ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রোন যুদ্ধ নিয়েই সবার মাথাব্যথা

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১ এপ্রিল ২০১৮

ড্রোন যুদ্ধ নিয়েই  সবার মাথাব্যথা

গত ৫ জানুয়ারি সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর ওপর ১৩টি হোম মেড ড্রোনের পরিচালিত হামলা বর্তমান অসম যুদ্ধের একটি উত্তম দৃষ্টান্ত। হোম-মেড ড্রোন এখন যে প্রচলিত সেনা ও নৌবাহিনীর প্রতি হুমকি এটা তার প্রমাণ। হোম-মেড ড্রোনের একদিকে রয়েছে অসাধারণ হাই-টেক অস্ত্র। অন্যদিকে মাইক্রোচিপের মতো সস্তা ও বাতিলযোগ্য রোবট বিমান। খমেইমিম-এ একটি রুশ বিমান ঘাঁটিতে ১০টি ড্রোন এবং নিকটবর্তী টারটুস নৌঘাঁটিতে ৩টি ড্রোন হামলা চালায়। বিমানগুলো ছিল অতি মামুলি ধরনের। ডানার দৈর্ঘ্য ছিল ৩ মিটার। কাঠ ও প্লাস্টিক দিয়ে বাসানো। বাড়ির লনের ঘাসকাটার যন্ত্র দিয়ে চালিত। প্রতিটি বিমানের ডানার নিচে ছিল গ্রেনেড। এই ড্রোনগুলো জিপিএস নিয়ন্ত্রিত ছিল। পাল্লা ছিল ১০০ কিলোমিটার। ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জামগুলো ছিল সাধারণ ব্যবহার্য উপাদান। প্রতিটি ড্রোনের পেছনে ব্যয় হয়েছে সর্বমোট হয়ত হাজার দুয়েক ডলার। এগুলোর এয়ারফ্রেমের সঙ্গে রাশিয়ার অরলান ১০ ড্রোনের মিল আছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের গুলিতে বেশকিছু অরলান ১০ ড্রোন ভূপাতিত হয়েছিল। মার্কিন ড্রোনগুলো কোন ধরনের ক্ষতি সাধন করতে পাবার আগেই সেগুলোকে ঠেকিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য এর চারদিন আগে সিরিয়ায় কোন এক হামলায় বেশকিছু রুশ বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের হামলা নিশ্চয়ই আরও হবে। গেরিলারাও বাণিজ্যিক ড্রোন সেই ২০১৫ সাল থেকে ব্যবহার করছে। আইএস গ্রেনেড ছুড়তে কোয়াডকপ্টারের ব্যাপক ব্যবহার করেছে। ২০১৭ সালেই কেবল গ্রুপটি দু’শরও বেশি হামলার ভিডিও পোস্ট করেছে। আইএস জনপ্রিয় ছায়াছবি স্কাইওয়াকার এক্সএইটের ড্রোনের অনুকরণে স্থির ডানার বিমানও বানিয়েছে। এগুলো কোয়াডকপ্টারের চেয়ে দূর পাল্লার এবং বড় আকারের বোমা বহন করতে পারে। সিরিয়া ও ইরাকের অন্যান্য গ্রুপও এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। এটি অরাজনৈতিক ক্রিমিনালদের হাতেও পৌঁছেছে। গত অক্টোবরে একটি ড্রাগ কার্টেলের সঙ্গে যুক্ত চারজন মেক্সিকানকে বোমাবাহী ড্রোনসহ ধরা হয়েছে। ড্রোন প্রযুক্তি সহজে প্রাপ্তিসাধ্য এবং সস্তাও। বাণিজ্যিক ইলেক্ট্রনিক্স, থ্রি-ডি প্রিন্টেট এয়ার ফ্রেম ও উন্মুক্ত সূত্র থেকে প্রাপ্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করে সামরিক মানের একটি ড্রোন বানাতে ২ হাজার ডলার লাগে। এ ধরনের ড্রোনের পুরো এক স্কোয়াড্রন বানাতে গেলে একটি সোলল্ডার্ড ফায়ার ক্ষেপণাস্ত্রের যে খবর তার চেয়েও কম খরচ পড়ে। আধুনিক জঙ্গী বিমানের খরচ তো আরও পরের কথা। আমেরিকার একটি এফ-২২ জঙ্গী বিমান বানাতে লাগে ৩০ কোটি ডলারেরও ওপরে। আর একটা বি-২ বোমারু বিমান তৈরির খরচ তারও বেশি। একটি মাত্র ড্রোনও অনেক ক্ষতি সাধন করতে পারে। তার দৃষ্টান্ত ইউক্রেন। সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দাহ্য গ্রেনেড দিয়ে ড্রোন আক্রামণ করে বেশকিছু অস্ত্রগুদাম ধ্বংস করেছে। একটি ক্ষেত্রে বিস্ফোরণে ৭০ হাজার টন গোলাবারুদ ধ্বংস হয়ে যায়। ছোট ছোট ড্রোন থেকে বিপদাশঙ্কা উপলব্ধি করায় অনেক দেশ এ থেকে সুরক্ষা পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এক মার্কিন জেনারেলের ভাষায় অস্ত্রবাহী ড্রোন হলো আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত সৈনিকদের প্রতি এক নম্বর হুমকি। তিনি মনে করেন ছোট ছোট ড্রোন মোকাবেলার বর্তমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। কারণ এগুলোর হদিস বের করা, চিহ্নিত করা ও ট্র্যাক করা কঠিন। এগুলো এত বিশাল সংখ্যায় আসতে পারে যে থামানো সম্ভব নয়। এর একমাত্র সমাধান জ্যামিং। অপারেটর ও ড্রোনের মধ্যে রেডিও সংযোগ ছিন্ন করে দেয়া কিংবা জিপিএস নেভিগেশন গুলিয়ে দেয়া হলে ড্রোন বিধ্বস্ত হতে কিংবা ভিন্ন পথে চলে যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ ডিড্রোন, ড্রোনডিফেন্ডার ও ড্রোনফিল্ড নামে অনেক জ্যামার ইতোমধ্যে নিয়োগ করেছে। সিরিয়ায় ৬টি ড্রোন এ ধরনের জ্যামাররা ভূপাতিত করেছে। অন্যগুলো কামান-ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ড্রোনেরও উন্নতি ঘটেছে। সেগুলো উত্তরোত্তর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। তার মানে জ্যাম করে দেয়ার মতো কোন অপারেটর সংযোগ এতে নেই। অপটিক্যাল নেভিগেশনের মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে জিপিএস জ্যামাররাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। সুতরাং একমাত্র পথ হলো গুলি করে ভূপাতিত করা। অবশ্য ছোট ছোট ড্রোনগুলো বিস্ময়কর রকমের কঠিন টার্গেট। আমেরিকার সাম্প্রতিক সেনা ম্যানুয়েলে বলা হয়েছে, ছোট আকারের ড্রোনকে সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করা অতীব কঠিন। রাইফেলের গুলি মিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বন্দুক কাজ করবে তবে সেটা কাছাকাছি পাল্লার মধ্যে থাকতে হবে। কাজেই ড্রোন বিধ্বংসী স্কোয়ার্ডকে ড্রোন হামলার সময় বাড়তি অস্ত্র রাখতে হবে। বলা যায় না কোনটি কখন কোন কাজে লাগে। ড্রোনের কোন স্ট্যান্ডার্ড সাইজ নেই বিধায় এর পাল্লা নির্ণয় করাও কঠিন। তাই ম্যানুয়েলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, একটা ড্রোনের দিকে সরাসরি ভাগ না করে গোটা স্কোয়ার্ডকে তার উপর একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে অস্ত্রগুলো চালাতে হবে যাতে করে গুলির একটা পর্দা সৃষ্টি করে ড্রোনকে ভূপাতিত করা যায়। তবে ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা পেতে ম্যানুয়েলে কমান্ডারদের বলা হয়েছে- সর্বোত্তম উপায়টা হলো তাদের ইউনিটকে অবিলম্বে নিরাপদ কোন স্থানে সরিয়ে নেয়া। অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে মার্কিন সেনাবাহিনী ড্রোন মোকাবেলায় তড়িঘড়ি করে তার সোল্ডার লঞ্জ স্টিঞ্জার ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নতি ঘটাচ্ছে। স্টিঞ্জার ক্ষেপণাস্ত্র নিচু দিয়ে চলা এরোপ্লেন ও হেলিকপ্টার ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হয়। ছোট সাইজের ড্রোনকে আঘাত হানতে এটা তৈরি করা হয়নি। সেজন্য স্টিঞ্জারকে এমনভাবে উন্নত করে তোলা হচ্ছে যাতে ওটাকে প্রক্সিমিটি ফিউজ যুক্ত করা যায়। স্টিঞ্জার ড্রোনের যথেষ্ট কাছাকাছি এলেই এই ফিউজ ফেটে গিয়ে ড্রোনকে ধ্বংস করে দেবে। ড্রোনের সংস্পর্শে আসারও দরকার হবে না। সারা বিশ্বে আমেরিকান পদাতিক ইউনিটগুলোতে এ ধরনের উন্নত সংস্করণের স্টিঞ্জার ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত ৬০০টি স্বল্প পাল্লার এয়ার ডিফেন্স টিম যোগ দেবে। তবে স্টিঞ্জারের উৎকর্ষতা ঘটানোর খরচ প্রতিটি পিছু পড়বে প্রায় ৫৫ হাজার ডলার। এটা স্টিঞ্জার তৈরির মূল খরচ ১ লাখ ২০ হাজার ডলারের অতিরিক্ত। কাজেই প্রতি এয়ার ডিফেন্স টিমের জন্য প্রায় ২টি করে ধরে ১১৪৭টি উন্নত সংস্করণের স্টিঞ্জার কেনা হচ্ছে। ড্রোনের ঝাঁক এলে সেগুলোকে সামাল দেয়ার জন্য এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। মার্কিন সেনাবাহিনী আরেকটি কৌশলও চেষ্টা করে দেখছে যার সংক্ষিপ্ত নাম ব্লেড। এটি সাঁজোয়া যানের বর্তমান মেশিনগানের নলের ডগায় লাগানো থাকে এবং তাতে থাকে রাডার গাইডেন্স ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ। এতে হয়ত কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তবে ব্যাপক আক্রমণের মুখে এই ব্যবস্থা এখনও কার্যকর নয়। সাগরেও এই ধরনের সমস্যা রয়েছে। সেখনে শত শত কোটি ডলার মূল্যের জাহাজগুলো ঝাঁক ঝাঁক ড্রোনের আক্রমণের মুখে অসহায় হয়ে যেতে পারে। আমেরিকার নৌবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষার মূল শক্তিটা হলো ইজিস। এটি রাডার, কম্পিউটার, মিসাইল ও কামানের সমন্বিত ব্যবস্থা। ইজিসের স্বল্প পাল্লার কামান আছে যা দ্রুত গোলাবর্ষণে সক্ষম। ফালানক্স নামের এই কামান সেকেন্ডে ৭৫ রাউন্ড গুলি ছুড়তে এবং আগত ক্রুজ মিসাইল গুলি করে ভূপাতিত করতে পারে। তবে ছোট ছোট ড্রোনের বিশাল ঝাঁক আক্রমণ করতে এলে এ দিয়ে কিছু করা যাবে না। নৌবাহিনী এখন ইজিসের সফটওয়্যার উন্নত করছে। যাতে একই সঙ্গে আগত একাধিক টার্গেটকে আঘাত হানা যায়। এতে করে হয়ত ঝাঁক ঝাঁক ড্রোন আক্রমণ করতে এলে গোলার পর গুলি মেরে যতগুলো সম্ভব ড্রোন ঘায়েল করে ফেলা যাবে। তবে একই সঙ্গে চারদিক থেকে ড্রোনের ঝাঁক হামলা করতে এলে একটা কামান দিয়ে গুটিকয়েকের বেশি ড্রোন ধ্বংস করা যাবে কি-না সন্দেহ। ড্রোন মোকাবেলার কৌশল উদ্ভাবনকারীরা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে লেজার অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভাবছে। লেজার অস্ত্র আলোর গতিতে টার্গেটকে আঘাত হানে। এই অস্ত্রের সরবরাহ অসীম এবং প্রতি শটের খরচ এক ডলারেরও কম। টার্গেট ড্রোনের বিরুদ্ধে এই অস্ত্রের ব্যাপক ও সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। ড্রোন বিধ্বংসী নানা ধরনের লেজার অস্ত্র এখন উদ্ভাবিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে আছে লর্কহিড মার্টিনের এথিনা, রেলিওনের এন্টি ড্রোন লেজার এবং মার্কিন নৌবাহিনীর উদ্ভাবিত এলএডব্লিউএস। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো এই লেজার অস্ত্র দিয়ে কত তাড়াতাড়ি টার্গেটের হদিস বের করা, ট্র্যাক করা ও ভাগ করা যায় এবং ধ্বংস করার জন্য কতক্ষণ লেজাররক্ষী টার্গেটের উপর বর্ষণ করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়ার জন্য বেশ কয়েক সেকেন্ড লাগতে পারে এবং সেটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত লেজার অস্ত্র একই প্রক্রিয়া চালানোর জন্য অন্য টার্গেটের দিকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, একটি ড্রোন বিধ্বংসী লেজার দিয়ে মাত্র সামান্যসংখ্যক হামলাকারীকে মোকাবেলা করা সম্ভব তার বেশি নয়। ড্রোন হামলা ঠেকানো এতই যখন সমস্যা ও ঝকমারি তাই মার্কিন সেনাবাহিনীর দলিলপত্রে ড্রোন উৎক্ষিপ্ত হতে না দেয়ার অর্থাৎ উৎক্ষেপণের আগেই সেগুলো ধ্বংস করে দেয়ার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাশিয়া বলেছে গত জানুয়ারিতে তারা লেজার নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ব্যবহার করে ইদলিবে ব্যাপক ড্রোন হামলার জন্য দায়ী একটি অজ্ঞাতনামা গোষ্ঠী এবং সেই সঙ্গে তাদের ড্রোম সংযোজন ও মজুদের স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে ড্রোনের জন্য কোন রানওয়ে ও হ্যাঙ্গারের প্রয়োজন নেই এবং যেখানে সেগুলো বাড়িঘর ও গ্যারেজ থেকে চালানো যায় সেখানে সেগুলো খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়। পর্যাপ্ত আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারলে গেরিলাদের ড্রোনের ঝাঁক সত্যিকারের বিপদ হয়ে দেখা দেবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×