও ‘সংযোগের উৎপাদনশীলতার’ কথা বলে দুনিয়ার বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সে এই দেশে ব্যবসা চালু করে। কিন্তু বাণিজ্য স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্য পূরণের পর পরই গ্রামীণ ফোন তার সকল আদর্শ পরিত্যাগ করে শুধু নামটি এখন সে ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে। রবি ব্র্যান্ডে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানও এদেশের বিনিয়োগে চালু করেছিল একে খান কোম্পানি, মূলত টেলিকম মালয়েশিয়ার সঙ্গে। পরে তা মালয়েশিয়ার এক্সিয়াটা কোম্পানি আর জাপানের দোকোমো, কিছু অংশ ভারতের ভারতী মিলে কিনে নেয়। এরা বছরে যে পরিমাণ মুনাফা করে তার প্রযোজ্য করটুকু পর্যন্ত আমাদের সরকারকে দেয় না। কিছুদিন আগে ভ্যাট ফাঁকির দায়ে তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এলে তারা তা পরিশোধ করতে গড়িমসি করলেও আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত তা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। এদের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে গেছে ২০১৭ সালেই এবং দেশের প্রায় সকল প্রান্তে এদের সংযোগ আছে। পৃথিবীর অনেক দেশে টেলিফোন অপারেটররা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা দেয়। ফ্রান্সের এলকাটল লুসেন্টের গড়া ‘জেনেসিস’ ভারতের ব্যাঙ্গালুরু ও চেন্নাইতে গড়ে তুলেছে দুটি প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দুটিতে শুধু গবেষণা ও উন্নয়নের কাজেই নিয়মিত যুক্ত আছেন প্রায় চার শ কর্মী। এছাড়া সর্বজনবিদিত যে, ব্যাঙ্গালুরুর প্রায় ৪০ ভাগ প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলিকম কাজেই নিয়োজিত। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের টেকনোলজি পার্কে ও ভিয়েতনামের হো-চি-মিন শহরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে অপারেটরদের আর্থিক সহায়তায়। ২০১২ সালে নেয়া ভিয়েতনামের ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নের কৌশলপত্র’ বাস্তবায়নের বেশিরভাগ আর্থিক সহায়তা আসছে টেলিকম গবেষণার বিপরীতে। ব্রাজিলে এমন অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো নামীদামী অপারেটরদের সহায়তায় তৈরি হয়েছে। এই আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য বাংলাদেশে মুনাফা অর্জনকারী টেলিকম অপারেটররা কেন প্রযুক্তির উদ্ভাবনী গবেষণায় বিনিয়োগ করে না? এমনকি এদের নিজেদেরও কোন অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন গবেষণাগার নেই। মোবাইল ফোনে ব্যবহার করা যায় যেসব এ্যাপ তা সবই থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষের গড়া। কিন্তু আমরা আমাদের বুঝবার ভুলে তার কৃতিত্ব দেই মোবাইল ফোন সার্ভিসের, যা সঠিক নয়। যেমন ‘বিকাশ’ নামে আমাদের দেশে টাকা লেনদেনের যে কাজটি আমরা করছি তা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে করছি এটুকু ঠিক আছে; কিন্তু এখানে অপারেটর হিসেবে তাদের কোনই কৃতিত্ব নেই। যারা গবেষণা করে ‘বিকাশ’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন (গ্রামীণ ফোনের উদ্ভাবক ইকবাল কাদিরের ভাই কামাল কাদির এই উদ্ভাবনের অন্যতম অংশীদার) এর সকল কৃতিত্ব তাঁদের। এরকম হাজার উদাহরণ আছে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুঃখজনক এই কারণে যে, আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটররা শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছেন, নিজেদের উদ্ভাবনী সেবা বাড়াতে বা দেশের মেধা বিকাশে কোন গবেষণায় এরা সহায়তা দেন না। ঠিক সেরকম দেশে ইন্টারনেট সেবা সম্প্রসারণে মোবাইল ফোনের অপারেটরদের কৃতিত্ব দেয়াটা আমাদের ভুল হচ্ছে। এর সকল কৃতিত্ব সরকারের। কারণ সরকার দেশে ইন্টারনেট এনেছে ও নানা মাধ্যমে তা দেশের নানা প্রান্তে বিতরণের ব্যবস্থা করেছে। মোবাইল ফোন সেরকম একটি বিতরণ মাধ্যম মাত্র। সরকারের কাছ থেকে পাইকারি দরে বা সস্তায় এরা ইন্টারনেট কিনে নানারকম নামের প্যাকেজে মানুষের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছে ও বাহবা নিচ্ছে অথচ আমরা একবারও ভাবছি না সে সরকারের ইন্টারনেট বিতরণের কাজটি শুধু বাহক হিসেবে অনুমতি বা লাইসেন্স নিয়ে বিলি-বিক্রি করছে। সেখানেও নানা ফন্দি-ফিকির করে সে মানুষকে ঠকাচ্ছে। সে বিষয়ে অন্য লেখায় তুলে ধরা যাবে। এখন আমাদের দেশের প্রায় সব প্রান্তে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট পৌঁছেছে তা সরকারের সদিচ্ছার কারণেই। যে বিষয়গুলো সরকার এখন মনোযোগ দিতে পারে তা হলো গ্রাম পর্যায়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট নিয়ে যেতে এই কোম্পানিগুলোকে উদ্ভাবনী কাজে সাশ্রয়ী হতে বাধ্য করা। ফোর-জি একটি সমাধান হতে পারে যদি সরকার সব গ্রামে ইন্টারনেট হটস্পট করে দেয়ার কথা ভাবে। মাটি খুঁড়ে ব্রডব্যান্ড নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত গ্রামের তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য উচ্চ গতির ইন্টারনেট (আইটিইউর সংজ্ঞা অনুযায়ী ফোর-জি গতি যথাযথ পেলে যথেষ্ট) নিশ্চিত করা যেতে পারে। দরকার হবে জিএসএম ইন্টারনেট পেতে উপযোগী রাউটার, যা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিয়ে সেবা নিশ্চিত করবে। আর যা করা যেতে পারে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বসে সরকারই তাদের বুদ্ধি দিক (ব্যবসা-বাণিজ্যের লোকজন সাধারণত সরকার ছাড়া বাইরের কারও পরামর্শ শোনে না) এসব কোম্পানি যেন দেশে প্রযুক্তির উদ্ভাবনী গবেষণা কেন্দ্র্র্র তৈরি করে। স্থানীয় পর্যায়ে তরুণ উদ্ভাবকদের নিয়ে এরাই গড়ে তুলতে পারে নিজেদের জন্য প্রযুক্তি পরিষেবা বিভাগ, যা থেকে তারা বিদেশেও এ্যাপ রফতানি করতে পারবে। এরা যুক্ত হতে পারে দেশের উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সেবা উন্নয়ন গবেষণায়। যদিও এই প্রস্তাব পরামর্শ পেলেই এরা ফোঁস করে বলে উঠবে আমরা তো লাভ থেকে একটা অংশ এসব কাজের জন্যই বিটিআরসিকে দেই, আরও খরচ করব কেন? তার উত্তর সরকারকে অবশ্য দিতে হবে। কারণ, আমরা শুনেছি সেখানে হাজার কোটি টাকার ওপরে জমেছে, কিন্তু কিভাবে ব্যবহার হবে তার নীতিমালা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের অনেক ভাবতে হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প
×