ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইব্রাহিম আকবর ॥ অদম্য তারুণ্যের মুখ

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১০ এপ্রিল ২০১৮

ইব্রাহিম আকবর ॥ অদম্য তারুণ্যের মুখ

ডিপ্রজন্ম : ইব্রাহিম আকবর, কেমন আছেন। ইব্রাহিম আকবর : ধন্যবাদ ভাইয়া, ভাল আছি। আপনি.. ডিপ্রজন্ম : ভাল। আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটা.. ইব্রাহিম আকবর : লক্ষ্মীপুর জেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের ছেলে আমি। তিন বোন এক ভাই। দক্ষিণ চরমনসা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, ভবানীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় এবং লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজ। ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে (স্নাতক)। বর্তমানে সিইও ইশিখন.কম। ডিপ্রজন্ম : কম্পিউটারে হাতেখড়ি ও কোন মজার অভিজ্ঞতা। ইব্রাহিম আকবর : কম্পিউটারের সঙ্গে আমার পরিচয় একটু দেরিতে। এসএসসির পর। স্কুল শিক্ষকের কম্পিউটারের দোকানে আসা-যাওয়ার মাঝে শেখা। মজার অভিজ্ঞতা বলতে, সেটা ২০০৯ সাল, আমি লক্ষ্মীপুর সরকারী কলেজের ছাত্র। সে সময় কম্পিউটার সেলস এ্যান্ড হার্ডওয়্যার সলুশনের একটি শোরুম হয় লক্ষ্মীপুরে। আমি গিয়েছিলাম একটি ডিভিডি সফটওয়্যার কিনতে। দেখি এক ভদ্রলোক শোরুমের লোকজনের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে তর্কবিতর্ক করছেন। কথা শুনে বুঝলাম, ভদ্রলোক ৩ সপ্তাহ আগে তার কম্পিউটার ঠিক করতে দিয়েছেন কিন্তু এখনও ঠিক হয়নি। শোরুমের লোকজন বলছেন, ঢাকা থেকে উনাদের আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার এসে ঠিক করে দেবেন, সময় লাগবে আরও এক সপ্তাহ। ততদিনে হার্ডওয়্যার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়েছে আমার। ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি। উনাদের সেটা বলতে, প্রথমে ইতস্তত করলেও উপায় না দেখে রাজি হলো। কম্পিউটারে বড় কোন সমস্যা ছিল না, উইন্ডোজ পড়ে গিয়েছিল। আমি কানেকশনগুলো চেক করে র‌্যাম মুছে পুনরায় উইন্ডোজ দিয়ে দিলাম। কম্পিউটার ঠিক হয়ে গেল। ডিপ্রজন্ম : প্রথম উর্পাজন। ইব্রাহিম আকবর : যে ঘটনাটা বললাম মাত্র। কম্পিউটার ঠিক করে দেয়ায় ভদ্রলোক আমাকে খুশি হয়ে ২০০ টাকা দিয়েছিলেন আর শোরুম কর্তৃপক্ষ ৩০০। সেটাই আমার প্রথম উপার্জন। ডিপ্রজন্ম : কর্মজীবন শুরু... ইব্রাহিম আকবর : আবারও সেই শোরুমেই ফিরতে হয়। আমার কাজ দেখে ওরাই জব অফার করে, সেখানে কিছুদিন কাজ করা। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি, পড়াশোনার পাশাপাশি একটি আইটি কোম্পানিতে জব করেছি। ২০১২ সালে চাকরি ছেড়ে যুক্ত হই ফ্রিল্যান্সিং-এ। তখন ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে মানুষ সবেমাত্র জানতে শুরু করেছে। অল্প দিনেই ভাল উপার্জন করা শুরু করি। ডিপ্রজন্ম : ইশিখনের আইডিয়া যেভাবে এল? ইব্রাহিম আকবর : ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে কিছুটা পরিচিত হওয়ার পর, সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই ফ্রিল্যান্সিং শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তারা দেশের একেক প্রান্তে হওয়ায় সবাইকে কিভাবে একসঙ্গে অনলাইনে শেখানো যায়, সে বিষয়ে অনলাইন ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি, পথও পেয়ে যাই। ফলাফল আজকের ইশিখন। ডিপ্রজন্ম : আপনারা কী কী শেখান? কেমন সাড়া পাচ্ছেন। ইব্রাহিম আকবর : ইশিখন একটি ডিজিটাল স্কুল; এখানে একাডেমিক বিষয়সমূহ যেমন এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, বিসিএস এর বিষয় যেমন আছে তেমনি আছে ফ্রিল্যান্সিং, আইটি কোর্সসমূহ, কম্পিউটারের উপর শর্ট ও লং কোর্স। আমাদের ভিডিও কোর্স এবং অনলাইনে লাইভ ক্লাস দুটোই রয়েছে। ২০১৩ সালে এই উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন ইন্টারনেট সংযোগ এবং কম্পিউটার অতটা সহজলভ্য না হওয়ায়, তেমন সাড়া ছিল না। এছাড়াও ব্যবহার করতে হত থার্ড পার্টি সফ্টওয়্যার। আমাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে ইশিখন আসার পর ১০ থেকে ১২ গুণ শিক্ষার্থী বেড়ে যায়। খুব দ্রুতই সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠি। মাত্র ২ বছরের মাথায় বড় কোন ব্রান্ডিং ছাড়াও ইশিখনে প্রতিদিন ৫ লক্ষাধিক পেজ ভিউ হয় এবং ইশিখনে নিবন্ধনকৃত শিক্ষার্থী ৩০ হাজারের বেশি। ইশিখনে বর্তমানে অফিস ও অনলাইনসহ ৩২ জন কর্মচারী এবং ২০ জনের মতো শিক্ষক রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সাপোর্টের জন্য রয়েছে সুসজ্জিত কল সেন্টার। ফেসবুকে ৪ লাখ লাইক এবং বাংলাদেশের অনেক ব্র্যান্ড সাইটের চেয়েও র‌্যাংকিং এ এগিয়ে রয়েছে ইশিখন.কম। ডিপ্রজন্ম : নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সমস্যা, উত্তরণের উপায়, সম্ভাবনা। ইব্রাহিম আকবর : প্রথমেই বলব ভাল আইডিয়ার অভাব আর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি আইডিয়ার ওপর বিনিয়োগের সংস্কৃতি আমাদের এখানে এখনও সেভাবে চালু হয়নি। আজ যারা আমার ওপর লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে চান, শুরুতে সামান্য অর্থও তাদের কাছে চেয়ে পাইনি। এছাড়াও বেশিরভাগ উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান সীমাবদ্ধ। কেউ একজন একটা নিউজ সাইট কিংবা ইকমার্স সাইট বা এ্যাপ তৈরি করে প্রতিষ্ঠিত হলে, আমরা সবাই সেটার পেছনেই ছোটাছুটি করি। সৃজনশীল আইডিয়া খুব কম। আইডিয়া থাকলেও অনেকের মধ্যে এই ভীতি কাজ করে যে, আমি কিভাবে শুরু করব, কিভাবে স্পেসটা নিব। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন তার আইডিয়াটাকে পরিষ্কারভাবে অল্প কথায় উপস্থাপন। তিনি কি করতে চাচ্ছেন এবং সেটার মাধ্যমে বাস্তবিকভাবে মানুষ কিভাবে উপকৃত হবে, তার উপর সাজিয়ে গুছিয়ে কনটেন্ট কিংবা ভিডিও বানাতে পারেন। এরপর ধৈর্য সহকারে সৎভাবে কাজ করে যাওয়া। এক সময় ফলাফল আসা শুরু করবে। ডিপ্রজন্ম : এই খাতে সরকারের কাছ থেকে আর কোন সহায়তা বা ভূমিকা.. ইব্রাহিম আকবর : আসলে সরকার জানেন, এটাই একমাত্র উপায় বেকার সমস্যা দূর করার, এজন্য সরকার কিছু প্রজেক্টের মাধ্যমে চেষ্টাও করছেন। তার মধ্যে অন্যতম আর্নিং এ্যান্ড লার্নিং, বাড়ি বসে বড়লোকসহ আরও কিছু উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো সরকার যে গুটিকয়েক পরিচিত প্রতিষ্ঠানকে এই প্রশিক্ষণের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন, উনারাই সাধারণ মানুষকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণে বাধ্য করেছে। অদক্ষ, অপেশাদার প্রশিক্ষক আর ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে তাদের সঠিক ধারণা না থাকা। এর ফলে একদিকে যেসব তরুণ ফ্রিল্যান্সিং-এ উৎসাহিত হয়েছিল, তারা হয়েছে হতাশ। দ্বিতীয়ত; ভুল-ভাল ধারণা নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে ঢুকে, নিয়মনীতি ভঙ্গ করার কারণে অনেক মার্কেটপ্লেস বাংলাদেশের ব্যাপারে নীতিমালা কঠোর করে ফেলেছে। আমার মতে পোশাক শিল্পের পর যদি সম্ভাবনাময় কোন খাত থাকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের কিংবা বেকার সমস্যা দূর করার তা একমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি। তাই সরকারের উচিত সৎ এবং যোগ্য লোক এই সেক্টরে দিয়ে সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। এতে করে আমাদের জনসংখ্যা অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদে রূপান্তর হবে। ডিপ্রজন্ম : আপনার অনুপ্রেরণা, প্রিয় লেখক, বই, গান, অবসরে.. ইব্রাহিম আকবর : দেশে আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব জুমশেপার এর কায়সার আহমেদ এবং ড্যাফোডিল এর চেয়ারম্যান সবুর খান, অন্যরকম গ্রুপের মাহমুদুল হাসান সোহাগ। দেশের বাইরে খান একাডেমির সালমান খান, রানেস্কেপের এন্ড্রু গোয়ার, ডেভিয়ান আর্টের এঞ্জেলো সটিরা, মিনিক্লিপসের রবার্ট স্মল ইত্যাদি। বই পড়তে আমার ভাল লাগে, যদিও সবই সফটকপি, আমি বেশিরভাগ উদ্যোক্তাদের জন্য; স্টার্টআপ কোম্পানি আর মোটিভেশনাল বইগুলো পড়ি। এর মধ্যে অন্যতম ‘পাওয়ার অব ব্রোক বাই ডেমন্ড জন’, ‘ভেরি গুড লাইভস বাই জে.কে রাউলিং’, ‘ডিপ ওয়ার্ক বাই নিউপোর্ট’ ইত্যাদি। আর গানের মধ্যে স্লামডগ মিলিওনিয়ারের ‘জয় হো’, জাস্টিন বিবারের ‘নেভের সে নেভের’। আমার শখ হলো কোডিং এবং নতুন নতুন জিনিস শেখা। অবসর সময়ে কোড লিখি অথবা নতুন কিছু শিখি। ডিপ্রজন্ম : বর্তমান তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনার ভাবনা কি? আপনি কি মনে করেন, তারা সঠিক পথে আছে? ইব্রাহিম আকবর : আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গাইড করার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। আপনি যখন সবদিকেই জ্ঞান লাভ করতে যাবেন, তখন কোন দিকেই ভাল কিছু করা সম্ভব হবে না। তাছাড়া আমার মনে হয়, বেসিক পড়াশোনা (অন্তত এসএসসি) শেষ না করে কেউ প্রযুক্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় না আসাই ভাল। এসএসসি পর আমার কম্পিউটারে হাতে খড়ি, এর আগে জানতামও না যে মাউজ নাড়ালে মনিটরে কার্সর নড়ে। ২০১২ সালে ডিসেম্বরে আমার ফেসবুক আইডি খোলা। এই কথাগুলো এজন্য বলা যে, আমার এসএসসিতে এ+ কিংবা অষ্টম (২০০৬) শ্রেণীতে বৃত্তি সম্ভব হয়েছে, কারণ তখন আমি শুধু পড়াশোনা নিয়েই চিন্তা করতাম। পড়াশোনা ভালভাবে করার কারণেই পরবর্তীতে কম্পিউটার কিংবা অন্যান্য বিষয়গুলো আমি সহজেই বুঝতে পেরেছি। ডিপ্রজন্ম : আপনার আগামীর স্বপ্ন। ইব্রাহিম আকবর : দেশের বেকার সমস্যা দূর করা এবং শিক্ষাকে আধুনিকায়ন। আমাদের এক তৃতীয়াংশ তরুণ প্রজন্ম। একসময় এদেশের অশিক্ষিত কিংবা ঝড়ে পড়া নারীদের বোঝা মনে করা হতো। বর্তমানে তাদের জন্যই আমরা পোশাক রফতানিতে প্রথম। ঠিক তেমনি আমাদের বেকার তরুণদের যদি ফ্রিল্যান্সিং এ সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলেই আমরা দ্রুত বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাব। আরেকটি চাওয়া যানজট মুক্ত নগর। ডিপ্রজন্ম : ধন্যবাদ, আপনার জন্য শুভকামনা। ইব্রাহিম আকবর : আপনার এবং জনকণ্ঠের সবার জন্য শুভকামনা রইল, সবাই ভাল থাকবেন। ইব্রাহিম আকবরের সঙ্গে কথা শেষে বেরিয়ে আসছি, বাইরে নামছে সন্ধ্যা। আগামীদিন দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছে সূর্য। মন বলছে এই ইব্রাহিম আকবরদের মাঝ থেকেই আগামীতে পেয়ে যাব আমাদের জেফ বেজস, মার্ক জাকারবার্গ। আশায় বসত করি। [email protected]
×