ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এক অসহায় নারীর জীবন লড়াই

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৬ এপ্রিল ২০১৮

এক অসহায় নারীর জীবন লড়াই

স্বামীও অক্ষরজ্ঞানহীন। আর তাই শিক্ষার ব্যাপারটি তার কাছে গুরুত্বহীন। বিয়ের পাঁচ বছর পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম। আবারও অকাল মাতৃত্বের রোষানলে পড়া। সাংসারিক কাজকর্ম তো করতেই হতো, ক্ষেতে খামারেও স্বামীর সঙ্গে কাজ করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। আবার পুত্র সন্তানের দায়-দায়িত্বও তাকে একাই সামলাতে হয়েছেরেনুকা যে ইতোমধ্যে রীনা নামে পরিচিত। রংপুরের এক সময়ের মঙ্গা অঞ্চলের রীনার জীবন এক সংগ্রামী অভিযাত্রার করুণ আখ্যান। হতদরিদ্র পিতার সন্তান রীনা মাত্র ১১ বছর বয়সে বাল্যবিয়ের সামাজিক অভিশাপে জর্জরিত। শ্বশুরালয়ে ও দীনতার চিত্র। স্বামী ক্ষেতমজুর। অন্যের জমিতে বর্গা খাটা প্রান্তিক চাষী। ফলে বালিকা বয়স থেকে রীনাকে প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তার কাছ থেকেই জানা যায় মাটি কাটা থেকে ধানের বীজ বপন শুধু নয় শস্য ঘরে তোলা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রমের অংশীদার হতে হয় তাকে। অল্প বয়স, কাজের ভারে ক্লান্ত হলেও রক্ষা নেই। না বাপের বাড়ি, না স্বামীর ঘরে। এক পরিসংখ্যানে উঠে আসে মেয়েরা নাকি প্রথম নির্যাতিত হয় তার মায়ের কাছ থেকেই। মায়ের সঙ্গে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে এতই বৈষম্য যা কোন কন্যা সন্তানকে সেই প্রচলিত নিয়মে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে নিজের মায়ের ব্যাপারে মেয়েদের কোন অভিযোগ কিংবা ওজর আপত্তিও থাকে না। কিন্তু বিয়ের পর যখন অন্যের বাড়িতে চলে যায় সে সময় সব ধরনের বঞ্চনা প্রকটভাবে ধরা দেয়। শিক্ষা নামক অতি আবশ্যিক অধিকার থেকে বঞ্চিত বালিকা ভাবতেও পারে না কতখানি অসহায় অবস্থায় তার পুরো জীবন দুর্যোগের আবর্তে পড়ছে। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর নজির ঘরে ঘরে। রীনাও সেই চলে আসা সামাজিক অপশাসনে নিজের বিপন্ন জীবনের ঘানি টানতে থাকে। শিক্ষার ব্যাপারটি তার কাছে একেবারে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। জানতে চাইলে উত্তর আসেÑ তোমাদের হয়ত সুযোগ-সুবিধা ছিল তাই পেরেছ। আমরা তো সেটা কখনও ভাবতেও পারতাম না। স্বামীও অক্ষরজ্ঞানহীন। আর তাই শিক্ষার ব্যাপারটি তার কাছে গুরুত্বহীন। বিয়ের পাঁচ বছর পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্ম। আবারও অকাল মাতৃত্বের রোষানলে পড়া। সাংসারিক কাজকর্ম তো করতেই হতো, ক্ষেতে খামারেও স্বামীর সাথে কাজ করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও ছিল না। আবার পুত্র সন্তানের দায়-দায়িত্বও তাকে একাই সামলাতে হয়েছে। তার পরেও এই অদম্য নারী কোনভাবেই থেমে থাকেনি। কিন্তু প্রতিদিনের বিপন্ন জীবন থেকেও রেহাই কখনই পায়নি। মাত্র ২ বছর পর ছোট ছেলের জন্ম। দুই সন্তানের জননী রীনার চোখে তখন ঘোর অন্ধকার। সামান্য ক্ষেতমজুরের পয়সা দিয়ে পুরো পরিবার সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল। অল্প স্বল্প সহায় সম্পত্তি যা ছিল তাও শরিকদের ভাগ বাটোয়ারায় সর্বস্বান্ত হতে বেশি সময় নিল না। ফলে বিপাকে পড়ে যায় রীনা তার স্বামী সন্তান নিয়ে। তারই জবরদস্তিতে স্বামী চলে আসতে বাধ্য হয় ঢাকা শহরে অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত হয়ে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে। ঢাকায় আসার পর স্বামী এবং সে নিজেও বিভিন্ন দিনমজুরের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। কোন ধরনের আর্থিক সম্বল বিন্দুমাত্র অক্ষরজ্ঞান না থাকায় একটু মানের কাজকর্ম খুঁজে পেল না। স্বামী নিল গণপরিবহনে সাহায্যকারীর কাজ আর সে নিজে বাসাবাড়িতে কাজের বুয়ার ভূমিকায় নামে। সুখ-দুঃখ আর গতর খাটা পরিশ্রমে এভাবেই দিনও কেটে যাচ্ছিল। এর পরেও রীনার জন্য আরও ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষায় ছিল। মাঝে মধ্যে গ্রামেও যেতে হতো প্রয়োজনে। সেই যাওয়া-আসাটাই কাল হলো তার স্বামীর ও পুরো পরিবারের। একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত। গ্রাম থেকে আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু। মুহূর্তের ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। উদভ্রান্ত, দিশেহারা রীনা দুই সন্তান নিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করে। রাজধানী ঢাকায় বিত্ত-নির্বিত্তদের সংখ্যা যেমন কম নয় একইভাবে অতি সাধারণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানেরও অভাব থাকে না। গত শতাব্দীর শেষ দশক। রীনার জীবন সংগ্রামের দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় সেও বিস্মিত, হতবাক। বলতেই থাকে কিভাবে সেই দুঃসময়গুলো পার করতে হয়। পোশাক শিল্প-কারখানা তখন এক বিশিষ্ট মর্যাদায় দেশে-বিদেশে নিজের স্থান তৈরি করেছে। আর সিংহভাগ নারী শ্রমিক পরিবেষ্টিত এই খাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে রীনার বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। মেশিন অপারেটর হিসেবে কারখানায় নিজের দায়িত্ব পালনে কখনও অসতর্ক কিংবা লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। তার পরেও দুর্ভাগ্য যার জীবনের চিরসাথী তাকে এড়ানোর ক্ষমতা তো রীনার নেই। এক সময় সেই পোশাক শিল্প-কারখানায় ঘটল আর এক বিপর্যয়। মেশিন অপারেটর রীনার হাত এক সময় দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গ হয়ে গেল। ইতোমধ্যে বড় ছেলে হয়ে পড়ে শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ। শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনির আশপাশেই হাড়ের ক্ষয়। সেভাবে চিকিৎসা করাও সম্ভব হয়নি। সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগে যেটুকু চিকিৎসা দেয়া সম্ভব তার চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারেনি। কোন হাড় বিশেষজ্ঞ (অর্থপেডিক্স কিংবা কিডনির ডাক্তার (নেফ্রোলজিস্ট)কে দেখানো সম্ভব হয়নি নিজের দারিদ্র্যপীড়িত অবস্থার কারণে। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। ছেলেরা বড় হয়েছে, সংসারও বেঁধেছে কিন্তু হতভাগ্য মায়ের দুর্দশার শেষ আজ অবধি হয়নি। এখনও মানুষের বাড়িতে দিন গতর খেটে উপার্জন করে। ছেলের চিকিৎসার জন্য কিছু খরচও করতে হয়। জীবনের ঘানি টানতে টানতে আজ সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। অসুস্থ ছেলেকে নিয়েও অসহায়। ছেলের যথার্থ চিকিৎসার জন্য আরও অনেক অর্থের প্রয়োজন। সেটুকু যোগাড় না হওয়া পর্যন্ত কোন শ্রান্তি নেই, বিরাম নেই। অতি বাল্যকাল থেকে পরিশ্রম করার কারণে শরীর এখনও অনেকটাই কর্মক্ষম। যে শ্রম সম্পদ নিয়ে সে এখনও জীবনের বিপরীত আর অস্থির, ঘটনা প্রবাহকে সামাল দিয়ে যাচ্ছে- আর কতদিন পারবে- সে নিজেও জানে না। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×