ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মাসুদ হোসেন

নৈসর্গিক সিলেটে একদিন...

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২০ এপ্রিল ২০১৮

নৈসর্গিক সিলেটে একদিন...

প্রাত্যয়িক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আমরা পাঁচ ছয় বন্ধু প্রতি বছরই রোজার ঈদে পর্যটক হয়ে যেতাম। কিন্তু সিলেট বিভাগে আমাদের ভ্রমণটি সবচেয়ে আনন্দদায়ক হলেও সংখ্যায় ছিলাম আমরা মাত্র দুই বন্ধু। ক্লান্তিহীন এ ভ্রমণ ছিল পাহাড়ী ঝর্ণা, নদী আর গানের দেশের সবুজে ঘেরা চা বাগান। প্রকৃতি অপার হস্তে সাজিয়েছে সিলেটকে, নান্দনিক সৌন্দর্যের এক কল্পিত রাণী যেন সিলেট। মূল কথায় আসি- ভ্রমণের স্থান আগে থেকেই ঠিক করে রাখা, তারিখ ও সময়ানুযায়ী সেদিন আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় কেউ ধরে রাখতে পারেনি আমাদের। আমাদের মন আনন্দময় থাকলেও ভালো ছিল না আকাশের মন। সারা দিন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে সন্ধ্যায় তিন শ’ ষাট আউলিয়ার দেশ সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমি আর আমার বন্ধু আল-আমীন। সেও কিন্তু আমার মত একজন ভ্রমণ পিপাসু। চাঁদপুর থেকে সিলেটগামী ট্রেন না থাকায় সড়ক পথে চলে গেলাম লাকসাম জংশন রেলওয়ে ষ্টেশনে। প্লাটফর্মে দুই বন্ধুর অনেকক্ষন বসে থাকা। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্ত:নগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন ষ্টেশনে এসে পৌছালো রাত ১২টায়। ট্রেনটি স্পেশাল হওয়ায় পুরো ট্রেনে ছিলো অসংখ্য যাত্রী। বহু কষ্টে ট্রেনে উঠে সিট না পেয়ে প্রায় পাঁচ ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে আমাদের সামনের সিটে বসা যাত্রীরা তাদের গন্তব্যের ষ্টেশনে নেমে যাওয়ার পর আমাদের ঐ সিটে বসার সৌভাগ্য হলো। এর মধ্যে আমাদের ক্লান্তিময় চোখে নেমে আসে শান্তিময় ঘুম। যখন ভোর হচ্ছে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি রেললাইনের কোল ঘেষে দুই দিকেই পাহাড়ি টিলায় চা বাগানের সারি। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ। চা পাতার গন্ধ আমাদের নাকে এসে লাগছে। তার মাঝে আছে যুগ যুগ ধরে দাদী-নানীরা যা খেয়ে মুখ লাল করে এসেছেন তাদের প্রিয় খাবার ‘পান’। আর এই সারি সারি পান গাছের বাগান দেখে আমাদের মধ্যে নেমে আসে আনন্দঘন এক মুহূর্ত। সকাল ১১টায় আমরা প্রথম গন্তব্যের কাছাকাছি পৌছে যাই। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে দেখে হারিয়ে যাই অজানা এক স্বাপ্নিক গন্তব্যে। ট্রেন থেকে নেমে সিলেটের প্রানকেন্দ্র জিন্দাবাজারের উদ্দেশ্যে রিক্সায় চড়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সুরমা নদীর উপর ১৯৩৬ সালে নির্মীত ১১৫০ ফুট লম্বা আর ১৮ ফুট প্রস্থ ব্রিজে উঠার সময় কে যেন একজন রিক্সার পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে। প্রথমে ভয় পেলেও পরে বুঝতে পারলাম ব্রিজটি উচু হওয়াতে লোকটি এমন উপকারে আসলো। যাতে আমাদের কষ্ট করে রিক্সা থেকে নামতে না হয়। ব্রিজের মাঝখানে যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে আমাদের বলে ভাই ঠেলার ৫টাকা দেন। আমরা তো অবাক! একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছি আর মনে মনে হাসছি। কথা না বাড়িয়ে টাকাটা দিয়ে দিলাম। শহরে প্রবেশের মুহূর্তে সুরমা নদীর পাড়ের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে মনটা আনন্দের জোয়াড়ে ভেসে গেলো। তবে ক্রমান্বয়ে যা দেখতে পেলাম তা হলো সিলেটে একটা জিনিসের কোন অভাব নেই। হোটেল, এসি, নন-এসি, বিলাসবহুল, সাধারণ, অতিসাধারণ সব ধরনের হোটেলই আছে। কিন্তু এর কোনটিতেই উঠিনি আমরা। উঠেছি এক বড় আপুর বাসায়। বাসাটি ছিল শহরের কাছেই। বাসায় গিয়ে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। যদিও বিশ্রাম নেয়ার মতো মন মানসিকতা ছিল না। কারন কখন যে সিলেটের প্রাকৃতিক ও মনোরম দৃশ্যগুলোকে মনের ভেতর গেঁথে নেব। অবশষে সন্ধ্যার দিকেই আপুর ছেলে ইয়াছিনকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে বিমানবন্দর সম্পর্কে জানতে পারলাম, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি। রাতের আলোয় সিলেট সম্পর্কে ধারণা নিতে না পারলেও পরের দিন শুক্রবার সকালেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি। দিনের বেলায় শহরের রাস্তায় নেমে আবিষ্কার করি অন্যরকম কিছু। সিলেট সম্পর্কে এতদিন যা জানা ছিল তার থেকেও বেশী কিছু মনে হলো। গোছানো আর পরিচ্ছন্নতার জন্য সিলেট একটি অনন্য শহর। কিন্তু এতটা পরিপাটি আর মনোরম, না দেখলে অজানাই থাকতো। শাহজালাল ও শাহ্পরাণ (র:) এর মাজার জেয়ারত করে পুরো সিলেট শহরের বিনোদন স্পট, ঐতিহ্যবাহী স্থান, জাফলং ও সবুজে ঘেরা চা বাগানের দৃশ্যগুলো দর্শন করে ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে আসি। সবশেষে দুই বন্ধু অশ্রুঝরা নয়নে সিলেটকে বিদায় জানিয়ে চাঁদপুরগামী সততা-একতা বাসে উঠে বসলাম।
×