ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিন মেশিন আসছে

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৭ এপ্রিল ২০১৮

 জিন মেশিন আসছে

লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বেসমেন্টে আছে ‘লন্ডন ডিএনএ ফাউন্ড্রি।’ ফাউন্ড্রি শব্দটা পাঠ করলেই মনশ্চক্ষে ভেসে উঠবে শিল্প-বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ের এক ধরনের কারখানার দৃশ্য, যেখানে তরল ধাতব পদার্থ ছাঁচের মধ্যে ঢালা হচ্ছে। লন্ডন ডিএনএ ফাউন্ড্রি অবশ্য তা থেকে একেবারেই আলাদা ও আধুনিক। সেখানেও তরল পদার্থ আনা-নেয়া করা হচ্ছে না বা ঢালা হচ্ছে না তা নয়। তবে একেবারেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণে। আর এই তরল পদার্থ ধাতব নয়। বরং তা হলো প্রাণের জিনেটিক ফোড বা বংশগতির সঙ্কেতগুলোর জলীয় রূপ। এ ধরনের ল্যাবরেটরি কেম্ব্রিজের ব্রড ইনস্টিটিউট, ম্যাসাচুসেটস, সিলিকন ভ্যালি হয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিশ্বের সব জায়গায় স্থাপন করা হচ্ছে। সব ল্যাবরেটরির মূল কাজটা হলো জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ। বায়োটেকনোলজি কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব ল্যাবরেটরি আর কিনতে ও চালাতে হবে না। তার পরিবর্তে এই ফাউন্ড্রিগুলোই তাদের সে কাজ করে দেবে। লন্ডন ডিএনএ ফাউন্ড্রি অপারেশন রুম নানা রকম বাক্সের মতো যন্ত্রে পূর্ণ। প্রতিটি এক একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য উদ্ভাবিত। যেমন বার বার ও দ্রুত ঢালা। একটি রোবোটিক বালু মেশিনগুলোর মধ্যে ছোট ছোট প্লাস্টিকের ডিশ আনা-নেয়া করে। প্রতিটি ডিশের মধ্যে আছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ১৫৩৬টি কূপ এবং প্রতিটি বেশ কয়েক মাইক্রোলিটার তরল পদার্থ ও কয়েক গুচ্ছ ডিএনএ। এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ফাউন্ড্রিটি প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট ঘনীভবনে এক সকালে দেড় লাখ ডিএনএর মিশ্রণ ঘটাতে পারে। এই প্রক্রিয়া যাত্রাবিন্দু হলো ফাউন্ড্রির হেড অব অটোমেশন ডেভিড ম্যাকক্লাইমন্টের একটি লাইব্রেরি যেটাকে তিনি পার্টস নামে বলে থাকেন। এগুলো হচ্ছে জিনেটিক কোডের ছোট ছোট কাটা টুকরো সেখান থেকে বিভিন্ন জিনেটিক সার্কিট সংযোজন করা যায়। বায়োটেকের ভাষায় বলতে গেলে একটা সার্কিট হলো জিনসমূহের সংগ্রহ যা অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একত্রে কাজ করে। যেমন বেশ কয়েক ধরনের এনজাইম সৃষ্টি করা যা একটি নির্দিষ্ট ধরনের রাসায়নিক উপাদানকে আরেক রাসায়নিক উপাদানে রূপান্তরিত করে। একটি সম্ভাবনাময় সার্কিট যেসব জিনের সমন্বয়ে গঠিত সেগুলো তখন একটি বৃত্তাকার ডিএনএ মলিকুলে সংযোজিত হয় সেগুলোকে বলা হয় প্লাসমিড। যথোপযুক্ত প্লাসমিড লাভ করার জন্য ফাউন্ড্রির গ্রাহকরা লাইব্রেরি থেকে স্রেফ পার্টসের অর্ডার দিতে পারেনি। তারা তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন স্লাইপেটও লাগাতে পারেন। দরকারি সব অংশ তখন ডিশগুলোর বার কোড দেয়া কূপগুলোতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেগুলোর কনটেন্ট আপনা আপনি মিশ্রিত হয়ে যায়। গোটা প্রক্রিয়া গ্রাহকের দেয়া কম্পিউটার কোডের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ওই কোডেই গবেষণার সবকিছু বর্ণনা করা হয়ে থাকে। মিশ্রণটা সঠিক হলে টেস্ট প্লেটগুলো নিমিষের মধ্যে একটা মেশিনের ভেতর নেয়া হয় যেখানে পলিমারেস চেন রিএ্যাকশন বা পিসিআর নামক একটি প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি কূপের প্লাসমিডের সংখ্যা বহুগুণ বাড়ানো হয় এবং তারপর পিসিআরের কাজ হয়ে গেলে প্লাসমিডগুলো জীবন্ত কোষে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেই জীবন্ত কোষ হয় ব্যাকটেরিয়া অথবা ঈস্ট। এরপর কোষগুলো ইনকিউবেট করা হয় এবং ফলাফল পরীক্ষা করে দেখা হয় যে সার্কিটগুলোর কোন একটি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে পেরেছে কি পারেনি। লন্ডন ডিএনএ ফাউন্ড্রির পরিসর এমন যে এটি একদিনে প্রায় ১৫ হাজার ভিন্ন ভিন্ন জিনেটিক ডিজাইন তৈরি ও পরীক্ষা করা হয়। নামের যথার্থতা রক্ষা করে ফাউন্ড্রিটি শুধু ডিএনএ প্লাসমিড তৈরি ও পরীক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছে। অন্যান্য কিছু বায়োফাউন্ড্রি অবশ্য আরও নানা ধরনের সার্ভিস যুগিয়ে থাকে। যেমন ধরুন ট্রান্সক্রিপটিক নামক সিলিকন ভ্যালির একটি ফার্ম। এটিও গ্রাহকদের পরবর্তীকালে পরীক্ষা করে দেখার জন্য সমস্ত কোষ বা সেল লাইন সংরক্ষণ করার কিংবা পরীক্ষা করে দেখার জন্য সেগুলো থেকে টিস্যু জন্মানোর সুযোগ দিয়ে থাকে। ট্রান্সক্রিটিকের অন্যতম সুনির্দিষ্ট বিশেষত্ব হলো ওষুধের প্রাক ক্লিনিক্যাল স্ক্রিনিং। এতে বিপুল সংখ্যক যৌগ উপাদান পরীক্ষা করে দেখা হয় যেগুলো শেষ অবধি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, একটি ওষুধের হয়ত উদ্দেশ্য হলো এমন একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনের কাজকে বদলে দেয়া সেটি কোষের ভেতরে ক্যালসিয়াম আনা-নেয়া করে। সেক্ষেত্রে ওই ওষুধটিকে স্ক্রিনিং করে দেখা যেতে পার যে প্রোটিনটি এক্ষেত্রে তার কাজটি ঠিকমতো করতে পারছে কিনা ট্রান্সক্রিপটিকের বেশিরভাগ গ্রাহক ছোট আকারের নবগঠিত ফার্ম যাদের নিজস্ব পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলার সামর্থ্য নেই। এমনি একটি ফার্ম হলো প্লায়ান্ট থেরাপিউটিক্স। এটাও সিলিকন ভ্যালির। এটি ফাইব্রেটিক রোগ অর্থাৎ ফুসফুস ও হার্টের মতো স্থানে স্কার টিস্যু গঠনের চিকিৎসার ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য ট্রান্সক্রিপটিকে কাজে লাগাচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠিত ফার্মগুলোও ট্রান্সক্রিপটিকের সুুযোগ-সুবিধাগুলোকে ব্যবহার করছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানে এসব পরীক্ষা চালানোর চাইতে ট্রান্সক্রিপটিকের মতো ফাউন্ড্রিতে সে কাজটি করা অনেক সময় সস্তা হয়ে যায়। এ মুহূর্তে ডিএনএ ফাউন্ড্রি শিল্প তার পা রাখার জায়গা খুঁজে পাওয়ার পর প্রতিটি ফাউন্ড্রি তার নিজস্ব পথে চলছে। তবে লন্ডন ডিএনএ ফাউন্ড্রির ডিরেক্টর পল ফ্রিমন্ট আশা করেন যে কোন্ প্রক্রিয়াগুলো গ্রাহকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হবে একবার এটা পরিষ্কার হয়ে গেলে বায়োফাউন্ড্রিগুলোর মধ্যে এক ধরনের শিল্পসম্মত মান গড়ে উঠবে। তাহলে প্রাণের নতুন সিনথেটিক রূপের পরিকল্পনার প্রক্রিয়া করা সহজতর হবে। তখন এই শিল্প একটা বৈশ্বিক শিল্পের মতে হয়ে দাঁড়াবে। সেই দিনই এখনও আসেনি। তবে চাহিদা থাকলে বায়োফাউন্ড্রিগুলো শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে নিশ্চয়ই তাদের ভূমিকা পালন করবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×