ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত নববর্ষ ॥ সামনে সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অতিক্রান্ত নববর্ষ ॥ সামনে সতর্কতা

এবারের নববর্ষের আগে আমরা যা দেখেছি তাতে শঙ্কামুক্ত থাকা সহজ ছিল না। কোটা আন্দোলনের নামে ‘আমি রাজাকর’ বুকে লিখে রাস্তায় নামা যুবকের ভেতর দিয়ে যে বার্তা তার পেছনে কারা সবাই জানেন। তাদের টার্গেটও একটাই। শেখ হাসিনা। সে জায়গাটা আমরা বুঝি। বুঝি জাতীয়তাবাদী আর জামায়াতীদের ষড়যন্ত্র। তার চেয়েও বেশি দেখলাম বামাতীদের বাড়াবাড়ি। এরা কোটা আন্দোলনের বিরুদ্ধে বা মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে একটি কথাও বলেনি। খারাপ লেগেছে এই কি সেই দেশ যার জন্য তিরিশ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন? প্রশ্ন করে আর লাভ নেই। এখন সময় কঠোর হওয়ার। সবাই জানি পিতা যদি তর্জনী উঁচিয়ে না শাসাতেন এদেশ স্বাধীন হতো না। তিনি যদি না বলতেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এই মাটি মুক্ত হতো না। আজ আমরা কত বিষয়ে কত কারণে এদেশের ইতিহাস ও অতীতকে অপমান করি। যে বিভ্রান্ত তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধকে ফসিল মনে করে, যাদের ধারণা অতীত ভুলে স্বাধীনতাবিরোধীও মুক্তিযুদ্ধের ককটেলে জাতীয়তাবাদীরাই সমাধান তাদের বলি, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধার বিরুদ্ধে কথা বলে আসমান ফাটাচ্ছে বাড়ি গিয়ে পা ধুতে গিয়ে দেখবে রক্ত পড়ছে। এই মাটি এই দেশ রক্তের দামে কেনা। সূচনা থেকে আজও যারা তা মানে না তারা নানা অজুহাতে প্রতিশোধ নিতে মাঠ নামে। কোমলমতি সন্তানদের যারা দিকভ্রান্ত করে, তাদের ন্যায্য দাবি বা মনের ইচ্ছাকে সহিংস করে নিজেদের আখের গোছাতে চায় তারা এদের সারারাত রাস্তায় রেখে নিজেরা বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘুমায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা গণভবনে ঘুমাতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী ও জননীর এই রূপ যাদের পছন্দ না, যাদের কথা শুনলে জীবনে জীবিকায় খেলায় সবকিছুতে বাঙালী দ্বাদশ ব্যক্তি থাকত পাঞ্জাবীদের বয় বেয়ারা কিংবা খানদের পিয়ন বড়জোর কেরানী হতো তাদের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা। শুনুন, আবুল মাল কিংবা মতিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করেননি। তাঁরা যুক্ত হয়েছেন। তাই তাঁদের সময় শেষ হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যার সময় ফুরোয়নি। ষড়যন্ত্র আর নীলনক্সার বিপরীতে শেখ হাসিনার অভিমান বা কঠোরতা যাই হোক সেটাই সময়োপযোগী। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও সাহসে এতটা পথ পার হওয়া বাংলাদেশ কোটার নামে মুখথুবড়ে পড়বে না। তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারে যে সাহস ও শক্তি মাঝে মাঝে তা জরুরী বৈকি। শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ। কাকে ধন্যবাদ দেব জানি না, প্রশাসন না মানুষ না হেফাজত? একদল পাহারা দিয়েছে, একদল রাস্তায় নেমে এসেছে আর একদল উৎসবকে ছোট করে এনেছে। সবাই মিলে বাংলা নববর্ষকে যে জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে তার ভবিষ্যত আসলে কোথায় কে জানে? বাংলা নববর্ষে জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়া খুব বেশি দিনের কথা নয়। এর আগেও ছিল, তবে এমন ঘটা করে পালিত হতো না। আমাদের ছেলেবেলায় চৈত্র সংক্রান্তি ছিল অনেক পদ দিয়ে রান্না করা ব্যঞ্জনের দিন। মা-খালারা বাবা বা অভিভাবকরা বাজার করে আসার পর পরই রন্ধনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। চৈত্র নিদাঘ গরমের মাস। এই ব্যঞ্জনের মূল পদগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন এর প্রচলন। যত তিতা যত শাক যত তরকারি তার বেশির ভাগই মূলত গরম সহায়ক। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলার মাটি ও ঐতিহ্য থেকে আহরিত শিবের গাজন। মুখোশের নাচ। আমরা দেখতাম বহুর পীরা এসব সাজে সেজে সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠোনে উঠোনে নেচে বেড়াতেন। ঢাকঢোল আর বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাদের নাচ ছিল উৎসবের প্রস্তুতি। ওই দিন হালখাতা লেখার প্রচলন ছিল দোকানে দোকানে। দোকানিরা জিলাপি বাতাসা রসগোল্লার মতো মিষ্টি মজুদ রাখতেন। যথাসম্ভব কাউকে ফিরাতেন না তারা। এখন সময় পাল্টে গেছে। চাইলেও আর আগের মতো সে সব নিয়ে মেতে ওঠা যাবে না। তাছাড়া সেই গাজন বা নাচের শরীরেও এসেছে পরিবর্তন। সেটা মানার পরও বিস্ময় মানি কি কারণে হঠাৎ করে আমিষ ইলিশ দখল করে নিল বৈশাখের মূল জায়গা। পান্তা ভাত আর ইলিশ সহযোগে বৈশাখ পালনের আজ যে সমারোহ তার সঙ্গে অতীত বা ঐতিহ্যের কোন মিল নেই। আমরা চিরকাল হুজুগে জাতি। যখন যেটা মাথায় ঢোকে সেটা নিয়েই মেতে উঠি আমরা। পান্তা ইলিশ এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে এটি না হলে নাকি পহেলা বৈশাখই হয় না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই পান্তা ইলিশ এখন দেশের বড় বড় হোটেল থেকে মেলার অনিবার্য অংশ। তার দাম তার চাহিদা তার সামাজিক স্ট্যাটাস এখন আকাশচুম্বী। আমি বিষয়টা নিয়ে বলছি এই কারণে আজকের বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে ঘটে চলেছে তার সবটাই প্রায় হুজুগ। চোখ মেলে দেখুন, বাংলাদেশের নারীরা কি আগের মতো আছেন? একাত্তরে যে দেশের জন্ম যে দেশের নারীরা খোলা চুলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিল আজ তাদের কি চেহারা? দেশের নারীকুলের মাথা দেখা যায় না আর। সেটা কি আসলে ধর্ম না কোন বিশ্বাস? না মরুর হাওয়া? এই হাওয়ায় তাদের কাঁধের এককালের মুক্তির বন্দুক আজ হয়ে গেছে জঙ্গির হাতিয়ার। চিরকাল জেনে আসা মায়ার দেশ মমতার সমাজে নারীরা ভবনের ভেতর থেকে আইনের সঙ্গে যুদ্ধ করে। লড়াই করে এদেশের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে। কেন? তারা এই কাল ইহকাল বা আজকের কিছুতে বিশ্বাস করে না। তাদের মগজে মস্তিষ্কে পরকাল। যার সঙ্গে ধর্মের আসলে কোন যোগ নেই। চিরকাল যে আলো আমাদের পথ দেখিয়েছে, যে ধর্ম আমাদের সাম্য ও মৈত্রীর বাণী শুনিয়ে মহান করে তুলেছিল এরা তাকে বিতর্কিত করে ফেলছে। এরা এদেশের পানি হাওয়া কিংবা সংস্কৃতি কিছুতেই তাদের বিশ্বাস নেই। নেই বলেই এরা আমাদের জাতীয় পতাকা গান ভাস্কর্য সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে চায়। যদি তাই হয় বা হতে থাকে তাহলে কিভাবে পহেলা বৈশাখ নিরাপদ থাকবে দেশে? পুরুষদের অন্তর আর বাইরে চলছে নিত্য দ্বন্দ্বের এক আশ্চর্য খেলা। তারা ভেতরে ভোগী বাইরে সুশীল। সামাজিক মাধ্যমের কীটরা খুব ভালভাবে জানে তারা এখানে কি করে? আজ দেশে যে পুরুষতন্ত্র দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সমাজ শাসন করে তাদের ভেতর বাঙালিয়ানা নেই বললেই চলে। হিল্লি দিল্লী ঘুরে বেড়ানো এদের সঙ্গে বাঙালিয়ানার সম্পর্ক এখন শূন্যের কোঠায়। চারিত্রিক বিশৃঙ্খলা বহুগামিতা আর বান্ধবীর নামে পরকীয়ার সমাজে একদিন সকালে নতুন পাঞ্জাবি বা পোশাক পরে ঘুরলেই বাঙালি হওয়া যায় না। তাও একবেলার জন্য। সকালের রোদ তেতে উঠতেই আমাদের আরেক চেহারা। সন্ধ্যা গড়াতে পানাহারে মত্ত আরেক বাঙালী জাতি আমরা। এই জাতি কি করে পহেলা বৈশাখের পতাকা বহন করবে? যে কারণে আজকের সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা পড়েছে চরম বিপাকে। কে না জানে বাংলাদেশে সব সময় খারাপ মানুষ ছিল এবং থাকবে। দুনিয়ার কোন দেশে তা নেই? উন্নত আধুনিক চরম উৎকর্ষে পৌঁছে যাওয়া সমাজেও খারাপ মানুষ আছে। যারা যৌনতা নিয়ে খেলে। নারীদের শরীর যাদের কাছে খেলার বিষয়। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢুকে পড়া বদমানুষেরা কোন পেশার কোন শ্রেণীর বা কাদের ইন্ধনে এরা এসব করে তা কম-বেশি সবাই জানে। কিন্তু ঠেকানো যায় না। কারণ, আমাদের ভেতরেই আছে তারা। এরা আমাদের ভেতর দিয়েই ঢুকে পড়ে। ধরা পড়লেও তাই বিচার হয় না। বিচার হলেও শাস্তি মেলে না। যাদের ওপর আমাদের গভীর বিশ্বাস যারা মুক্তিযুদ্ধ ও চেতনার ধারক তাদের আমলেও এরা নিরাপদ। এই ফাঁদে পড়া সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন তোপের মুখে। ভাবখানা এমন যেন নারীরা এই শোভাযাত্রা ছাড়া আর সব জায়গায় চরম নিরাপদে আছেন। বাসে-ট্রেনে, ঘরে-বাইরে অনিরাপদ নারীদের দিকে খেয়াল না রেখে কেবল শোভাযাত্রার ওপর এত আক্রোশের কারণ আসলে ভিন্ন। যেভাবেই হোক এতে এখন মুখোশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছে। মুখ ও মুখোশের সমাজে মুখোশ পরা মানুষ যে আসলে কারা সেটাই বোঝা দায়। ধরে নিলাম এটা সাময়িক। কিন্তু এভাবে চললে আর কি কি বিষয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে সেটা কি ভেবেছি আমরা? মূল ক্রোধ বা রাগের জায়গাটা কিন্তু পহেলা বৈশাখ। কারণ, এটি বাংলাদেশ ও বাঙালীর শক্তির উৎস। সে শক্তি কিভাবে কাজ করে সেটি আমরা আগে দেখেছি। এর প্রাণ যে সংস্কৃতি সেটাই অন্ধ মানুষদের রাগের কারণ। তারা আমাদের সংস্কৃতিকে ভয় পায়। তারা জানে এই শক্তি একবার জাগলে তাকে ঠেকানো যায় না এবং সেটাই এই জাতির মুক্তির উৎস। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব কি শুধু একদিন হৈচৈ করার জন্য? এক বেলা আনন্দ ফূর্তি করে বাড়ি চলে গেলেই এই উৎসব আমাদের পথ দেখাবে? নাকি আমাদের উচিত এর দেখভাল করা? এক সময় এই জাতি পহেলা বৈশাখের শক্তি ও সাহসে ভর করে বাঙালীকে মুক্ত করেছিল। পাকিস্তানের মতো দানবের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই জাতি আজ কৃশ আজ দোদুল্যমান। আজ তার ভেতরে বাইরে দুশমন। তার চিন্তা-চেতনা মাথায় ঢুকে আছে বিদেশী ভূত। পরজাতির কালচার। মূলত বাংলাদেশ ও বাঙালীকে পেছনে টেনে রাখার চক্রান্ত মুক্ত পহেলা বৈশাখ না পেলে একদিন এর শক্তিহীন বলহীন উদযাপনে মগ্ন জাতিকে দেখে করুণা করার বিকল্প থাকবে না। পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ আমাদের সেই শক্তির আধার যা চিরকালের। তাকে যেন হারিয়ে যেতে না দেই আমরা। [email protected]
×