ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩ এপ্রিল ২০১৮

মার্চের ঘটনাবহুল দিন

(গত শনিবারের পর) ১৯ মার্চ ১৯৭১ অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিবসে ঢাকার অদূরস্থ জয়দেবপুরে জনতা এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে ৫০ জন শহীদ হন এবং প্রায় দুই শতাধিক আহত হন। জয়দেবপুর শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু জয়দেবপুরে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানান। জয়দেবপুরে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ এবং হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রাজধানী ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা, বর্শা-বল্লম নিয়ে রাজপথে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একদিন বিরতির পর সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অহেতুক ঢাকায় এসে সময় নষ্ট করছেন। ইয়াহিয়া খানের বোঝা উচিত শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ২০ মার্চ ১৯৭১ আন্দোলনের ১৯তম দিনে মুক্তিপাগল মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় রাজধানী টালমাটাল হয়ে ওঠে। প্রাক্তন নৌসেনারা এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম বেগবান করার জন্য একটি সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী কমান্ড গঠনের জন্য প্রাক্তন বাঙালী সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানান। সকালে কঠোর সামরিক প্রহরা পরিবেষ্টিত রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইয়াহিয়া খানের মধ্যে চতুর্থ দফা আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছয়জন শীর্ষ স্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, মুক্তি পাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। ২১ মার্চ ১৯৭১ সকালে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পঞ্চম দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পূর্বে তাঁর নিজ বাসভবনে বিশিষ্ট আইনজীবী এ কে ব্রোহির সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ৫ম দফা বৈঠকের সময় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। বিকেলে চট্টগ্রামে ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পলোগ্রাউন্ড মাঠে এক বিশাল জনসভায় বলেন, আলোচনায় ফল হবে না। এদেশের হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে চাপরাশি পর্যন্ত যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে মানে না, তখন শাসন ক্ষমতা শেখ মুজিবের হাতে দেয়া উচিত। ২২ মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সকালে ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ ত্রিপক্ষীয় আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক প্রায় সোয়াঘণ্টা স্থায়ী হয়। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজ বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মিলে-মিশে একসঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান এখন এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পথে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। তবে আমরা যদি আমাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকি তাহলে কোন কিছুই আমরা হারাব না। ২৩ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী চলছে অসহযোগ আন্দোলন। ২৩ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে সর্বত্র বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগ প্রতিরোধ বাহিনী ঢাকার পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে, যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন ৭ কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলবে। ২৪ মার্চ ১৯৭১ ২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাক সেনাবাহিনী সৈয়দপুর ও রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এতে ১৫০ জন নিহত হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে এম.ভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালী তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথ রোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ২০০ জন শ্রমিক শহীদ হন। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়। টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা সবধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিকরা এক জরুরী সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ২৫ মার্চ ১৯৭১ টালমাটাল মার্চের এদিন মানুষের ঢল নামে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির ৩২ নম্বর বাসভবনে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সারাদিন মাঝে মাঝে মিছিলের সামনে এসেই তিনি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিয়ে সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান। এদিন তার বাড়িতে সকাল থেকে অগণিত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় দুই শ’ ছিলেন বিদেশী। দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু খবর পান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদলবলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন আমি শুধু বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়। বাঙালীর আবেগ, সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করতে অস্ত্র হাতে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠার নীলনকশা চূড়ান্ত করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে নিষ্ঠুর গণহত্যা। ২৬ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করলে ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র নিরপরাধ বাঙালীর বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করলে-মুক্তি সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।’ কোন আপোস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল দেশ প্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লোকদের এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালীরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে বাঙালী দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে বুকের উষ্ণ রক্তে রাঙিয়ে রাতের বৃন্ত থেকে ছিনিয়ে আনে ফুটন্ত সকাল। স্বাধীনতার এই ৪৭ বছর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। তবুও হতোদ্যম হয়নি জাতি। এছাড়াও হার না মানা বাঙালী এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ দেশ গঠনের স্বপ্নিল অভিযাত্রায়। গৌরব ও স্বজন হারানোর বেদনার এই দিনে বীর বাঙালী সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিল। অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত বাঙালী জাতির সামনে আলোকময় ভবিষ্যতের দুয়ার খুলেছিল এই দিন। যা পূর্ণতা লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। সমাপ্ত... লেখক : শিক্ষাবিদ
×